ন-মানুষ সে
আজ একটি ন-মানুষের কথা লিখতে বড্ড ইচ্ছে করছে
আজ আমি একটি ন-মানুষের কথা লিখব
আমার লেখনীতে তার জবানিতে।
লেখকের একটি সমস্যা হলো কিছু লিখতে গেলেই
হাজার প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়
এর কাছে ওর কাছে
শতেক প্রশ্ন, কিন্তু জবাব হয় না তার কোনো।
তবুও তার কথা না লিখেও যেন শান্তি পাচ্ছি না
আমাকে সে মানা করেছিল তার নাম বলতে
তবে বলেছিল তার জীবনের ঘটে যাওয়া ঘটনা
যদি সুযোগ থাকে তবে বলতে।
এখানে আমি তার নাম উল্লেখ করব না
তার পরিচিত জনেরা এ লেখা পড়লেও তাকে চিনতে পারবে না
হয়তো শুধু আহা উহু করে একটু দুঃখ প্রকাশ করবে
যদি এ লেখা তাদেরই কারো চোখে পড়ে।
আমার তার কথা বলতে ইচ্ছে করছে কারণ
আমিও হয়তো তারই মত একজন ন-মানুষ
আমি যাযাবর সে ভবঘুরে
দুজনের কোথায় যেন একটা মিল আছে মনের ঘরে।
ভূমিকা হলো অনেক এবার শুরু করা যাক –
হাত পায়ে এখানে ওখানে চুলকায় শুধু
কেন বুঝি না ফোঁড়ার মত কিছু হয়
চুন দিয়ে লাগাই মধু
সারে না
চুলকানি বেড়ে যায়, ছড়িয়ে পড়ে সারা গায়
কিছুদিন থাকে আবার আপনি থেকেই চলে যায়
আমি ভবঘুরে জীবনে ঘুরে বেড়াই নিজের মতন করে
বাবা মা ভাই বোন আত্নীয় স্বজন কারো পরোয়া না করে
কাজ করতে ভালো লাগে না
কাজে মন বসেও না।
বরং আমাকে নদী টানে, বন টানে
পাহাড় টানে আর টানে সমুদ্র
চাঁদনি রাত টানে হারিয়ে যেতে ধুসর হলুদ আলোয়
অমাবস্যা টানে অন্ধকারের গহীন কালোয়
নৌকোয় জীবনটা পাড় করে দিতে পারলে হত বড়ই ভালো
কেন জানি ভবঘুরে ডাক শুনেছিলাম, জীবনটা হয়েছিল আলো
এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াই, মাঝে মাঝে বাড়িতে মুখ দেখাই
বাবা মা, ভাই বোন এখন আর বকুনি দেয় না আগের মতন যেন
বুঝে গেছে তাঁরা বলে বলে লাভ হবে না কোনো।
এবার বাড়ি ফেরার পড়ে যেন পায়ে ঘা হয়ে গেল
অনেক খানি জায়গা জুড়ে
ছুটলাম আবার ডাক্তারের ঘরে
এই টেস্ট ওই টেস্ট, শতেক ঝামেলা
অবশেষে দেখি ডাক্তারের গম্ভীর মুখ কালো
সুধাই তারে, কি হলো ভাই? আনো না মুখে আলো
খুলে বল দেখি ঘটনাটা কি?
খারাপ কিছু নয় তো?
ঠাট্টা করে বলি –
ডাক্তার বাবু, আয়ু আছে আর কত দিন?
নদীর কাছে, সমুদ্রের কাছে আর জীবনের কাছে
আমার অনেক যে রয়ে গেছে ঋণ;
এখনই বলো না যেন বিদায় বেলা হয়ে গেছে আমার
খুলে বল দেখি ভাই, সত্যি শোনার সাহস আছে আমার।
বুড়ো ডাক্তার বেটা তাকিয়ে থাকে অপলক চোখে
জিজ্ঞাসা করে তোমার বাসায় বড় কে আছে ?
বাবা কিংবা মা, চাচা কিংবা ফুপা?
আমি রহস্য করি আর বলি
এ জগতে হায় কেউ কারো নয়
তাই আমিও যে অন্য কারো নই
আমার বলতে আছি শুধু আমি
নিশ্চিন্ত মনে আপনি বলে যান দেখি
হয়েছে টা কি আমার?
খারাপ কিছু?
বাঁচবো তো আরো দিন কিছু?
বুড়ো ডাক্তার আরো গম্ভীর হয়ে যায়
আবার সুধায় আমায়
সত্যি কি কেও নেই তোমার?
আমার মনে খটকা
তার ভীষণ গম্ভীর মুখ দেখে
একটা ধাক্কার মত লাগে
আবার মিথ্যে বলি ছলনায়
এ জগতে আমি শুধু জানি আমায়।
রহস্য অনেক হলো এবার একটু মুখ খোলো
বুড়ো ডাক্তার মায়াভরা চোখে চায়
কি যেন বলতে গিয়ে গলায় তার কি আটকায়
তবু দ্বিধা দ্বন্দ্ব ঝেড়ে বলে
বাবারে তোমার শরীরে মরণ রোগ বাসা বেধেছে
ক্যান্সারের জীবাণু তোমায় কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।
বড্ড ম্লান মুখে হাসি আনি
এ কথা বলতে এত দ্বিধা কেন?
আমি তো এ অনেক আগের থেকেই জানি
হাড়ের ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়েছে সারা গায়ে
মনের ক্যান্সার তো সেই কবেই কুড়ে কুড়ে খেয়ে গেছে পালিয়ে
তার নির্দিষ্ট যাত্রাপথে
তাইতো আমিও ছুটে চলেছি ভবঘুরে হয়ে পথে পথে।
চিকিৎসা করাবে না? ডাক্তার সুধায়
হাসি মুখে বলি তারে, বামন কি চাঁদের নাগাল পায়?
শুধু বলে দিন কত দিন আর আছে আমার
অনেক ঋণ রয়ে গেছে এর ওর কাছে যে আমার
রক্তের ঋণ, ভালোবাসার ঋণ
একে একে শুধিতে হবে সবই যে আমার।
ডাক্তার যেন বোঝে কিছু, ভাবে যেন অন্যকোন কিছু
বলেন ইচ্ছা শক্তি বড় শক্তি
ডাক্তারি ভাষায় এর পরিমাপ করা যায় না
তোমার জীবনের কথাও আমি বলতে পারি না
দেখ যে কয়দিন আছে
চেষ্টা করে যাও ভালো থাকার
ওষুধ কেনার সামর্থ্য কি আছে তোমার?
আমি ডাক্তারের চোখের দিকে তাকাই
বলি আমার আছে ভালোবাসা অপার, মানুষের জন্য
আর আছে ভবঘুরে জীবনের যন্ত্রণা কিছু
ওষুধ, সে না হয় থাক ফার্মেসীর কোণায় পড়ে
বড় বড় মানুষের কাজে লাগবে বলে
আমি বের হয়ে আসি ডাক্তারকে গুডবাই বলে।
এতো মহা ফ্যাসাদ, কি হবে জীবনে আমার
বেঁচে থাকা মানে মধ্যবিত্ত সংসারের হাড়ি কুড়ি বেচা
বাবা মায়ের শেষ সম্বলটুকু দিয়ে বোনটার বিয়ে দিতে হবে
আমার জীবনের মূল্য কি তার থেকে বেশি হয়ে রবে?
অনেক ক্যালকুলেশন অনেক চিন্তা করে দেখি
এ রোগের চিকিৎসা করাতে গিয়ে গুষ্টি শুদ্ধ ফকির হবার বাকি
মানসিক অশান্তির কথা না হয় বাদই দিলাম
মধ্যবিত্ত বাবার কথা চিন্তায় মাথায় নিলাম।
হবে না কিছুই
এদের জানিয়ে সূচনা এক ভয়াবহ জীবনের পরিণাম
আমার আর বাকি সবার
তার থেকে ভালো হয় আমি আবার পালিয়ে গেলাম।
আবার পালাই আমি ভবঘুরে জীবনে
সব ছেড়ে ছুঁড়ে
তবে এবার অন্যবারের মতন হুট করে নয়
সবার সাথে একটিবারের মত হলেও দেখা আমার হয়
কোথায় যাচ্ছি শুধায় বাবা মা
অস্থির ছোট বোনটা আমার
কি জানি রে পাগলি কোথায় যাব জানি না
তবে খুব শিগগিরই এবার কিন্তু ফিরব না
তোরা কিন্তু একটুও মন খারাপ করিস না
আমি যেখানেই থাকি ভালোই থাকব আমার কথা ভাবিস না
এই বলে মুঠোফোনটা ছোট বোনকে দিয়ে গেলাম
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইলে বললাম আমি নেটওয়ার্কের মধ্যে থাকব না
অনেক দিনের শখ একটা মুঠোফোনের তোর
আজ না হয় এটা একেবারেই দিয়ে দিলাম তোকে
যখনি আমার কথা মনে পড়বে কানে চেপে ধরিস
মনে মনে কথা বলিস আমার সাথে।
বের হলাম বাড়ি থেকে এবার হয়তো চিরবিদায়..................
তারপর দিন পার হয় মাস যায়.....................
ছেলেটির সাথে দেখা হয়েছিল আমার কোন এক জেলে নৌকায়
ভবঘুরে যেন চিনে নিয়েছিল যাযাবরেরে
কাটিয়েছিলাম দুটি দিন নদী বুকে চড়ে
জেলে নৌকায়
পরিচয় সেই সেখান থেকে
এর পর অনেক কথা তার জীবনের
সবকিছু আমার শোনা হলো
শ্রদ্ধায় আমার মাথা নত হলো।
তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম আর ফিরবে না লোকালয়ে
করুণ হেসে বলেছিল আমায়, কি হবে আর ওখানে গিয়ে
তার থেকে যে কদিন বাঁচি
এই কাশবন, এই নদীজল এদের সঙ্গেই থাকি
সূর্য আর চাঁদনির সাথে কথা বলি
দিন আর রাত্রির মিলন দেখি
অন্ধকারের গান শুনি
যখন ব্যথায় চোখে মুখে অন্ধকার দেখি
ঠিক তখনই মায়ের মুখ ভাবি
বাবার অসহায় চেহারার কথা ভাবি
ব্যথাকে দমন করি
নদীস্নান করি, জলে ধুয়ে নিতে ব্যথাগুলো।
অনেক ধুলো ময়লা জমে গেছে গায়ে
অনেক পাপ জমা হয়ে গেছে কালে কালে
এখন ঋণ শুধিতেছি সবার একা নির্জনে বসে
খুব শিগগিরই চলে যেতে হবে অন্য ভুবনের দেশে।
আমি তাকে শুধাই যাবে আমার সাথে ভাই?
কিছুটা না হয় চেষ্টা করে দেখলাম আমার সাধ্যে যা আছে।
মুচকি হেসে বলে – জীবনে অনেক দেখেছি
অনেক পেয়েছি, আবার হারিয়েছি তার থেকে অনেক অনেক বেশি
শুধু বাবা মার ভালোবাসা ধরে রেখেছিল আমায়
সেই কবেই ফেলে চলে গিয়েছিল প্রেমিকা আমায়
নতুনত্বের সন্ধানে
সেদিন থেকে তো এমনিতেই মনে মনে মরে আছি
এখন এই রোগ যেন আশীর্বাদ হয়ে এসেছে আমার জীবনে
তার কথা এখনো ভাবি মনে মনে
দোয়া করি মন থেকে ভালো থাকুক সে সুখী হয়ে
নিয়তির বিধান কে খণ্ডাতে পারে
আমাকে যে যেতেই হবে আজ বা কাল ওপাড়ে।
তার থেকে এই ভালো আছি নদী জলে মিশে
শুধু ভেতর থেকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে দেহ আমার বিষে।
তাকে শুধাই আমি যদি তোমার কথা লিখি
কবিতার ছলে কিংবা গল্পের ধারায়
আমার কোন এক লেখায়?
শুধায় সে তাতে কি কারো কিছু এসে যায়?
ঠিক আছে লেখো তুমি যদি কোনদিন মেলে সময় তোমার
তবে আমার নামটি নিও না কোথাও এটুকু অনুরোধ আমার।
শিল্পী, মনের রং-তুলিতে আপন মনে ছবি একে যায়
কিছু পড়ে থাকে হেলায় ফেলায় কিছু ছবি ধনী গৃহে শোভা বাড়ায়
শিল্পীর ঘর শূন্য থাকে বর্ণহীন সাদা ক্যানভাসের মত
কখনো ছবি বিক্রি হলে পেট চলে কখনো ভুখো মরে।
যাযাবর আর ভবঘুরেরা ঘুরে বেড়ায় এধার ওধার
পাথেয় কিছু কুড়িয়ে খায় কিংবা জ্বলে উপোষ জ্বালায়
কবিরা লিখে যায় কলমের আঁচরে তাদের দুঃখ গাঁথা
বোদ্ধারা বই কিনে সাজায় আলমিরাতে, পড়ে থাকে ধুলো মাখা
ভবঘুরে আর যাযাবরের কি আসে যায়
পেটে ভাত জোটে না অথচ মরণ ব্যাধি বাধায়।
তার কথা লিখতে গিয়ে কেন জানি ভিজে উঠছিল বার বার
চোখ দুটি নোনা জলে
এতদিনে ভবঘুরে জীবনের হয়তো সাঙ্গ তার হয়েছে
আর কখনো দেখা হয় নি তার সাথে
হয়তো ভবলিলা সাঙ্গ হলে কোথাও মরে পরে আছে
ভেসে গিয়ে কোন এক নদী জলের পরে
কাঁদা পানি মেশানো কোন এক চরে
তবে মনের অনেক গভীরে গেঁথে আছে তার ব্যথা
বলেছিল সে সুযোগ পেলে লিখতে তার কথা।
যদি এই লেখা পড়ে আমারই মত কারো চোখ ভিজে ওঠে নোনা জলে
তবে আকুতি থাকলো, তার জন্য একটু প্রার্থনা করো তোমরা সবাই মিলে।

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন