সোমবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১২

সোহাগী - একটি অটিস্টিক মানুষের গল্প




সোহাগী

by যাযাবর জীবন

একটি অটিস্টিক মানুষের গল্প







গল্পের শুরু -


ধুমধাম করে সানাই বাজিয়ে পুরো গ্রামের মানুষকে দাওয়াত করে খাইয়ে বিয়ে হল শুভ্রর সাথে সোহাগীর। বিয়ে বাড়ির হৈ চৈ থিতিয়ে এলো রাত বাড়ার সাথে সাথে। লোকজন এসে পেট পুরে খেয়ে গেল তবে চৌধুরী বাড়ি থেকে বাইরে পা দিয়েই যার যার বাড়িতে ফিরে যাবার সময় নিজেদের মধ্যে আলোচনা আর টিপ্পনী কাটতে ভুলল না – “পাগলের আবার বিয়ে!!!! “

বাসর ঘরে বসে আছে সোহাগী, লজ্জায় অবনত, মনের মাঝে হাজার শঙ্কা দ্বিধা আর কি এক ভয়ের স্রোত শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে যাচ্ছে। সারা গায়ে ভরি ভরি সোনার গয়না পড়ে লাল শাড়িতে মুড়ে। জীবনে এত গহনা এক সাথে দেখার সৌভাগ্য হয় নি তার, গায়ে পড়ে থাকা তো অনেক দূরের কথা। মনে কি এক শঙ্কার ঝড় বয়ে যাচ্ছে বাসর রাতের কথা চিন্তা করে। এটি তার দ্বিতীয় বাসর। প্রথম বাসরের তিক্ততা মনের মাঝে আজো গেঁথে আছে তার।

এক ভয়ার্ত মুখে বসে আছে অপেক্ষায় নতুন স্বামীর, অনেকক্ষণ পার হয়ে গেছে; কেও ঢুকছে না কামরায়। অস্থির অপেক্ষার প্রহর যেন আর কাটে না। বসে থাকতে থাকতে ঝিমুনি চলে এসেছে। এমন সময় তার নতুন শাশুড়ি মাতা তার একটি ফুটফুটে সুন্দর যুবক কে সাথে নিয়ে ঘরে ঢুকলো। লজ্জায় অবনত মুখ যুবকটির, চোখে ভারি চশমা। কেমন যেন উদাসীন দৃষ্টি। যেন কামরায় ঢুকতেই চাইছে না। মা তার জোর করে হাত ধরে টেনে নিয়ে এসে বসালো বাসর খাটে।






বৌ মা, এই হোল শুভ্র, তোমার স্বামী। এতদিন এর দায়িত্ব আমি পালন করেছি তোমার আমানত হিসাবে এখন নিজের আমানত বুঝে নাও। এত দিন আমি সামলেছি আমার ছেলেকে; আজ থেকে এর দায়িত্ব তোমার। দেহে যুবক হলেও মনে মনে কিন্তু একটি শিশু এখনো। সুতরাং সেই ভাবেই তার সাথে বন্ধুত্ব গড়ে নাও। সখ্যতা গড়ে তুলতে পারলে দেখবে তার মত ভালো ছেলে আর একটিও নেই।

এই বলে মা কামরা থেকে বের হতে গেলেন, ছেলে মায়ের আঁচল টেনে ধরল।

মা আমি তোমার সাথে থাকব, এই রুমে থাকব না।

বাবা আজ থেকে এই মেয়েটি তোমার স্ত্রী, তোমার নতুন বন্ধু। আমার বয়েস হয়েছে আমি এখন আর তোমাকে সামলাতে পারছি না দেখে তোমার জন্যই একে নিয়ে এসেছি তোমাকে দেখাশুনা করে রাখার জন্য। তোমার সাথে এখন থেকে সবসময় ছায়ার মত থাকবে, তোমার সাথে খেলাধুলো করবে। তোমাকে এটা ওটা শেখাবে। তুমিও নতুন একটি খেলার সাথী পাবে।

লক্ষ্মী ছেলে আমার মায়ের কথা শুনতে হয়। আজ থেকে তুমি এ ঘরেই ঘুমুবে তোমার নতুন বন্ধুর সাথে।

ছেলে কখনো মায়ের অবাধ্য হয় নি, আজও হল না।

বলল, আচ্ছা ঠিক আছে মা। কিন্তু ও কি আমাকে বন্ধু হিসাবে মেনে নেবে? আমার সাথে খেলা করবে?

হ্যাঁ বাবা, সব করবে। তুমি যেভাবে চাও সেভাবেই করবে।
বলে মা বের হয়ে গেল।

সোহাগী তাকিয়ে রইল তার নতুন স্বামীর দিকে চেয়ে, সুন্দর চেহারার মায়াভরা একটি যুবক বসে আছে তার সামনে। কিন্তু হাবভাবে কেমন যেন!! ঠিক কেমন বুঝতে পারছে না। তার আগের বিয়ের কথা মনে পড়ছে, আগের বুড়ো হাবড়া জামাই এর কথা মনে পড়ছে আর মনে পড়ছে তার নগ্ন কামনায় প্রতিরাতে ধর্ষণের কথা। বিয়ের আগে বাবা মার মুখে শুনে এসেছে, স্বাভাবিক আর দশটা মানুষের মত ঠিক নরমাল নয় যার সাথে তার বিয়ে হচ্ছে। গ্রাম্য ভাষায় আর দশজন একে পাগল বলেই ডাকে। সুতরাং সে মনে করেছিল এও বোধ হয় আগের স্বামীর মত কিংবা তার থেকেও খারাপ কিছু হবে। আজ রাত হয়তো বাসর রাতের বদলে তার জীবনে আরেকটি কালো রাত হয়ে দেখা দেবে যার ঘা থেকে যাবে সারাজীবন। এরকম কিছুর জন্য সোহাগী মানসিক ভাবে প্রস্তুত হয়েই ছিল আজ রাতে।

এটা তার জন্য ঠেকায় পড়ে বিয়ে, কোন উপায় ছিল না বলে। বাবা মায়ের সংসারে বোঝা হয়ে ছিল এতদিন প্রথম স্বামীকে হারানোর পরে। নানা বাস্তব সমস্যার সম্মুখীন হতে হতে যখন আর পারছিল না তখনই শেষ মেশ এই বিয়েটাকে মেনে নিতে হয়েছিল। যৌতুক ছাড়া যেখানে বিয়ের কথা চিন্তা করা যায় না সেখানে তার বাবা মায়ের উলটো অনেক কিছু দেয়া হয়েছে তার শ্বশুর বাড়ি থেকে। হালের বলদ দুইটা, ধানী জমি কিছু, বিয়ের পুরো খরচ এ ছাড়া বাবার হাতে নগদ অনেকগুলো টাকার বিনিময়ে এই বিয়ে।

সোহাগী এ ছেলেকে আগে দেখি নি, তাই অনেক ভয়ে আর দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিল, না জানি কেমন পাগলের সাথে বিয়ে হচ্ছে তার। এবার তার জানি কি দশা হয়? কি এক ঘোরের মাঝে বিয়ে, কখন কবুল বলেছিল কাঁদতে কাঁদতে কিংবা আদৌ বলেছিল কি না এখন আর মনে নেই। শুধু মনে আছে বার বার অজ্ঞান হয়ে পড়ছিল বিয়ে পড়ানোর সময়, কি এক আবেগে। হয়তো আগের স্বামীর কথা ভেবে, কিংবা এখনকার অবস্থানের কথা ভেবে।

অথচ ছেলেটিকে সামনে থেকে দেখে তার মন থেকে যেন সব ভয় ভীতি হঠাৎ করেই উধাও হয়ে গেল। সোহাগী চেয়ে চেয়ে দেখছে এই প্রথম বারের মত তার দ্বিতীয় স্বামীকে। কই একে দেখে তো পাগলের মতন মনে হচ্ছে না!! দিব্বি ভালো সুস্থ সবল দেহের একটি ছেলে, একটু মোটার ধাঁচের যেন মায়ের আদরে খেয়ে খেয়ে মুটিয়ে গেছে বরং কিছুটা। মোটা কাঁচের চশমার আড়ালে চোখ দেখতে চেষ্টা করল, চোখের ভাষা পড়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু ওখানে কোন ভাষা নেই যেন। কি এক ভয়াবহ শুন্যতা নিয়ে মায়াভরা দুটি চোখ তাকিয়ে আছে তার দিকে। যেন সেও বুঝতে চেষ্টা করছে তার নতুন সাথীকে। যেন বাচ্চা একটি ছেলে তাকিয়ে আছে উদাস চোখে। দেখে সোহাগীর মায়া লেগে গেল জানি কেন হঠাৎ করেই, মনের কোন এক গভীর তলদেশ থেকে। মনের মাঝে কেমন জানি এক ভালো লাগা কাজ করতে লাগল।

সোহাগী অনেকক্ষণ ধরে চুপ করে বসে থাকলো, শুভ্রও বসে আছে চুপচাপ। কারো মুখে কথা নেই। এভাবে আর কতক্ষণ। সোহাগী বুঝতে পারছে নতুন মানুষ দেখে তার মানসিক প্রতিবন্ধী স্বামী হয়তো কথা বলতে পারছে না, কিংবা দ্বিধা দন্দ কাটিয়ে উঠতে পারছে না। সোহাগীকেই মনে হয় এগিয়ে গিয়ে তার নতুন স্বামীর সাথে ভাব করতে হবে।
এই ভেবে, সোহাগী ধীরে ধীরে বিছানা থেকে উঠল, ছেলেটির সামনে গেল।


এই যে বাবু তোমার নাম কি?

শুভ্র।

আমার সাথে কথা বলবে না?

বলব।

তা হলে বল।

কি বলব?

আরে আমার নাম জানতে চাইবে না?

তোমার নাম কি?

আমার নাম সোহাগী।

হি হি হি হি, আধো ভাঙ্গা ভাঙ্গা বোলে প্রথম পুরো বাক্য বলল -
এতা আবার কোন নাম হল? সোহাগী!!!!

হি হি, সোহাগী মানে কি? সোহাগ করে কেও তোমাকে? মার মতল করে, আমাকে যেমন করে?

সোহাগীর মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি চাড়া দিয়ে উঠল, বুঝে গেছে দেহে যুবক হলেও সে একটি শিশুকে পেয়েছে তার স্বামী হিসাবে।

আমাকে কেও সোহাগ করে না, কেও আদর করে না, সবাই বকা দেয়। তুমি আমাকে আদর করবে? সোহাগ করবে?

কিভাবে আদল করে? মা... এর ... মতল? মা যেমন ভাবে আমাকে আদল করে ...... উম......... আল.........খাইয়ে দেয়,............আল.........কি জানি কি কলে......, হুম মনে পলেছে......... চুল আঁচলে দেয়, কাপড় পলিয়ে দেয়...... আল ... আল... কি জানি ... আল জানি কি কলে... সেভাবে?

হুম, অনেকটা সেভাবেই কিন্তু উনি তো তোমার মা, ওনার আদর সোহাগ এক রকম। আর এখন থেকে তুমি আমার স্বামী, তোমার আদর সোহাগ হবে অন্য রকম।

সেটা আবাল...... কেল...কম?

কেন তুমি কিছু জান না? বিয়ে করলে বৌ এর সাথে কি কি করতে হয় কিছু জান না?

না ...... আমি... আমি...তো জানি না কিচু? কি... কি... কলতে হয়? তুমি জান?

হুম আমি তো জানিই।

তুমি কি...ভাবে জান?

এটা বড়রা সবাই জানে।

উম ...ম ...তবে আমি জানি না কেন... ? মা... বলেতে...আমি...না কি বলো...হয়ে ...গেচি।

তুমি তো দেহে বড় হয়েছ, এখনো তোমার মনটা বড় হয় নি, মায়ের আঁচলের তলাতেই পড়ে আছে তাই তুমি জান না।

তা হলে?......উম...ম আমি একন...কি কলব? কিভাবে তোমাকে তোয়াগ কলব?

সেটা তো আমি জানি না।

না ... তুমি বলে দাও, ... উম...ম...তুমি চিকিয়ে দিলেই আমি চিকে নেব। আমাকে না...মা যা চিকিয়ে...দেয় আমি তাই চিকে... নিতে পালি, পলে একতু...একতু বুল হলেও বেতি বুল হয় না।

তা বাবু কি শিখতে চায়?

কি জানি............? উম... তুমি যা চিকাতে চাও তা একবার চিকিয়ে...দিলেই দেকো ...... সব চিকে যাব।

আচ্ছা ঠিক আছে তোমাকে আস্তে আস্তে সব শিখিয়ে দেব।

সোহাগী মনে মনে ভাবে, একে একদিনে বেশি কিছু বলা ঠিক হবে না। আগে এর সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে হবে, তারপরে সত্যিকারের বাসর রাতের জন্য সারা জীবনই পড়ে আছে।

প্রথম দিনই কিছু বোঝাতে গেলে উল্টো রিয়াকশন করলে হিতে বিপরীত হতে পারে।

তাই আর বেশি না এগিয়ে বলল, লক্ষ্মী ছেলেরা রাতে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে। এমনিতেই আজকে তোমার অনেক বেশি রাত জেগে ফেলেছ, আর রাত জাগলে শরীর খারাপ করবে।

গ্লাসে ঢাকা দেয়া দুধটুকু এগিয়ে দিয়ে বলল, এখন দুধটুকু এক চুমুকে খেয়ে শুয়ে পড় আমার পাশে।

আত্তা, উম...ম ...কিন্তু মা তো ।।পতিদিন আমাল মাতায় হাত বুলিয়ে ঘুম পালায়............।।

আচ্ছা বাবা, ঠিক আছে, আমি আজকে থেকে তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেব, তুমি দুধ খেয়ে টয়লেট থেকে এসে বিছানায় শোও আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি।

টিক আছে, বলে দুধ খেয়ে, টয়লেট সেরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ল। সোহাগী শুভ্রর চোখ থেকে চশমা খুলে টেবিলের উপর রেখে তাকে বালিশে শুইয়ে দিল।
সোহাগী শুভ্রর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ধীরে ধীরে শুভ্র গভীর ঘুমে ঢলে পড়ল।

সোহাগীর চোখে ঘুম নেই।

নির্ঘুম চোখে তাকিয়ে সে ভাবতে লাগল তার আগের বিয়ের কথা, আগের স্বামীর কথা –

গরীব ঘরে জন্ম সোহাগীর, বাবা অন্যের জমিতে কামলা খেটে সংসার চালায়। মা কাজ করে বাড়ি বাড়ি। কষ্টেসৃষ্টে কোন মতে দু বেলা দুমুঠো ভাত জুটে। তাও সারা বছর একরকম চলে না । যখন বাবার ক্ষেতের কাজ থাকে না তখন খুবই কষ্ট হয় ভাত জুটাতে।

কোন মতে প্রাইমারী স্কুল পর্যন্ত পড়ালেখা চালানোর পর আর সম্ভব ছিল না তার বাবার পক্ষে পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়ার। ছোট বেলা থেকেই পড়াশুনায় ভালো বলে স্কুলের শিক্ষকরা আদর করতেন। যখন আর স্কুলের বেতনের জন্য এক বছর পড়াশুনা বন্ধ রাখতে হয়েছিল তখন হেডমাস্টার সাহেব এসে বাবার সাথে কথা বলে তার স্কুলের বেতন ফ্রি করিয়ে দিয়েছিলেন। এজন্য হেড স্যরের কাছে চির ঋণী হয়ে আছে সে। স্যর এর কৃপায় বিনাবেতনে পড়ার সুযোগ পেয়ে মেট্রিক পাশ করেছিল। এটাই ছিল সোহাগীর জীবনের সবচেয়ে বড় এচিভম্যন্ট।

অনেক ইচ্ছা থাকা স্বত্বেও তারপর আর পড়ালেখা হয় নি। এর পর শুরু হলো বাবা মায়ের বিয়ের গঞ্জনা। মেয়ে বড় হয়ে গেছে বিয়ে দিতে হবে। যাদের নুন আনতে পান্তা ফুঁড়োয় তাদের বিয়ে আর কেমন হবে। আর গ্রামের বিয়ে মানেই যৌতুক। কিভাবে যৌতুক ছাড়া বিয়ে দেবে তা নিয়ে বাবা মায়ের ছিল আকাশ প্রমাণ চিন্তা, মেয়ে যেন তাদের মাথার বোঝা হয়ে উঠেছিল। এমনিতে অজো পাড়াগাঁ এখানে মেয়েদের ষোল পার হওয়ার আগেই সব বিয়ে হয়ে যায়, আর তার তখন চলছে আঠারো। চারিদিকে বাবা মা যাকে পায় তাকেই মেয়ের বিয়ের কথা বলে।

শেষ পর্যন্ত এক সময় তার বিয়ে ঠিক হয় শ্যামল নামক একটি লোকটি আধ বুড়ো লোকের সাথে। তার আগের বৌ বাচ্চা হতে গিয়ে মারা গিয়েছিল, বাচ্চাটিও মারা গিয়েছিল। এরপর নানা কারণে তার আর বিয়ে করা হয় হয়ে ওঠেনি। এদিকে শ্যামলেরও বয়স হয়ে গিয়েছিল। অথচ বাড়ির কাজ করার জন্য তার পত্নী নামক এক দাসীর প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল।

গ্রাম্য ঘটকের ঘটকালিতে তাই সেই আধ বুড়োটার সাথে এক শুভ দিন দেখে বিয়ে হয়ে গেল। যৌতুক ছাড়া বিয়ে, তার উপর বৌ ছাড়া অনেক দিন কাটিয়েছিল লোকটা। বাসর রাতে যেন পাগল হয়ে গিয়েছিল কচি শরীর পেয়ে। বাসরের মাধুর্যের বদলে সোহাগীর ভাগ্যে জুটেছিল স্রেফ ধর্ষণের নির্মমতা। সে যে কি নির্মম এক দুঃস্বপ্ন তা কেও কল্পনাও করতে পারে না, সোহাগী তো পারে নি ই। দু মুঠো ভাও জুটত সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রমের পরে, আর রাতের বেলা পৈশাচিক নির্মমতায় শারীরিক সম্ভোগ। স্বামীর সোহাগ আদর বলতে যে কিছু আছে জীবনে তার কোন স্বাদ সোহাগী পায় নি। হয়েছে প্রতিরাতে ধর্ষণের স্বীকার। মেনে নিয়েছিল জীবন। হয়তো এটাই বিবাহিত জীবন। কি জানি আগে তো আর বিয়ে করে নি সুতরাং স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসা কি জিনিস তা তার জানা ছিল না। একেই বুঝি স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসা বলে, মনে মনে এভাবেই নিজেকে সান্ত্বনা দিত সোহাগী। সে বুঝে গিয়েছিল যৌতুক হীন এই বিয়ে বুড়োটা করেছিল তাকে দিনের বেলায় দাসীর কাজ করার জন্য আর রাতের কাম-রিপু চরিতার্থ করতে।

এভাবেই ছয় মাসের সংসার চলছিল। তারপর তার স্বামীর মহাজনের সাথে কোন এক এক চর দখলের মারামারিতে গিয়ে দাঁয়ের কোপে প্রাণ হারালো বেচারা আধ বুড়ো। সোহাগী হল বিধবা। দেবর ভাশুররা মিলে বের করে দিল স্বামী ভিটা থেকে অপয়া অপবাদ দিয়ে। গঞ্জনার কোন শেষ ছিল না সেই দিনগুলোতে।

আবার সেই বাবা মায়ের কাছে ফিরে আসা। এবারের আসা যেন অন্যরকম আসা। প্রতি পদে পদে গঞ্জনার স্বীকার। বাবা মা, আত্নীয় স্বজন এর কাছ থেকে। অপয়া মেয়েমানুষ স্বামীকে খেয়ে এবার এ-বাড়িতে কি অপয়া ছায়া নিয়ে এসেছে কে জানে।

এদিকে গ্রামের বখাটে যুবক গুলোর নজর সদ্য বিধবার দিকে, যেন বারোয়ারী সম্পত্তি। কোথাও পথ দিয়ে হেঁটে গেলে চেয়ে থাকত কিছু লোভী দৃষ্টি, কটূক্তি আর নানাবিধ শারীরিক কামনার আমন্ত্রণ তো নিত্য সঙ্গী।

এক এক বার তার ইচ্ছে করত ইঁদুর মারার বিষ খেয়ে জীবনের ইতি টানতে গঞ্জনা আর অপমান সইতে না পেরে।

তারপর আবার গ্রাম্য ঘটক এই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এলো বাবার কাছে। পাগল একটা ছেলেকে বিয়ে করতে হবে। গ্রামের বিত্তশালী চৌধুরী সাহেবের পাগল ছেলের জন্য পাত্রী খোঁজা হচ্ছিল অনেক দিন ধরেই। চৌধুরী সাহেব ইন্তেকাল করেছেন অনেক আগেই, এখন চৌধুরী মাতারও বয়স হয়েছে, যে কোন সময় তারও ডাক চলে আসতে পারে। কে দেখবে তার এই পাগল ছেলেকে? এই চিন্তায় তার নাওয়া খাওয়া হারাম হয়ে গেছে অনেক দিন থেকে। চারিদিকে ঘটক লাগিয়ে রেখেছেন উনি তার ছেলের জন্য একটি পাত্রী খুঁজে বের করতে। ঢেরা পিটিয়েও চারিদিক খুঁজে একটি ভালো ঘরের কুমারী মেয়ে পেলেন না উনি। শেষ পর্যন্ত ঘটককে বললেন ভালো খারাপ, যেন তেন একটি বৌ হলেই তার চলবে। শুধু মেয়েটি যেন তার ছেলের দায়িত্ব নিতে পারে।

এই ঘটকই সোহাগীর আগের বিয়ে দিয়েছিল। এবং সোহাগীর বর্তমান অবস্থান তার জানা ছিল। কোথাও পাত্রী খুঁজে না পেয়ে চৌধুরী মাতাকে সোহাগীর কথা খুলে বলতেই প্রথমে চৌধুরী মাতা তো রেগেই আগুন। পারলে মেরেই ঘটককে বাড়ি থেকে বিদায় করে দেন। ঘটক সাহেব অনেক করে মাতা কে বোঝালেন মা – আপনার ছেলেকে দশ গ্রামে সবাই পাগল বলেই জানে। আর জানেন-ইতো কোন বাবা মা ই জেনে শুনে তার মেয়েকে পাগলের হাতে তুলে দেবেন না। মা বুঝতে পারেন। বলেন চিন্তা করে দেখবেন।

সারারাত জেগে চৌধুরী মাতা চিন্তা করেন, পরদিন ঘটককে বলেন মেয়েটিকে তিনি দেখবেন তার সাথে আগে কথা বলবেন পরে অন্য কথা। তবে এ কথা যেন প্রস্তাব আকারে না যায়, এমনিই কোন এক ছল করে ওই মেয়েকে যেন এই বাড়িতে নিয়ে আসে।

সোহাগীর অবস্থা তখন খুবই খারাপ, মাথা খারাপের মত দিন কাটাচ্ছে বাসার গঞ্জনা খেয়ে আর বখাটে ছেলেদের টিপ্পনী আর লালসার চোখের ঘায়ে। ঘটক সোহাগীর সাথে দেখা করে তাকে চৌধুরী বাড়িতে একটি কাজ দেবে বলে চৌধুরী মাতার সাথে দেখা করার ছলে তাকে এ বাড়ি নিয়ে আসল।

চৌধুরী মাতার অভিজ্ঞ চোখ তাকে ভালো করে পরখ করল, তার সাথে অনেক কথা বলল, তার অতীতের কথা জানলো, বর্তমানের দুঃসহ জীবন সম্পর্কে জানা হলো। কেন জানি মেয়েটিকে তার ভালো লেগে গেল। গ্রামের মেয়ে হিসাবে পড়াশুনাও করেছি মেট্রিক অবধি, পোড় খাওয়া মেয়ে। তা ছাড়া চেহারা সুরতে সোহাগীর সব সময়ই একটু চটক ছিল।

তাকে কাজ দেবে বলে চৌধুরী মাতা পরে যোগাযোগ করবেন বলে বিদায় দিলেন। এর পর ঘটককে পাঠানো হল তার বাবাকে ধরে আনার জন্য। বাবা আসলে তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়া হল তার বিধবা মেয়ের জন্য।

পাগল ছেলের সাথে বিয়ে? আমার মেয়ে কি বিধবা হয়েছে দেখে জলে ভেসে গেছে?
না এ কক্ষনো হতে পারে না। বলে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।

চৌধুরী মাতা ঘটককে লাগিয়ে রাখলেন, সোহাগীর পরিবারের আর্থিক অবস্থার কথা ওনার জানা ছিল, তাই এবার লোভের ফাঁদে ফেলতে বললেন।

ঘটক আস্তে আস্তে সোহাগীর বাবার সাথে কথা বলে তাকে বোঝাতে লাগল, তোমার বিধবা মেয়েকে কে বিয়ে করবে? সারা জীবন কি বসে বসে খাওয়াবা? তোমারও তো এখন বয়স হয়েছে, কামলাগিরি আর কয়দিন করতে পারবা। তার থেকে চৌধুরী-মাতার প্রস্তাবে রাজী হয়ে যাও আমি তোমাকে উল্টো যৌতুক পাইয়ে দিব। তোমার যাতে পরবর্তী জীবনে আর চিন্তা করতে না হয়।

লোভের ফাঁদে পা দিল সোহাগীর বাবা। আর তারই ফলশ্রুতি আজকের এই বিয়ে।

ওদিকে শুভ্রর মা চৌধুরানী চিন্তা করছেন তার ছেলে শুভ্রর কথা। শুভ্রর ছেলে বেলা তার কৈশোর, যৌবন থেকে নিয়ে আজকের বিয়ে।

অল্প বয়সেই বিধবা হয়েছিলেন শুভ্রর মা। চৌধুরী সাহেব অঢেল টাকা পয়সার মালিক ছিলেন পৈত্রিক সূত্রে, যার ফলশ্রুতিতে উসৃংখল জীবন যাপন। যা কাল হয়ে দেখা দিয়েছিল অল্প বয়সেই। অতিরিক্ত মদ্যপানে লিভার নষ্ট হয়ে মারা জান তিনি। শুভ্রর বয়স তখন মাত্র ৫মাস। সেই থেকে আজ পর্যন্ত শুভ্রকে একাই মানুষ করেছেন।

শুভ্র – ফুটফুটে এক পুত্র শিশুর জন্ম হয়েছিল চৌধুরী পরিবারে। চারিদিকে খুশির বান ডেকে গিয়েছিল যেন। গ্রামের নামকরা ধাই চৌধুরী সাহেবকে পুত্র হওয়ার সংবাদ দেন, চৌধুরী সাহেব তাকে সোনার মোহর দিয়ে পুরস্কৃত করেন। চৌধুরী মাতার তখনো নেতিয়ে আছেন প্রসব বেদনার পরবর্তী আবেশে। পুত্র জন্মের সময় একটু সমস্যা হয়েছিল, যা ধাই ছাড়া আর কেও জানত না। জন্মের সময় পুত্রের মাথায় একটু হালকা চোট লেগেছিল যা ধাই চেপে গিয়েছিল সেদিন।

ফুলের মত ফুটফুটে শিশুর চেহারা দেখে চৌধুরী সাহেব নাম রাখেন শুভ্র, যেন শুভ্রতায় ভরে উঠেছে তার ঘর।
আস্তে আস্তে শুভ্র বড় হতে থাকে, কিন্তু যেন স্বাভাবিক আচরণগুলো তার মাঝে অনুপস্থিত। কেমন কেমন যেন। ঠিক মত কথার সাড়া দেয় না, কোন কিছু বোঝে না। শুধু খিদা লাগলে বাড়ি মাথায় উঠিয়ে ফেলে। এ ছাড়া যেন আর বাকি সময় এই বাড়িতে কোন শিশুর সাড়াশব্দ অনুপস্থিত। কোন কাঁদাকাটি নাই, কোন চাহিদা নাই, কোন কথা নাই, শুধু খিদার সময় আকাশ ফাটানো চিৎকার।

জন্মের প্রায় পাঁচ মাস হয়ে গেছে এখন পর্যন্ত শুভ্রের মুখে একটি কথাও ফোটে নি, ঠিক মত হাতা পা নেড়ে এই বয়সের শিশুরা যেমন মায়ের সাথে দুষ্টুমি করে তা যেন এই শিশুটির মধ্যে অনুপস্থিত। মায়ের মনে কেমন জানি দুশ্চিন্তা কাজ করে। ছেলে কেন এখনো হাত বাড়িয়ে দেয় না কোলে ওঠার জন্য, ডাকলে সাড়া দেয় না। কেমন যেন সারাদিন চেয়ে থাকে ঘরের ছাঁদের দিকে। আর মাঝে মাঝে খিদা লাগলেই বোঝা যায় বাড়িতে কোন শিশুর উপস্থিতি।

এদিকে নতুন বংশধরের আগমনে যেন চৌধুরী সাহেবের মনে নতুন আনন্দ, নতুন করে খুশির আমেজে আরো বেশি করে মদ্যপান, আরো উসৃংখল জীবন যাপন। ফলশ্রুতিতে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই পড়ে যান বিছানায়। হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়, সেই যে গেলেন আর ফিরলেন না সুস্থ হয়ে। বাসায় ফিরলেন লাশ হয়ে। ওনার লিভার পুরোটা খেয়ে ফেলেছিল মদে। সেই থেকে চৌধুরী মাতা বিধবা, একা একা সামলে চলেছেন চৌধুরী বাড়ির সকল বিশাল কর্মকাণ্ড। তার সাথে সাথে শুভ্রকে।

শুভ্র বড় হতে থাকে, এক বছর বয়সেও তার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হয় না। একটু জানি কেমন কেমন অসংলগ্ন ব্যবহার ছোট বাচ্চার। চৌধুরী মাতা চিন্তিত, বড় বড় ডাক্তার দেখানো শুরু করলেন। ডাক্তাররা আশ্বাস দিয়ে গেলেন যে অনেক শিশুর মুখে কথা ফোটে দেরিতে। কিন্তু সেই দেরি আর কত? এ ডাক্তার সে ডাক্তার এ পরীক্ষা সে পরীক্ষার পর বের হল শুভ্রর মাথায় জন্মের সময় ছোট এক আঘাত লেগেছিল আর তার ফলশ্রুতিতে তার আজকের এই দশা। এই ছেলেটি আর দশটা স্বাভাবিক ছেলের মত নয়। এ সম্পূর্ণ আলাদা একটা মানুষ – ডাক্তারি ভাষায় অটিস্টিক বেবি, মানসিক প্রতিবন্ধী একটি শিশু। যার আরেক নাম অর্ধ মানব কিংবা গ্রাম্য ভাষায় পাগল। চৌধুরী মাতা মনের দুঃখে নিয়তিকে মেনে নেন। ডাক্তার উপদেশ দিলেন একে খুব সতর্কতার সাথে মানুষ করতে হবে। সেই থেকে চৌধুরী মাতা তার সন্তানকে অন্য ভাবে মানুষ করা শুরু করেছেন, আজ অবধি করে যাচ্ছেন।

ধীরে ধীরে শুভ্র বড় হয়, মুখে প্রথম কথা ফোটে প্রায় ৫ বছর বয়সে, তাও আধো আধো দু একটি শব্দ। মা...

প্রথম যেদিন মা শব্দটি শুভ্রর মুখে শোনেন তা যেন আজো চৌধুরী মাতার কানে লেগে আছে। তারপর থেকে একটি দুটি শব্দ, শুভ্র পুরো একটি বাক্য বলে সাত বছর বয়সে। তার পর থেকে এটা কি ওটা কি, এটা কেন ওটা কেন সব প্রশ্ন মায়ের কাছে। কিন্তু অন্য কাওকে সহ্য করতে পারে না শুভ্র।

ধীরে ধীরে বয়স বাড়ে, গ্রামের অন্যান্য আর দশটা ছেলের সাথে মিশতে পারে না, কারো সাথে খেলতে পারে না, মিশতে পারে না। কেমন যেন আড়ষ্ট হয়ে থাকে। সে ভালো করে কথা বলতে পারে না, ভাঙ্গা ভাঙ্গা আধো আধো কথায় বরং সমবয়সীরা তার সাথে আরো মজা করে, তাকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করে, এমন কি গায়ের এখানে ওখানে খোঁচা দিয়েও তাকে যন্ত্রনা করে। গ্রামের ছেলে মেয়ে বড় ছোট এর মধ্যে জেনে গেছে চৌধুরী বাড়ির বংশধর একটা পাগল। চৌধুরী মাতা অনেক চেষ্টা করেছিলেন সমবয়সী আর দশটা বালকের সাথে শুভ্র যাতে খেলতে যায়, যাতে একটু স্বাভাবিক হয়। কিন্তু ওনার কোন চেষ্টাই কাজে লাগে নি। শিশুরা বোধহয় প্রকৃতিতেই একটু নিষ্ঠুর হয়ে থাকে। তার শুভ্রকে কোন ভাবেই নিজেদের করে নেয় নি। বরং পাগল পাগল করে খেপাত আর তাতে শুভ্রর মনে মনে ভয় ভীতি আর মানুষের প্রতি বিতৃষ্ণা বেড়ে গেল আরো বেশি।

চৌধুরানীর চেষ্টায় টাকার জোরে তাকে স্থানীয় স্কুলে ভর্তি করা হল। যদি ক্লাসের আর দশটা ছেলের সাথে মিশে অবস্থার কিছু উন্নতি হয়। উন্নতি তো দূরের কথা আরো অবনতি হল। স্কুলের সবাই মিলে যেন আজব এক চিড়িয়া কোন ভিন দেশ থেকে এসেছে এভাবে শুভ্রকে দেখতে লাগল, তাকে নানাভাবে যন্ত্রণা করতে লাগল। শেষ পর্যন্ত স্কুল ছাড়তে বাধ্য হল শুভ্র। একাডেমিক লেখাপড়া তার আর হয়ে উঠল না। চৌধুরী মাতা তার জন্য বাসায় এক বয়স্ক শিক্ষক ঠিক করে দিলেন যাতে শুভ্র অন্তত কিছুটা লেখা পড়া শিখতে পারে। লাভ হল না। তার মাথায় পড়াশুনা ঢুকে না। সে বুঝতে পারে না, কিছু মনে রাখতে পারে না। অনেক বছর এক নাগারে চেষ্টা চলল তারপর পড়াশুনা পর্বেরও সমাপ্তি।

আজো শুভ্রর ছেলেবেলায় সে গ্রামের আবাল বৃদ্ধ বণিতা সকলের কাছ থেকে যে ব্যবহার পেয়ে এসেছে তা মনে পড়লে চৌধুরী মাতার চোখ ভেসে ওঠে নোনা জলে। একটি মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুকে মানুষ করার যে কি কষ্ট কি যন্ত্রণা তা মা ছাড়া আর কেও বোঝে না। আজ অনেক দিন পর তিনি নিজের ঘরে একা ঘুমাচ্ছেন। তার শুভ্রের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছেন সোহাগীর উপর। চৌধুরানীর কেন জানি মন বলছে এই মেয়েটি তার শুভ্রকে বুঝতে পারবে, আর কোন না কোন সময় নিজের করে নেবে। সেই সুদিনের আশায় স্বপ্ন দেখতে দেখতে আজ অনেক দিন পর ওনার চোখে ঘুম নেমে আসল। শান্তির ঘুম।

পরদিন খুব সকালে ঘুম ভেঙ্গে গেল সোহাগীর, এমনিই গ্রামের মেয়ে সকালে ওঠা অভ্যাস। ঘুম ভেঙ্গেই তার মনে পড়লো গত রাতের কথা, তার বাসর রাতের কথা। পাশে তাকিয়ে দেখলো শুভ্র একদম বাচ্চা ছেলের মত তার শাড়ির আঁচল মুঠো করে ধরে ঘুমাচ্ছে। যেন আঁচল ছেড়ে দিলেই সে সোহাগীকে হারিয়ে ফেলবে। মায়ায় ভরে উঠলো সোহাগীর মন; চোখ ভিজে উঠল অকারণেই।

আস্তে আস্তে পাশ ফিরে শুভ্রর মুঠো থেকে তার আঁচল সরালো, উঠে ফ্রেশ হল। তারপর তাকে ঘুম থেকে না তুলে দরজা খুলে ধীরে ধীরে তার শাশুড়ির ঘরে টোকা দিল। সকালে ঘুম থেকে উঠে শুভ্র কি করে তা তার জানা নাই, তবে সে বুঝতে পারছে আর দশটা মানুষের মত তার স্বামী নয়, তাকে খুব সাবধানে নাড়াচাড়া করতে পারে। যাতে করে সোহাগী সম্পর্কে কোন ভুল ধারণা প্রথম থেকেই সৃষ্টি না হয়। শাশুড়ি ঘুম চোখে দরজা খুললেন। বৌমা কে দেখে একটু চমকে উঠলেন, জিজ্ঞাস্য দৃষ্টিতে তাকাতেই সোহাগী বলল, ওনার ছেলে ঘুমাচ্ছে আর ঘুম থেকে উঠে কি করে তা তার জানা নেই, সুতরাং মায়ের কাছে এসেছে জিজ্ঞাসা করতে। চৌধুরানী মনে মনে খুশি হলেন। জিজ্ঞাসা করলেন কালকে কি শুভ্র কোন যন্ত্রণা করেছে কি না কিংবা তার ব্যবহারে কি অন্য কিছু প্রকাশ পেয়েছে কি না।

না মা , উনি শোয়ার সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়েছেন।

মা, নতুন বৌকে ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে শুভ্রর সারাদিনের রেগুলার রুটিন বুঝিয়ে দিলেন। ওর সাথে কিভাবে ব্যবহার করতে হবে, সে কি পছন্দ করে কি অপছন্দ করে ইত্যাদি নিয়ে অনেক কথা বললেন। আরো বললেন, দেখো বৌ মা আমার এ ছেলেটি এখনো মনে মনে শিশু। মানসিক ভাবে তার বয়স বাড়ে নাই, অনেক কিছু নিয়ে বাচ্চাদের মত জিদ করে অনেক সময় অভিমান করে তবে কখনো ভায়োলেন্ট হয় না। তুমি যদি তার সাথে বন্ধুর মত আচরণ করে তাকে নিজের করে নিতে পার তবে সেটাই হবে আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া। আর এই উদ্দেশ্যেই তোমাকে আমি এই বাড়ির বৌ করে নিয়ে এসেছি।

সোহাগী বলল, ঠিক আছে মা আমি কথা দিচ্ছি আপনার ছেলেকে আপনি যেভাবে মানুষ করেছেন আমিও ঠিক বন্ধুর মতই আচরণ করে তার মন জয় করব। তাকে নিজের করে নেব। আচ্ছা এখন আমি যাই, ওনাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে তার নাস্তার ব্যবস্থা করি।

চৌধুরানী চোখে আবার আশার আলো ফুটে উঠল, এই মেয়ের মধ্যে কি যেন দেখলেন তার ব্যবহারে, তার চোখে মুখে। মনে মনে আল্লাহ্‌র কাছে প্রার্থনা করলেন হে পরম করুণাময় তুমি এই মেয়েটিকে উছিলা করে আমার কাছে পাঠিয়েছ আমার ছেলের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য। এই মেয়ে যেন তা ঠিক মত করতে পারে তুমি তার তওফিক দান কর।


এই যে খোকা বাবু ঘুম থেকে উঠেন, অনেক বেলা হয়ে গেছে। সোহাগী শুভ্রর মাথার কাছে বসে আস্তে আস্তে মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে ডাকতে লাগল। শুভ্র ঘুম ঘুম চোখে পিটপিট করে চোখ মেলে। কে ডাকছে ঠিকমত বুঝতে পারে না, স্বাভাবিক নিয়মেই প্রতিদিনের মত সকালে মা ঘুম থেকে ওঠার জন্য ডাকছে মনে করে সোহাগীর হাত জড়িয়ে ধরে ঘুমের ঘোরেই বলল, আলেকটু ঘুমাই না মা! একটু পলে উটি? মাতলো তো তকাল হল। এখনো তো সুযযিমামা ওটে নি। চশমা নেই তার চোখে তাই সব ঘোলা ঘোলা দেখছে আর সোহাগী কে মা মনে করেছে।

না খোকা বাবু উঠেন এখন, অনেক বেলা হয়ে গেছে, আর সূর্য এখন মাথার অনেক উপরে উঠে গেছে।

না মা, আলেকতু ঘুমাব বলে সোহাগীর হাত আরো জোরে জড়িয়ে ধরল।

সোহাগীর সমস্ত শরিরে কি জানি এক শিহরণ বয়ে গেল। আগের স্বামীর ছোঁয়ায় কখনো এমনটি হয় নি। তার আগের স্বামী এভাবে কখনো কথাও বলে নি তার সাথে। দাসী বাদীর মত ব্যবহার পেয়েই সে অভ্যস্ত। সোহাগী একহাতে শুভ্রর চোখে চশমা পড়িয়ে দিয়ে বলল, আমি তোমার মা নই খোকাবাবু, ভালো করে তাকিয়ে দেখ, চশমা ছাড়াতো তুমি কিছুই দেখ না মনে হয়। দিনের আলোকে বলছ এখনো অন্ধকার, আর আমাকে ডাকছ মা। বৌ কে কি কেও মা ডাকে?

চশমা চোখে দিয়ে শুভ্র যেন একটু হতভম্ব হয়ে যায়। কালকের কথা হাঠাত করে সব কিছু মনে করতে পারে না, সামনে বসা মেয়েটি অচেনা একটি মেয়ে, তাকে কেন ঘুম থেকে ডেকে তুলছে, কেন খোকাবাবু বলছে মার মতন করে কিছুই না বুঝে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। ঝটকা মেরে হাত সরিয়ে নিয়ে তোতলাতে শুরু করে......... এই......এই... মেয়ে তুমি কে? আমাল ঘলে কি কচছ? উম... মা কোথায়?


সোহাগী বলে তোমার কিছু মনে নেই? কাল না আমাদের বিয়ে হলো? আমি তোমার নতুন বৌ, তুমি আমার স্বামী।

আর এখন থেকে আমরা বন্ধু, তোমার মা তোমার জন্য যা যা করত আমি এখন থেকে সে ই সব কিছু তোমার জন্য করব, বরং তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু করব। সব সময় তোমার সাথে ছায়ার মত লেগে থাকব। আমরা দুজনে মিলে সারাদিন গল্প করব, খেলব, তোমাকে গান শোনাব আরো কত কিছু।

শুভ্র বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকে, উম...ম...তত্যি?

তুমি তত্যি...আমাল বন্দু অবে? ......তুমি আমাল সাথে...উম... উম... তব তময় থাকবে?......... তুমি আমাল থাতে খেলবে?

হ্যাঁ গো সত্যি সত্যি।

কি জানি???......জানো? ...... আমাল না একটাও বন্দু নাই, মা ছাড়া আল কেও কেও আমাল তাথে খেলে না।... বালিল আল নাআআআআ তবাই আমাকে বয় কলে, উম...ম... আমাল তেকে দূলে দূলে তাকে।

অনেক্ষণ এক নাগারে আধো আধো বুলিতে কথা বলে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তবুও যেন তার মনে আরো কথা আছে আরো কিছু বলতে চায়।

সোহাগী বুঝে তার কষ্ট, বলে থাক আর বলতে হবে না এখন। আবার পড়ে শুনব না হয় বাকিটা?

নাআআআআআআ... আমি এক্কুনি বলব............

আচ্ছা বল বাবু।

উম... ম...আল জানো? গ্লামের তব দুট্টু তেলেরা আমি ... আমি... বাতা তেকে...বেল হলেই না............আমাকে কি কি জানি............তব বলে... আল কেমন কেমন তব কতা বলে। উম......ম... আমি না টিক বুদি না তাদেল কতা। উম......... ম......থুদু বুদি... তালা আমাকে পতন্দ কলে না............... আল আমাল তাথে না??????? কেও মিততে তায় না। উম.........ম......তুমি তত্যি তত্যি আমাল থাতে থাকবে??????? উম......ম......আমাল বন্দু অবে?


হ্যাঁ গো খোকাবাবু, বললাম তো আমি এখন থেকে তোমার শুধু বন্ধু না তোমার বৌ ও।

উম......ম ... তা ... বৌ কাকে বলে?

তাও বুঝি জান না?

উহু......না তো, দানি না তো।

কাল রাতে কি হয়েছিল তোমার মনে নাই? তোমাদের বাসায় যে অনুষ্টান হয়েছিল একটা?

এএ এ এ এ এ এ মনে আতে। অনেক না অনেক অনেক মানুত এত্তিলো, বালো বালো তব উম... খাওয়া উম...দাওয়া কলে তবাই তলে গেছে। আল মৌলভী হুজুর না , হুজুর না...............কি জানি বলতিল আমাকে বলতে, কি জানি একটা কতা?????????? ভুলে গেতি।

কি বলেছিল, আলহামদুলিল্লাহ কবুল?

লাফিয়ে উঠল শুভ্র – হুম হুম ............... এই তো মনে পলেছে, তুমি জানলা কেমন কলে?

উম......... আমাকে না!!! তিন না চালবার জানি একই কতা বলতে বলেতিল। আর আর ...... আর ......আমি না? আমি না চাচ্চুর সাতে সাতে বলে চিলাম অই কতাগুলো।

হুম, আমি জানি, ঐটাই হল গিয়ে বিয়ে। তুমি কবুল বলে আমাকে বিয়ে করেছ। আর তাই আমি এখন থেকে তোমার বৌ।

আত্তা থিক আচে...... উম......... কিন্তু...... বৌ হলে কি অয়?

তুমি জান না কিছু?

উহু হ ......না তো ! কিত্তু জানি না............।

তোমার চাচী তোমার চাচ্চুর কি হয়? তোমার মা তোমার বাবার কি হয়?

ও এবাল বুঝেছি।

আচ্ছা অনেক বুঝেছ, এখন ওঠো, যাও ঠিকমত ব্রাশ করে বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসো, আমি তোমার নাস্তার ব্যবস্থা করছি।

আত্তা..................

নাস্তার টেবিলে চৌধুরানী খুব ভালো করে খেয়াল করছিলেন। শুভ্র এসে বসার পর থেকে সোহাগীর তার প্লেট এ নাস্তা বেড়ে দেওয়া থেকে খাওয়া শেষ হওয়ার পর পর্যন্ত প্রতিটি স্টেপ ফলো করছিলেন, নিজে নাস্তা করার ফাঁকে ফাঁকে। সোহাগীর নিজের খাওয়া বাদ দিয়ে আগে শুভ্রর খাওয়ার তদারকি দেখে সন্তুস্ট হলেন।

মা রান্না বান্না কিছু করতে হবে? সোহাগী জিজ্ঞাসা করল চৌধুরানীকে।

না বৌমা তোমাকে কিছুই করতে হবে না, তুমি শুভ্রর সাথে সময় কাটাও, ওদিকটা নিয়ে তোমাকে কখনোই চিন্তা করতে হবে না এ বাড়িতে, রান্নার আলাদা লোক আছে, বাজারের আলাদা লোক, আপাতত তুমি শুধু শুভ্রকে নিয়েই থাক। ওর সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলো।


আচ্ছা মা বলে শুভ্রকে নিয়ে বাগানে ঘুরতে গেল।

সারা দিন তাদের কেটে গেল বন্ধুর মত আচরণে, দুপুরে গোসল করানো, তার দুপুরের লাঞ্চ খাবার সময় ছাড়া বাকি সময়টা সে শুভ্রর সাথে গল্প করে কাটিয়েছে। নানা কথা নানা গল্পে মশগুল দুজনে। যেন নতুন করে চেনাচ্ছে শুভ্রকে সবকিছু। শুভ্র অনেকটা সহজ হয়ে এসেছে, সারাদিনে দু একবার ছাড়া মায়ের কথা খুব একটা মনে পড়ে নি, মায়ের অভাব বোধ করে নি কালকের মত করেও। সোহাগী ছিল সারাদিন তার ছায়াসংগি হয়ে। সারাদিন তার আধো আধো কথা শুনে গেছে, তার সব কথার উত্তর দিয়ে গেছে ধৈর্য সহকারে, একটুও বিরক্ত না হয়ে।

এটা কি, ওটা কি, এটা কেন, ওটা কেন? এটা করলে কি হয়, ওটা করা নিষেধ কেন ইত্যাদি সব ছেলেমানুষি প্রশ্নের জবাব হাসিমুখে দিয়ে গেছে সোহাগী সারাদিন ভরে।

ধীরে ধীরে দিন গড়িয়ে সপ্তাহ পাড় হয়ে গেল, এখন শুভ্র যেন সোহাগী ছাড়া আর কিছু বুঝে না, তার সারাদিনের খেলার সঙ্গী তার সমস্ত কথার সঙ্গী এখন সোহাগী। মার সাথেও আগের মত সেই আহ্লাদীপনা করা হয় না, এটা ওটার জন্য বায়না ধরা হয় না। সমস্ত বায়না এখন সোহাগীকে পূরণ করতে হয়। চৌধুরানী সব দেখছেন, সবকিছু খেয়াল করছেন। মনে মনে অনেক খুশি, যাক এবার তার মানসিক অসুস্থ ছেলেটাকে সত্যিকারের উপযুক্ত হাতে দিতে পেরে যেন অনেকটা নিশ্চিন্ত হলেন তিনি।

সোহাগী তার নিজের কথা, তার অতিতের কালো অধ্যায়ের কথা কিছুই বলে না শুভ্রকে, এখন তার শুভ্রর কথা শোনার সময়। শুভ্র সারাদিন বকে যায় এটা ওটা কত কি!

আধো আধো বোলে সে তার ছেলেবেলার কথা, তার স্কুলের কথা বলতে গিয়ে বাচ্চা ছেলের মত হাউমাউ করে কান্না করে ওঠে। তার স্কুলের সহপাঠিরা কিভাবে তাকে পাগল বলে ক্ষেপাতো, কিভাবে তাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করত। গ্রামের আর বাকি সমবয়সী ছেলেরা তার সাথে কেমন খারাপ ব্যবহার করত ধীরে ধীরে শুভ্র সব কথা বলে যায় সোহাগীকে, যখনি যে কথাটাই তার মনের মাঝে ভেসে ওঠে। এমনকি তার আত্নীয় স্বজন কিংবা বড় বড় মানুষরাও তাকে পাগল বলে বকা দিত, তার সাথে খারাপ ব্যবহার করতে সেগুলোও একে একে তার মনে হয়ে যায় আর করুণ কন্ঠে সোহাগীকে তার বেদনার কথা বলে যায়। সোহাগী সব শুনে যায়, মাঝে মাঝে তার চোখ ভিজে আসে, মানুষের এহেন ব্যবহারের কথা ভেবে। সে তো পোড় খাওয়া মেয়ে সুতরাং সে জানে এখনকার মানুষগুলো কেমন হয়, কত নিষ্টুর ভাবে যে অন্যকে যাতনা দিতে পারে তার থেকে কে বেশি আর জানে।

পরম মমতায় সে শুভ্রর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেয়, বলে এখন থেকে তোমার আর কারো সাথে মেশার দরকার নেই। আমি আছি তোমার সাথে তোমার পাশাপাশি সব সময়।

ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে পরস্পর বোঝাবুঝি, একে অন্যের সান্নিধ্য ছাড়া যেন চলে না। দিন গড়ায়, সপ্তাহ গড়ায়। মানসিক বোঝাবুঝির পালা শেষ। এখন সোহাগী তার মনের ভেতর থেকে কি যেন এক শুন্য অনুভুতির উপস্থিতি টের পায়। হাজার হোক সে বিধবা, দৈহিক মিলনের স্বাদ সে পেয়ে এসেছে, সে না হয় হোক ধর্ষণের নামে, কিন্তু শারীরিক ভালোবাসা তো? স্বামী হারা অনেক দিন, একবার যে বাঘ রক্তের স্বাদ পেয়েছে তার কাছে আর সব কিছু কেমন আলুনী লাগে। সোহাগীরও মনের মাঝে হঠাত হঠাত কামনার আগুন মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। কিন্তু বুঝতে পারে না কিভাবে এগোবে এই মানসিক শিশুর সাথে যদিও শরিরের দিক দিয়ে পরিপূর্ণ যুবক। তবে একটা অনেক বড় উন্নতি এর মাঝে হয়েছে, এখন শুভ্র কথা বলতে বলতে ধীরে ধীরে তার কথার জড়তা যেন একটু একটু করে কেটে যাচ্ছে। একটু না বরং কানে লাগার মতই বেশ উন্নতি তার কথায়। আগের মত কথা আর তত বাজে না এখন। সোহাগীর সাথে ক্রমাগত কথা বলার এটা একটা ভালো দিক হতে পারে। মাঝে মাঝে একটু আধটু বাজলেও বা একটু তোতলামি করলেও সোহাগী শুদ্ধ করে দেয়। আর তাকে ভরসা দেয় যে তুমি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেছ এখন, তোমার কথা শুনে কেও আর তোমাকে এখন খেপাবে না। দু একটি কথা যা বাধো বাধো ঠেকে আমি কথা বলতে বলতে সব ঠিক করে দেব। এভাবেই ধীরে ধীরে শুভ্র যেন সুস্থতার দিকে এগিয়ে যায়, স্বাভাবিক মানুষের মত। কথার জড়তা কাটলেও কিন্তু মনে মনে ভেতর থেকে এখনো শুভ্র ঠিক আগের ছেলেমানুষই আছে। কোন পরিবর্তনই হয় নাই তার মানসিক বয়স বৃদ্ধির।

কিন্তু ওদিকে সোহাগীর ইদানিং যেন রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। রাতে ঘুমের ঘোরে শুভ্র যখন তার দেহের ওপর হাত রাখে কোন কিছু না ভেবেই অভ্যাসের বসে, তার শরিরে শিহরণ জেগে ওঠে। কামের বহ্নিশিখা জ্বলে ওঠে মনে। তবুও কেন জানি সাহস হয় না এ পথে এগোবার।

শেষ পর্যন্ত প্রায় মাস খানেক পার হওয়ার পরে সে মনে মনে ঠিক করে ফেলে যে শুভ্রকে সেক্স সম্পর্কে ধারণা দেওয়া উচিত। সে তার স্বামী সুতরাং স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কের মাঝে যেন কোথায় একটা শুন্যতা রয়ে গেছে, একটা বড় গ্যাপ অনেক বড় একটা প্রশ্ন হয়ে আছে – যার উত্তর বের করতে হবে সোহাগীকেই।

সোহাগী মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়, শুভ্রকে এবার স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে মধুর সেতুবন্ধনের যে আরো একটা দিক আছে শারীরিক ভালোবাসা সেটা আস্তে আস্তে তাকে শেখাবে।

সিদ্ধান্ত নেবার পরদিন থেকে সোহাগীর অস্থির মন, শুভ্রর সাথে একটু গাঢ় হয়ে বসা, তার হাত ধরে থাকা, তাকে ছুঁয়ে থাকা। দুপুরে ঘুমানোর সময় তাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমানো। নানা ভাবে চেষ্টা করতে থাকে, লক্ষ্য রাখে শুভ্রর মধ্যে কোন পরিবর্তন আসে কি না। নাহ, কিছুতেই কিছু হয় না, শিশুসুলভ যথারীতি আচরণই বহাল থাকে শুভ্রর। রাতের বেলা সোহাগী অস্থির হয়ে ওঠে।

খাওয়া দাওয়ার পর দুজনে শুতে যায়।

যথারীতি শুভ্র সোহাগীর হাত ধরে শুয়ে পড়ে, বলে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে। সোহাগী শুভ্রর হাত তার হাত থেকে সরিয়ে এনে শারি সরিয়ে তার পেটের ওপর রাখে। শুভ্রর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ওখানে কোন পরিবর্তন দেখা যায় না। এবার সোহাগী বুঝতে পারে এভাবে হবে না, তাকে কথা বলে বোঝাতে হবে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক।

শুভ্র।

হুম বল।

আজ আমার হাতের বদলে তোমার হাত আমার পেটে রেখেছি।

হুম তাই তো দেখতে পাচ্ছি।

তোমার কেমন লাগছে?

কি জানি বুঝতে পারছি না, তোমার পেট তো অনেক নরম!!

তোমার কি ভালো লাগছে না খারাপ লাগছে?

কি জানি বুঝতে পারছি না, ভালোই তো লাগছে মনে হয়।

এবার সোহাগী আরেকটু সাহসী হলো।

পেট থেকে তার হাত এনে সোহাগীর বুকের ওপর রাখল। দেখতো এখন কেমন লাগে?

কি জানি বুঝতে পারছি না।

আরে বোকা পেট বেশি নরম না বুকের ওপর বেশি নরম?

কিভাবে বুঝব?

দু জায়গায় হাত বুলিয়ে ভালো করে অনুভব করে দেখ না!!

শুভ্র দু জায়গায়ই হাত বুলোতে থাকে।

হুম তোমার বুক বেশি নরম।

কোথায় হাত রাখতে তোমার ভালো লাগছে?

কি জানি বুঝতে পারছি না, দু জায়গাতেই ভালো লাগছে তো!!

প্রতিদিন তো হাতে হাত রেখে ঘুমাও, সেটা থেকে এখন ভালো লাগছে না খারাপ লাগছে?

মনে হয় হাত থেকে এখানে হাত রাখলে বেশি ভালো লাগছে।

এখানে বলতে কোথায়? পেটে না বুকে?

উমম ম বুকে।

তা হলে তোমার যেখানে হাত রাখতে ভালো লাগে সেখানেই হাত রাখ।

আচ্ছা, ঠিক আছে বলে শুভ্র ঘুমিয়ে পড়ল।

সোহাগী কি এক যাতনায় সারা রাত নির্ঘুম কাটালো। ভাবছে সারারাত ধরে, নাহ এভাবে হবে না; আরো খোলামেলা হতে হবে। একবারে শুরু থেকে এই বাচ্চাকে শেখাতে হবে।

সারাদিন কেটে গেল রেগুলার রুটিন এর মধ্য দিয়ে।

পরদিন রাত।

ঘুমুবার সময় দুজন শুয়ে আছে।

শুভ্র!!

হুম বল।

কাল যে আমার বুকে হাত রেখে ঘুমিয়েছ তোমার কেমন লেগেছে?

হুম খুব ভালো লেগেছে।

আজ কি ওখানে হাত রেখে ঘুমুবে?

হুম ঘুমুব।

নাহ আজ তোমাকে ওখানে হাত রেখে ঘুমুতে দেব না।

কেন ?

ওখানে হাত রাখলে আমার খারাপ লাগে যে!

কেন খারাপ লাগে?

ও তুমি বুঝবে না।

কেন বুঝব না, আমাকে বুঝিয়ে দাও। বলে শুভ্র শোয়া থেকে উঠে বসল।

সোহাগী জানে কোন একটা বিষয় তার মাথায় ঢুকে গেলে সেটা জানার আগ পর্যন্ত সে প্রশ্ন করতেই থাকবে যতক্ষণ না সে তার মত করে বুঝে নেয়।

নাহ তোমাকে বোঝাব না এটা, তোমাকে আমি আগেও বলেছি তুমি এখন বড় হয়েছ অনেক কিছু তোমাকে নিজে নিজে বুঝতে শিখতে হবে, অনেক কিছুই তোমাকে জানতে হবে।

হুম বলেছ তো! তবে তুমি বা মা বুঝিয়ে না দিলে যে আমি কিছু বুঝতে পারি না।
তবে কি আমি মা’র কাছ থেকে জেনে আসব এখন – তোমার বুকে হাত রাখলে তোমার কেন কষ্ট হয়?

আরে পাগল নাকি তুমি?

কেন? আমি আবার কি করলাম? নিজে না বুঝলে কাওকে বোঝাতে হবে না? তুমি বলছ তুমি বোঝাবে না তাহলে মা ছাড়া আর কে আছে যে আমাকে বুঝিয়ে দেবে?
আরে বোকা সব কথা মা শেখায় না, নিজে নিজে কিছু শিখতে হয়।

আমি নিজে নিজে কিছু শিখতে পারি না। হয় আমাকে এক্ষুনি বল নাইলে আমি মার ঘরে গেলাম তাকে জিজ্ঞাসা করতে।

সোহাগী পড়ে যায় মহা ফাপড়ে। যা হয় দেখা যাক। আজ শুভ্রকে কিছু দীক্ষা দিতেই হবে, শারীরিক ভালোবাসার সম্পর্ক নিয়ে কিছু কিছু করে না বোঝালে সে কোনদিনই নিজে থেকে শিখবে না।

আচ্ছা বাবা ঘাট হয়েছে আমার, মা এর কাছ থেকে জানার দরকার নেই, আমিই তোমাকে সব বুঝাবো, সব শেখাবো।

এইতো আমার লক্ষী বৌ, এতদিন তুমি আমাকে কত কিছুই না শেখালে, এখন এমন করছ কেন? মনে হয় যেন লজ্জা পাচ্ছ!

হুম একটুতো পাচ্ছিই।

কেন?

এটা যে একটু লজ্জার কথা।

তাও বল, আমাকে শেখাও, তুমি না বললে আমি বুঝব কেমন করে?

আচ্ছা বাবা বলছি, আমার দিকে তাকাও।

দুজনে বসে ছিল মুখোমুখি।

শুভ্র সোহাগীর দিকে তাকিয়ে আছে।

আমাকে তোমার কেমন লাগে?

অনেক অনেক ভালো লাগে, অনেক আপন মনে হয়। যেন মা এর পর তুমিই আমার পুরো পৃথিবী জুড়ে আছ।

কেন ভালো লাগে বলতে পার?

তুমি যে আমার বন্ধু আর সব সময় আমার পাশে থাকো তাই।

আমার চেহারা তোমার ভালো লাগে না?

হুম তা তো লাগেই।

সোহাগী আজ লাল রঙ এর একটা শারী পড়ে ছিল, লাল ব্লাউজ গায়ে।

আচ্ছা বল তো আমি কি রঙ এর সাড়ি পড়েছি?

কেন লাল?

শাড়িতে আমাকে কেমন লাগছে?

সুন্দর লাগছে তো!

আচ্ছা এখন দেখতো কেমন লাগে? বলে শাড়ির আঁচল ফেলে দিল।

হুম এখনো সুন্দর লাগছে, আগের মতই?

আচ্ছা তুমি তো খালি গায়ে ঘুমুচ্ছ প্রতিদিন আমি শারী ব্লাউজ সব পড়ে শুই তোমার পাশে, তোমার কখনো জানতে ইচ্ছে করে না?

কি?

এই যে গরমের মধ্যে তুমি খালি গায়ে ঘুমাও আর আমি এত কিছু পড়ে ঘুমাই আমার গরম লাগে কি না?

কি জানি কখনো এটা তো মাথায় আসে নি, সত্যিতো তুমি কেন খালি গায়ে ঘুমাও না?

আজ আমি খালি গায়ে ঘুমুলে কেমন হয়?

তোমার গরম লাগলে খালি গায়ে ঘুমাও।

আচ্ছা, বলে সোহাগী তার ব্লাউজ খুলে ফেলে। শুধু ব্রা পড়া কোন মেয়ে কখনো শুভ্র দেখে নি, তাই জানে না ওটা কি কাপড় আবার।

এটা আবার কি? ব্লাউজের ভেতর ছোট ব্লাউজ? কয়টা ব্লাউজ পড় তুমি?

শুভ্র এটাকে ব্লাউজ বলে না, এটাকে বলে ব্রা। মেয়েদের এটা ব্লাউজের নীচে পড়তে হয়।

কেন পড়তে হয়?

সেটা না হয় আরেকদিন বুঝাব। আমি আজ তোমার মত খালি গায়ে শুই?

হুম, তা হলে তোমার ওই ছোট ব্লাউজটাও খুলে ফেল।

আচ্ছা, বলে সোহাগী তার গা থেকে ব্রা টাও খুলে নিল। যে কোন যুবকের প্রাণ হরণ করার মত যৌবন সোহাগীর। কিন্ত হায় কতদিন হয়ে গেল তার শরীরে হাত পড়ে নি কারো।

শুভ্র পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। সোহাগীর শরীর দেখে চেয়ে চেয়ে। মুখে কোন কথা নাই।

সোহাগী বুঝতে পারে না শুভ্রের মনের বা চোখের ভাষা, জিজ্ঞাসা করে – কি দেখছ শুভ্র?

শুভ্র একবার তার নিজের খোলা বুকের দিকে তাকায় আবার সোহাগীর বুকের দিকে তাকায়। দুটি বুক যে দেখতে দু রকম তা বুঝতে পারছে তবে কেন এ তারতম্য তা ধরতে পারছে না তাই অপলক তাকিয়ে আছে সোহাগীর বুকের দিকে।

তোমার বুক আমার বুকের থেকে আলাদা কেন?

কেমন আলাদা?

এই যে আমারটা ফ্লাট আর তোমারটা কত বড় বড় উঁচু উঁচু।

হাত দিয়ে ধরে দেখ শুভ্র।

শুভ্র হাত দিয়ে সোহাগীর বুক ধরে, মুঠো চেপে ধরে তার স্তনে। সোহাগীর সাড়া শরিরে কামনার আগুন ছড়িয়ে পড়ে।

তোমার বুক দুটো এত নরম কেন?

মেয়েদের বুক এমনই হয় শুভ্র, মেয়েদের শরীর ছেলেদের থেকে আলাদা। আমার বুক ধরে তোমার কেমন লাগছে?

খুব ভালো লাগছে।

আর কোন অনুভুতি হচ্ছে তোমার মাঝে?

হুম আরেকটি কি যেন এক অন্যরকম অনুভুতি হচ্ছে। আমার শরীর যেন কেমন গরম হয়ে যাচ্ছে। কি জানি এক অন্যরকম অনুভুতি তোমাকে বোঝাতে পারব না। আমার এমন লাগছে কেন বল তো বৌ? এ কেমন অনুভুতি তুমি আমাকে দিলে আমার শরীর যেন কিসে জ্বলে যাচ্ছে, আমার পাজামার ভেতরে যেন কেমন এক ভাষাহীন অস্থির অনুভুতি যা আগে কখনো হয় নি। কেমন জানি লাগছে আমার, তুমি আমার কি করলে বল না প্লিজ।

অমন করো না শুভ্র, বোঝাচ্ছি তোমাকে আস্তে আস্তে –

তারপর সোহাগী স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কের কথা বোঝায়, শারীরিক অনুভুতি, কাম বাসনা সবকিছুই বোঝাতে থাকে একে একে।

সোহাগীর আর শুভ্রর সত্যিকারের বাসর রাত নেমে আসে তাদের জীবনে।

এ সুখানুভুতি শুভ্রর অজানা ছিল এতদিন, সোহাগী যেন তাকে এক নতুন সুখের সাগরে ভাসিয়ে দিল।

সেই কত দিন থেকে কামের আগুনে জ্বলে জ্বলে শেষ হয়ে যাচ্ছিল সোহাগী, অথচ তার শিশু স্বামীর এ সম্পর্কে কোন ধারণাই ছিল না। কাম নামক সোনার হরিণ যেন সোহাগীর হাতের কাছে থেকেও অধরা ছিল, আজ এত দিনে মনে হয় তা ধরা দিলে কিংবা সোহাগী এত দিনে তার বাসনার সোনার হরিণের সন্ধান পেল। শারীরিক মিলনের মাঝেও যে আছে চরম আনন্দ তা যেন সোহাগীও এই প্রথম বারের মত বুঝতে পারল।

এইতো আমার সোনার হরিণ ধরতে আমি যাই
কাছে গিয়ে দেখি আমি সোনার হরিণ নাই
জন্ম থেকে ধরব বলে সোনার তীর ছুড়ি
শরবিদ্ধ সোনার হরিণ কোথায় গেল মরি
মানুষ হয়ে জন্ম আমার সোনার হরিণ চাই
কবরেতে গিয়ে বুঝি সোনার হরিণ নাই
হাত বাড়িয়ে চারিদিকে সোনার হরিণ খুঁজি
সোনার হরিণ বাস করে মনের ভেতর বুঝি।

অতৃপ্তির ডানা মেলা মানুষ যেন হতে চায় ইকারাস
অথচ তৃপ্তির ভেতরেই আছে সোনার হরিণের বসবাস।


তার পর থেকে প্রতিদিন প্রতিরাত যেন শুভ্র আর সোহাগী মিলে নিজেদের মাঝে নতুন নতুন রূপে আবিস্কার করতে লাগল। দিন পার হতে লাগল সুখের ভেলায় ভেসে, রাত কেটে যায় চোখের পলকে, দুজন দুজনার বাহুডোরে আবদ্ধ হয়ে।

অভিজ্ঞ চৌধুরানী বুঝতে পারেন সবই, তার অভিজ্ঞ চোখকে ফাঁকি দেয়া তো আর সম্ভব নয়। উনিও মনে মনে খুশি। যাক তার শিশু ছেলে এতদিনে পুরুষ হয়েছে। আশায় বুক বাঁধেন নতুন বংশধরের আগমনের। তার ছেলের বিয়ে হবে, চৌধুরী বাড়িতে নতুন বংশধর আসবে; এ ছিল চৌধুরীমাতার অনেক অনেক দিনের মনের খায়েশ। আল্লাহ্‌ বোধহয় মুখ তুলে চেয়েছেন, এবার হয়তো তার মনোবাসনা পূর্ণ হবে। নতুন অতিথির আগমনের সুখের সংবাদের আশায় পথ চেয়ে থাকেন তিনি।

দিন গড়ায়, মাস পাড় হয়।

প্রকৃতির নিয়মেই একসময় সোহাগী অন্তঃস্বত্তা হয়। খবর চাপা থাকে না, চৌধুরানির মনে খুশির ফোয়ারা ফোটে। খুশিতে কি করবেন না করবেন বুঝতে পারেন না, মিষ্টির নাহর বয়ে যায় চৌধুরী বাড়ি জুড়ে। শুভ্র এখন অনেকটা ভালো হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। ডাক্তার দেখানো হয় স্বামী স্ত্রী দুজনকেই। মহিলা ডাক্তার সব ঠিক আছে বলে সোহাগীকে নিয়ম মেনে চলতে উপদেশ দেন। আর শুভ্রর ডাক্তার শুভ্রর এই পরিবর্তনে হতভম্ব হয়ে যান, উনি ছোটবেলা থেকে শুভ্রর চিকিৎসা করে আসছেন আজ অবদি, শুভ্রর সব কথাই উনি জানেন। চৌধুরী মাতাকে বলেন এ যেন এক মিরাকেল – যে ছেলেটি ভালো করে কথাই বলতে পারত না বিয়ের আগে পর্যন্ত, আধো আধো কথায় মনের ভাব প্রকাশ করত আজ সেই ছেলেটি মমতা আর ভালোবাসার স্পর্শে এসে ভালো করে সুস্থ মানুষের মতন কথা বলছে, একটি পূর্ণ বাক্য গঠনে তার কোন জড়তা আসছে না – এ আল্লাহ্‌র অশেষ মেহেরবানী ছাড়া আর কি। এ সবই সম্ভব হয়েছে সোহাগীর জন্য, তার ভালোবাসার জন্য, শুভ্রর প্রতি তার সেবা শুশ্রূষার জন্য।






চৌধুরীমাতা মনের খুশিতে গ্রামে ফিরে আসেন দুজনকে সাথে করে। তার মনে খুশির বান ডেকে চলেছে।

আর ওপরদিকে শুভ্রর চাচীর মনে ঈর্ষার আগুন জ্বলে চলেছে – পাগল ছেলে যদি ভালো হয়ে যায়, তার যদি সন্তান হয় তা হলে চৌধুরী বাড়ির ভবিষ্যত তার ছেলের বদলে বড় জা চৌধুরানীর ছেলে তো বাড়ির কর্তৃত্ব নিয়ে নেবে। আর সোহাগীকে উনি দু চোখে দেখতে পারেন না এ কারণেই। যে মেয়ে স্নেহ মায়া মমতা আর ভালোবাসা দিয়ে তার ভাসুরের ছেলেকে ভালো করে দেয়ার পথে চলেছে সে যেন তার চোখের বিষ হয়ে উঠতে লাগল। আবার এখন নতুন সংবাদ – বড় চৌধুরীর ঘরে পরবর্তী বংশধরের আগমন। তার ঈর্ষার আগুনে যেন ঘি ঢেলে দিল। তার মনে অনেক আশা ছিল চৌধুরী মাতার ইন্তেকালের পড়ে তার ছেলেই হবে চৌধুরী বাড়ির সর্বময় কর্তা। এখন তো এ সম্ভাবনা শুন্যের কোঠায় পৌঁছেছে। রাগে দুঃখে, ঈর্ষা আর হতাশায় ওনার বোধ বুদ্ধি সব লোপ পেয়ে গেল।

লোভের অপর নাম ধ্বংস। উনি এবার ধ্বংসের খেলায় নামলেন।

একা একা ফন্দি আটতে লাগলেন কিভাবে সোহাগীকে এ বাড়ি থেকে তাড়ানো যায়, কিভাবে আবার পাগল ছেলেকে পাগলা বানানো যায়। চুপে চুপে শহরে গিয়ে এখান ওখানের কবিরাজের সাথে পরামর্শ শুরু করে দিলেন। আজকালকার কবিরাজরা নানা রঙের রংচটা সাইনবোর্ড বানিয়ে ব্যবসার নামে ধোঁকাবাজি চালিয়ে যাচ্ছে। কয়েকজনের সাথে কথা বলে এক কবিরাজের সাথে ধীরে ধীরে ঘনিষ্ট হলেন বিভিন্ন ওষুধ কেনার ছলনায়। তার পর ঘনিষ্টতা বাড়তেই তাকে সব খুলে বললেন। কিভাবে পাগল ছেলেকে আরো পাগল করা যায় তার ওষুধ তার কাছে থেকে অনেক টাকা মূল্যে কিনে নিলেন আর তার যথাযথ প্রয়োগবিধিও জেনে নিলেন।
খুশি মনে বাড়ি ফিরে আসলেন, নতুন আশায় নতুন ধবংশের খেলা খেলতে। সোহাগীর তখন চার মাস চলছে, প্রায়ই বমি বমি ভাব হয়, শরীর খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাই আর আগের মতন লেগে থেকে শুভ্রর সেবা করতে পারে না, তাকে ঠিক টাইম মত ওষুধ খাওয়ানোও সম্ভব হচ্ছিল না। চৌধুরী মাতা তার বৌ এর এই শারীরিক অসুস্থতার অবস্থা জেনে তাকে পুরোপুরি রেস্ট এ থাকতে বললেন। আগের মত সারাদিন শুভ্রর সাথে না কাটিয়ে একটু শুয়ে বসে থাকার পরামর্শ দিলেন, শুধু বললেন একটু খেয়াল করে শুভ্রকে ওষুধগুলা খাইও তাইলেই হবে। আর আমি আগের মত শুভ্রকে সময় দেব, আপাতত তার দায়িত্ব নিলাম বাচ্চা হওয়ার আগ পর্যন্ত।

কোন এক দুপুর বেলা, হঠাতই সোহাগীর বমির বেগ এত বেড়ে গেল দৌড়ে সে চলে গেল বাথরুমে, অনেকক্ষণ ধরে বমি করে মাথায় পানি ঢেলে একটু ফ্রেশ হওয়ার চেষ্টা করছিল।

শুভ্রর চাচী অপেক্ষায় ছিলেন এমন একটি সুযোগেরই, এ ফাঁকে তিনি রুমে ঢুকে শুভ্রর ওষুধের মধ্যে কবিরাজের দেয়া বিষ মিশিয়ে দিল। নীল একটি বোতলে করে উনি যা নিয়ে এসেছিলেন শুভ্রকে পাগল করে দেওয়ার জন্য। সোহাগীর বাথরুমে যাওয়ার ফাঁকে চাচী রুমে ঢুকে শুভ্রর সাথে গল্প করার ছলে জিজ্ঞাসা করলেন তোর ওষুধ খাওয়া হয়েছে বাবা?

না চাচী সোহাগী এসে খাওয়াবে।

সোহাগীর জন্য অপেক্ষা করার দরকার কি?

আমি দিচ্ছি তোর ওষুধ। বলে উনি শুভ্রর ওষুধের সাথে ওনার নীল শিশি থেকে একটু বিষ ঢেলে মিশিয়ে দিলেন, বললেন খেয়ে নে বাবা।

এটা আবার কি ওষুধ দিলা চাচী?

এটা একটা নতুন ওষুধ, তোর জন্য আমি কবিরাজের কাছ থেকে নিয়ে এসেছি। এটা খেলে তুই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবি।

শুভ্র সরল বিশ্বাসে ওষুধ খেয়ে নিল, চাচী এ ফাঁকে চুপিচুপি রুম থেকে বের হয়ে তার রুমে চলে গেলেন।

এদিকে বিষের যন্ত্রণায় শুভ্র কাতর হয়ে কাতরাতে লাগল, তার যন্ত্রণার চিৎকার শুনে সোহাগী দৌড়ে ঘরে চলে আসলো, ওদিক থেকে চৌধুরী মাতাও দৌড়ে ঘরে চলে আসলেন। দেখলেন শুভ্র নেতিয়ে পড়েছে বিছানায় যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে। তার মুখ দিয়ে ফেনা ভাংছে।

পড়িমড়ি করে শুভ্রকে নিয়ে যাওয়া হলো স্থানীয় হসপিটালে, ডাক্তার তার অবস্থা দেখেই বুঝে গেল যে শুভ্র বিষ খেয়েছে, কতটুকু কি খেয়েছে তা আর আন্দাজ করতে পারল না তবে উনি তাৎক্ষণিক ভাবে তার স্টমাক ওয়াশ করে দিলেন। শুভ্র বেঁচে উঠল। তবে এ যেন অন্য এক শুভ্র, সেই আগের শুভ্র। কথা বলতে পারছে না, কথা জড়িয়ে জড়িয়ে যাচ্ছে কেমন যেন অপ্রকৃতিস্থ মানুষের মতন ব্যবহার। চৌধুরী বাড়ির কথা কে না জানে, স্থানীয় ডাক্তারও জানতেন। পাগল ছেলে যে ভালো হতে হতে আবার পাগল হয়ে গেছে তা বুঝতে পারলেন। তবে কে শুভ্রকে বিষ খাওয়ালো তা আর জানা গেল না। দুদিন হসপিটালে রেখে শুভ্রকে বাড়ী ফিরিয়ে আনা হল, কিন্ত সেই দশ বছর আগের শুভ্র, কারো সাথে কথা বলে না, কোন কথার উত্তর দেয় না, কথার পুরোপুরি জড়তা মুখে। কথা বলতে চাইলেও কথা বের হয় না মুখ দিয়ে।

এদিকে বাড়িতে শুরু হলো আরেক নাটক। চৌধুরী মাতা, চাচা, চাচী সবাই মিলে শুরু করল গবেষণা কে শুভ্রকে এই বিষ খাওয়াতে পারে? সোহাগীর উপর দায়িত্ব ছিল শুভ্রকে ওষুধ খাওয়ানোর সুতরাং অবশেষে সবাই মিলে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছল যে একমাত্র সোহাগীই এ কাজ করেছে সম্পত্তির লোভে পড়ে। কে আর পাগল স্বামীর ঘর করতে চায়? এখন যখন চৌধুরী বাড়ির বংশধর তার পেটে সুতরাং তার সন্তানইতো হবে চৌধুরী বংশের সম্পত্তির মালিক। চৌধুরী মাতার মন সায় দিল না তবে দেবর জা আর ভাতিজার কথা ফেলেও দিতে পারছিলেন না। অনেক বৈঠকের পরে সিদ্ধান্ত হল যে সোহাগীকে ফিরিয়ে দেয়া হবে তার বাপের বাড়িতে। সন্তান জন্ম হলে শুধু সন্তানকে নিয়ে আসা হবে চৌধুরী বাড়িতে আর সোহাগীকে ত্যাজ্য করা হল চৌধুরী বাড়ি থেকে। নিয়তির পরিহাসে আবার সোহাগী হল স্বামী ভিটে ছাড়া। এবার আরেক কলঙ্ক মাথায় নিয়ে। স্বামী হত্যার চেষ্টার অভিযোগ।

এদিকে সময়ের সাথে সাথে শুভ্র একটু একটু করে সুস্থতা ফিরে পাচ্ছে, কথা বলার জড়তা কাটে নি এখনো তবুও তার দু চোখ যেন সারাক্ষণ কাকে খুঁজে বেড়ায়। চৌধুরিমাতা বুঝতে পারেন শুভ্র কাকে খুঁজছে। কিছু বলতে পারেন না, শুধু চোখের পানি ফেলেন। এদিকে শুভ্র আবার তার আগের অবস্থানে ফিরে গেছে সোহাগী কে হারিয়ে। কেমন জানি ভ্যাবলার মত চেয়ে থাকে, যেন কোন কথা বুঝে না কারো। কিছু জিজ্ঞাসা করলে তার মুখ থেকে কোন শব্দ কেও বের করতে পারে না। শুধু মা কিছু জিজ্ঞাসা করলে অথবা কথা বলতে আসলে সেই আগের মতন জড়তামাখানো গলায় আধো আধো কথা বলে তাও যেন ইচ্ছের বিরুদ্ধে।






শুভ্র উদ্ভ্রান্তের মত ঘুরে বেড়ায় এদিক সেদিক, বাগানের চারিধারে আর মনে মনে কি জানি সব সময় বিড়বিড় করে। খাওয়া দাওয়া সব এক রকম বন্ধই করে দিয়েছে আজকাল, ওষুধ আর খায় না এখন, সামনে ওষুধ নিয়ে আসলে ঢিলা মেরে ফেলে দেয়। এভাবেই তার দিন কেটে যাচ্ছিল। মা অনেক বুঝাতে চেষ্টা করেন তাকে, বাবা তুই যাকে খুঁজছিস সে নেই, তাকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে এই বাড়ি থেকে। সে তোর ওষুধে বিষ মিশিয়ে দিয়েছিল; তোকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। শুভ্র কেমন এক চোখ করে শুধু মাথা নাড়ে আর না না করে। মা তার কথা বুঝতে পারেন না। ছেলের পাগলামি আবার বেড়েছে ভেবে খুব একটা আমল দেন না।

হঠাতই একদিন বাগানে হাটতে হাটতে বাড়ির পেছন দিকে চলে এসেছে শুভ্র একা একা, আর জবা ফুলের ঝোপের পাশে পড়ে থাকতে দেখল নীল রঙ এর সেই বিষের শিশিটা, যেটা থেকে তার চাচী তাকে ওষুধ ঢেলে খাইয়েছিলেন। সে শিশিটা যত্ন করে কুড়িয়ে নিয়ে পকেটে ভরল।

ঘরে গিয়ে অবোধ্য ভাষায় চিৎকার করা শুরু করল। সবাই ছুটে এলো – কি হয়েছে বাবা, কেন এমন করছ? মা, চাচা, চাচী সবাই মিলে জিজ্ঞাসা করছে তাকে।
সে পকেট থেকে নীল শিশিটা বের করে কি জানি বলতে চাচ্ছে – তার কথা জড়িয়ে আসছে, কিছু বোঝা যাচ্ছে না। শুধু হাউ হাউ কান্না আর শিশির বোতল উঁচু করে ধরে আছে।

চাচা যেন কি বুঝলেন – বাবা তোকে কি এই শিশি থেকে ওষুধ খাইয়েছিল কেও?
শুভ্র কথা বলতে পারে না কান্নার চোটে শুধু মাথা নাড়ে উপর নীচে।

বুদ্ধিমান চাচা সাথে সাথে বুঝে যায়, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সবার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে কি যেন বুঝার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। শুভ্রকে জিজ্ঞাসা করে কে? বলতে পারবি?

শুভ্র আঙ্গুল উচিয়ে চাচিকে দেখিয়ে দেয়, চাচির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। এ ছেলে যে বেঁচে ফিরে আসবে তাই তো তার কল্পনায় ছিল না, এখন আবার সব কথা ফাস করে দিচ্ছে। চোরের মার বড় গলা, উনি চিৎকার করে উঠলেন – শুভ্র তুই এত বড় কথা বলতে পারলি আমায়? বলে তার কান্না আর বাধ মানে না।

তবুও শুভ্র তার চাচীর দিকে আঙ্গুল উচিয়ে চেয়ে থাকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে। চাচা সব বুঝে যান নিমিষেই। তার স্ত্রীর ঈর্ষান্বিত চরিত্রের কথা উনি আগেই জানতেন, এইবার গিয়ে বৌ এর চুলের মুঠি ধরে সবার সামনে দু ঘা লাগিয়ে দিয়ে সত্যি কথা বলতে বলল।

ওনাকে বলল – শুভ্র ছেলে মানুষ তার বোধ বুদ্ধি নাই, কিন্ত সে মিথ্যে কথা বলবে না। এটা আমি যেমন জানি তুমিও জান। সুতরাং সব স্বীকার করলে এখনো তোমাকে মাফ করতে পারি কিন্তু স্বীকার না করলে এ বাড়ি থেকে এক্ষুণি বের করে দেব।

চাচী সব কথা স্বীকার করে নেন।

চৌধুরী বাড়ির আরেকটি কালো অধ্যায়ের মুখোশ উন্মোচিত হয়।

চাচা সহ চৌধুরানী সোহাগীর জন্য লজ্জিত হয়ে পড়েন, তাদের মনে পড়ে কি অপমান করেই না সোহাগীকে এ বাড়ি ছাড়া করা হয়েছিল।

শুভ্রকে নিয়েই ওনারা সবাই মিলে তারাতারি যান সোহাগীর বাড়ি। গিয়ে দেখে সোহাগী এক অসহায় মুখে রোদের মধ্যে বসে আছে। ও বাড়ির কেও সোহাগীকে এখন আর সহ্য করতে পারে না, কেও কথা বলে না। এরই মধ্যে শুকিয়ে কেমন হয়ে গেছ। আগের লাবন্য কোথায় জানি উবে গেছে তার চেহারা থেকে।

হঠাত এ বাড়িতে সবাইকে দেখে সে চমকে যায়, কেমন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে সবার দিকে। শুভ্র ছুটে এসে সোহাগীকে বুকে করে নেয়। অব্যক্ত ভাষায় কি সব কথা বলে যাচ্ছে কেও বুঝছে না, শুধু তার ভালোবাসাটুকু টের পাওয়া যাচ্ছে তার প্রতিটা আচরণে আর কথা বলার চেষ্টায়। কেও থাকে সোহাগী থেকে আলাদা করতে পারছে না, শক্ত করে ধরে রেখেছে সোহাগীকে, যেন ছেড়ে দিলেই আবার হারিয়ে ফেলবে তাকে।

চৌধুরিমাতা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসেন সোহাগীর দিকে, শুভ্রর বুকে পড়ে থাকা সোহাগীর হাতে ধরে ক্ষমা চায়, চোখে করুণ মিনতি তার। মা আমাদের মাফ করে দাও, আমরা ভুল বুঝতে পেরেছি, ঘরের লক্ষ্মী এবার ঘরে ফিরে চল।

এদিকে সোহাগীর বাবা কাজের থেকে ফিরেছে, মা ঘর থেকে বের হয়ে এসেছে। দুজনাই হতভম্ন – কি হচ্ছে এসব? চাচা তাদের সব কিছু খুলে বলেন। আর চৌধুরী পরিবারের হয়ে ওনাদের কাছে ক্ষমা চান। বলেন আমাদের ঘরের লক্ষ্মী আমরা ঘরে নিয়ে যেতে এসেছি আবার।

সবাই মিলে চৌধুরী বাড়ির দিকে রওয়ানা দেন।

শুভ্র সোহাগীর হাত ছাড়ে নি, এক সাথে পা মিলিয়ে দুজনে হেঁটে চলেছে যেন কি এক নতুন আশার দেশে নতুন ভালোবাসায়। নতুন স্বপ্ন দেখে যায় তারা অনাগত ভবিষ্যতের। নতুন মেহমান আসছে পৃথিবীতে, তাকে করে নিতে হবে বরণ নতুন এক ভালোবাসায়। হোক না সে আরেকটি শুভ্র কিংবা সোহাগী তাতে কি এসে যায়।

সত্যিকারের ভালোবাসার কাছে সব ছলচাতুরী ম্লান হয়ে যায়, ডুবন্ত সূর্যের মত।
যুগে যুগে শুভ্ররা জন্ম নেয়, প্রকৃতই তাদের জীবন কে স্নেহ মায়া মমতা আর ভালোবাসায় ভরে দেওয়ার জন্য একজন করে চৌধুরী রানী কিংবা একজন করে সোহাগী পাঠায়। প্রকৃতি কখনোই তার ভারসাম্য নষ্ট হতে দেবে না। উপরওয়ালা একজন অনেক মায়া মমতায় সৃষ্টি করেছেন তার শ্রেষ্ঠ মানব জাতি, নানা রঙের নানা পদের মানুষ তারই সৃষ্টি, সুতরাং উনি নিজেই তার শ্রেষ্ঠ সম্প্রদায়ের দেখাশোনা করবেন। দু চারজন চাচী কিংবা কিছু বখাটে অমানুষ তাতে কখনো বাঁধা হয়ে দাড়াতে পারবে না।

ভালোবাসার ছোঁয়ায় একদিন পৃথিবীর মানুষগুলোর মন থেকে ধুলো ময়লা দূর হয়ে যাবে। এটাই আমাদের প্রত্যাশা।


আজ এই লেখার মাধ্যমে একটি ছবি ফুটে উঠলো আমাদের সম্মুখে। আমরা দেখলাম একটি মানসিক প্রতিবন্ধী, অটিস্টিক নামধারি মানুষ শুভ্র কিভাবে ভালোবাসার স্পর্শে নিজেকে মানুষ রূপে তার পরিবারের কাছে, সমাজের কাছে প্রতিষ্ঠিত করেছে। চাচীর নোংরা মানসিকতা ফাঁস করে দিয়ে তার ভালোবাসাকে নিজের করে নিয়েছে। এরকম হাজারো শুভ্র কিংবা হাজারো সোহাগী ছড়িয়ে আছে গ্রাম বাংলার প্রতিটা গ্রামে গ্রামে। একটু যদি তাদের দিকে সহানুভুতির দৃষ্টি দেয়া যেত, একটু ভালোবাসা আর মমতায় তাদের আপন করে নেয়া যেত তবে আজকের পৃথিবী সত্যিই অন্যরকম হত। তবুও কিছু কিছু মানুষ তাদের অসীম ভালোবাসা আর অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে এইসব মানসিক প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। আমরা তাদের স্যালুট করি

চলুন না দেখে আসি আজো পৃথিবীর কিছু সুন্দর মনের মানুষগুলো কি এক অপার ভালোবাসায় এই সব অটিস্টিক মানুষগুলোকে বুকে ধরে রেখেছে, আর তাদের ভালোবাসার ছোঁয়ায় এই সব তথাকথিত মানসিক প্রতিবন্ধীরাও আজ কি না করে দেখাচ্ছে...............

উপযুক্ত শিক্ষা পেলে, তাদের একটু স্নেহ মায়া মমতার চোখে দেখে তাদের সাথে এক হয়ে গেলে তাদের দিয়ে কি না করা যায়? তারা সমাজের কোন বোঝ নয় বরং হতে পারে এক শক্তিশালী নতুন পৃথিবীর নতুন এক মানব প্রজাতি যাদের দেখে আমাদের মত সাধারণ মানুষ নামের অমানুষগুলোরও অনেক কিছু শেখার থাকবে।
অটিজম আজ আর কোন মানসিকে ব্যধি নয় বরং আমরা সাধারণ মানুষগুলো যারা অটিস্টিক মানুষদের মন থেকে মেনে নিতে পারি না তারাই বরং মানুষ নামের অমানুষ। আমাদের প্রত্যাশা একদিন আমরা সবাই মানুষ হবো, সব মানুষ মিলে এক কাতারে দাড়াবো।


লেখকের বক্তব্য:






একটি শিশুর জন্ম কিংবা তার ভবিষ্যৎ তার হাতে নয়। উপরওয়ালা তার ভাগ্যে যেন অন্য কিছুই লিখে রাখেন, কেন যে মানুষে মানুষ আল্লাহ-তায়ালার এই বিভাজন তা একমাত্র তিনিই জানেন। তবে আমরা মানুষরা যেন মানুষ থাকি না, পশু হয়ে যাই যখনই একটু অন্যরকম ব্যবহারের একটি শিশু কিংবা মানুষকে দেখি। একবারও ভেবে দেখি না যে মানসিক অস্বাভাবিকতা তার নিজস্ব তৈরি করা কোন অসুখ নয়। এটা যে একটা অসুখ তাও আমরা জেনেছি মাত্র কয়েকবছর হলো। তার আগ পর্যন্ত তো এ ধরনে শিশু কিংবা বয়স্ক মানুষদের পাগল নামে আখ্যায়িত করে কি দুর্ব্যবহারই না আমরা করতাম। আজ তবুও শহর অঞ্চলে আমরা চিকিৎসা বিজ্ঞানের সহায়তায় অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন এসেছে, মানুষের মধ্যে এওয়ারনেস এসেছে কিছুটা যে – এরাও মানুষ । অটিজম সোসাইটি হয়েছে, তাদের জন্য আলাদা স্কুল হয়েছে, তারাও মানুষ হিসাবে গণ্য হয়েছে আজকের সমাজে। এটা মানুষের জন্য অনেক বড় একটা জয়। কিছু কিছু সাদা মনের মানুষের অক্লান্ত চেষ্টা আর সরকারের তরফ থেকেও অনেক অনেক প্রচেষ্টার পর আজকের এই অবস্থানে আমরা পৌঁছেছি। কিন্তু এটুকুতেই আমাদের সীমাবদ্ধ থাকলে হবে না। আমাদেরও চিন্তা করতে হবে মনের ভেতরের অনেক গভীর থেকে, যদি আমার অনাগত সন্তানটি একটি অটিজম শিশু হিসাবে জন্ম নেয় তা হলে বাবা মা হিসাবে আমার কি করণীয় আছে, এটুকু যদি আমরা নিজেরা ভাবতে পারি নিজের ফ্যামিলি অথবা নিজের বাচ্চার ক্ষেত্রে চিন্তা করে সেই অনুযায়ী নিজেকে তৈরি করতে পারি মানসিক ভাবে তবেই আমরা সত্যিকারের মূল্যায়ন করতে পাব আজকের এই অটিজম সন্তানদের আর তাদের সাথে সন্তানের মত সহমর্মীতার হাত বাড়িয়ে দিতে পারব। আমরা নিশ্চিত একদিন আমাদের মানসিক দৈন্যতা কেটে উঠবে, সকল শিশু সন্তান সমান মর্যাদা পাবে, সকল মানুষ সমান মর্যাদা পাবে। তবেই না আমাদের মানব জীবনের সার্থকতা। তবেই না আমরা নিজেদের মানুষ বলে পরিচয় দিয়ে আল্লাহ্‌ তায়ালার সর্ব শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হিসেবে প্রমাণ করতে পারব।






কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন