তাকে প্রথম বার দেখি যখন আমার বয়স ৯বছর। সেই বয়সের অনেক স্মৃতিই মনে নেই, কিন্তু তাকে আমার স্পস্ট মনে আছে। হয়ত নিউরন কোষে স্থায়ী দাগ পড়ে গেছে ওই ভয়ঙ্কর স্মৃতিটার।
আমাদের তখনকার বাসাটা ছিল টিনের ঘর, আম কাঠালের বাগানের এক পাশে বাসা; আরেক পাশ দিয়ে সরু গলি চলে গেছে মহল্লার ভেতর দিয়ে মসজিদের দিকে। ঠিক আমাদের বাসার যে দিক দিয়ে গলি চলে গেছে, তার অপর পাশেই একটি কবর। আমি জন্ম থেকেই এই কবরটি দেখে আসছি। মানুষের মনে কবর বা কবরস্থান ভয়ের একটি অনুভুতির জন্ম দেয়, বিশেষ করে বাচ্চাদের মধ্যেতো আরো বেশি। বাবা-মা বা দাদা-দাদির কাছে ছোটবেলায় ভুতের গল্প কে না শুনে বড় হয়েছে! শিশু মনে তাই কবরস্থান, শ্বশান এগুলো অন্যরকম ভয়ের অনুভুতির জন্ম দেয়। কিন্তু এই কবরটি আমার মনে কোন ভয়ের অনুভুতি কখনোই তৈরি করে নি কেন জানি, হয়তো বা জন্মের পর থেকেই দেখে আসছি বলেই।
আমার ছেলেবেলায় আমাদের বাসায় কোন টিভি ছিল না। আমি টিভি দেখতে যেতাম আমার চাচার বাসায়। আমাদের পুরো মহল্লাতে তখন হাতে গোনা ৫টি বাড়িতে টিভি ছিল। কার্টুন হোক বা অন্যকোন অনুষ্ঠান সন্ধ্যার পরে সপ্তাহে মাত্র ২দিন দেখার অনুমতি পেতাম বাসা থেকে, তাও চাচার বাড়িতে গিয়ে শুধু, অন্য কোন বাড়িতে গিয়ে টিভি দেখা আমার বারন ছিল। চাচার বাড়ি যেতে হত সেই সরু গলি ধরে, কবরটির পাশ ঘেসে আম কাঠালের বাগানের শেষ মাথায়। তখন ক্লাস ৪ এ পড়ি, হাফ ইয়ারলি পরিক্ষা শেষ, স্কুল ছুটি। কোন এক সন্ধ্যার পর টিভি দেখে দেখে চাচার বাড়ি থেকে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরছিলাম একা একা। সাধারণত রাত হয়ে গেলে হয় চাচার বাড়ি থেকে বড় কেও আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিত। সেদিন আর বাড়ি পৌঁছে দেয়ার মত কেও ছিল না। চাচী একবার জিজ্ঞাসা করলেন – একা বাড়ি যেতে পারবি না আমি পৌছে দেব? আমি বললাম পারব তুমি একটু দরজায় দাড়াও আমি এক দৌড় দিয়ে চলে যাই। চাচি দরজায় দাঁড়িয়ে রইলেন আমি বাসা থেকে বের হয়ে দৌড় দেয়ার বদলে হাটতে লাগলাম সরুগলি পধ ধরে। গলি পথের অর্ধেক দূরত্বে একটা বিশাল কাঠাল গাছ, এ কাঠাল গাছটির নাম ছিল কালী কাঠাল গাছ। বিশাল আকারের কালো কুচকুচে রঙ এর কাঠাল ধরত এ গাছে। এই গাছটি পর্যন্ত চাচীকে দেখা যাচ্ছিল, তার পর গাছ পার হয়ে আরেকটু সামনে বাড়তেই চাচার বাড়ির দরজা আড়াল হয়ে গেল। অন্ধকার রাত, তখন রাস্তায় এত লাইটপোস্ট ছিল না, সরু গলির শেষ মাথায় আমাদের বাসার ঠিক সামনে একটা আগেকার দিনের টিমটিমে লাল লাইট জ্বলছিল, আমাদের বাড়ি দেখা যাচ্ছিল। আর একটু সামনে এগিয়ে যেতেই একপাশে আমাদের শোয়ার ঘর আরেক পাশে কবর। হঠাত করেই কেন জানি গা ছমছম করতে লাগল, ফাঁকা গলি – কোথাও কেও নেই। তবুও গা ছমছম ভাব বাড়ছে; কেমন জানি অস্থির লাগতে লাগল। ঠিক কবরের সামনে পৌঁছে থমকে গেলাম, আমার হাত পা সব অবশ হয়ে আসতে লাগল। কবর থেকে কে যেন উঠে আসছে সাদা চাদর গাঁয়ে। ওদিকে চাইব না চাইব না করেও চোখ যেন আটকে গেল। দৌড় দেই দেই করেও পা যেন মাটিতে কেও পেরেক দিয়ে আটকে দিল। পা থেকে কোমর পর্যন্ত সাদা চাদর গাঁয়ে কে যেন বের হয়ে আসল, কোমরের ওপর থেকে চাদর বা অন্য কিছু নেই, কেমন জানি সাদা মেঘের মত বা কুয়াশার মত একটা অবয়ব কাঁধ পর্যন্ত, কাঁধের ওপর কোন মাথা নেই, কিচ্ছু নেই, একদম ফাঁকা। লাইট পোস্টের হালকা আলোতে ঠিক মত দেখা যাচ্ছে না তবুও যেন আমি তাকে দেখতে পাচ্ছি, আমার মাথার ভেতর তার পুরোটা অবয়ব যেন গেঁথে যেতে লাগল। আমার মাথা পুরো ফাঁকা হয়ে গেল, কি যে এক অনুভুতি গ্রাস করে নিল আমি ঠিক বোঝাতে পরব না। মুখদিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছে না আমার, পা চলছে না, আমি স্থবির হয়ে গেলাম সেখানেই। আমি চোখ বন্ধ করে হাটু ভাঁজ করে কখন যে বসে পড়েছি বলতে পারব না। কতক্ষন কেটেছে তা মনে নেই, কি করেছি তা মনে নেই শুধু অন্যরকম অন্যভুবনের এক অজানা ভয় জুড়ে ছিল আমার পুরো অস্তিত্ব জুড়ে, মাথায় কোন অনুভুতিই কাজ করছিল না শুধু অবর্ণনীয় এক ভয়ের অনুভুতি ছাড়া। হঠাৎ করেই অনেক দূরে পেছন থেকে কার জানি গলা শুনতে পেলাম। মানুষের গলার শব্দ আস্তে আস্তে এগিয়ে আসতে লাগল আমার কাছাকাছি। একটু সাহস নিয়ে চোখ খুললাম, সামনে কাওকে দেখতে পেলাম না। পেছন থেকে নামাজীরা এশার নামাজ শেষ করে এ পথ ধরে ফিরছেন। তখনো আমি কোন কথা বলতে পারছি না। আমাকে এভাবে এখানে দেখে মহল্লার এক মুরুব্বী বললেন – খোকা এত রাতে এখানে বসে আছ কেন? আমার মুখে কোন কথা নেই। কাপছিলাম বোধ হয় তখন আমি কিংবা কাঁদছিলাম। আমাকে হাতে ধরে নিয়ে আসলেন ল্যাম্পপোস্টের তলায়। তখনো কোন কথা বলতে পারছি না। একটু পরে দেখি ওনাদের পেছন পেছন নামাজ থেকে দাদা ফিরলেন, আমাকে কোলে করে বাসায় নিয়ে আসলেন।
কি হয়েছে জিজ্ঞাসা করার পর ওনাকে বললাম সব ঘটনা। উনি কিছুক্ষন চুপ করে থেকে শুধু বললেন, “দাদাভাই এইটা নিয়া আর কারো লগে কোন কিছু কইও না, একলা আর ওই কবরের পাশ দিয়া চলাফেরা কইর না। তুমি যা দেকছ তা ভুইলা যাওয়ার চেস্টা কইর – তয়, এইটা তোমার চোখের কোন ধান্ধা না। এইটা সত্য, তুমি তারে আবার দেখবা কোন না কোন সময়, হয়তো অন্য কোন বেশ ধইরা। তয় ডরাইও না। সে তোমার কোন ক্ষতি করব না।“
দাদার কথাগুলো আমার আজো মনে আছে, আমি আবার তাকে দেখেছি। মাঝে মাঝে এখনো তাকে অনুভব করি। সে আসে আমার কাছে, কি চায় তা জানি না, কেন আসে তা জানি না, তবে সে আসে; আর যখন আসে আমার পুরো অস্তিত্ব ওলোটপালট হয়ে যায় তখন। সে কথা অন্য কোন সময় অন্য কোন গল্পে বলব। তবে এটা কোন গল্প নয়, আমার জীবনের সত্যি ঘটনা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন