শনিবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২২

ভবিষ্যৎ পৃথিবী

 কোন এক চৈত্রের দুপুর, মাথার ওপর দুপুরের খাড়া রোদ 

রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ঘামে ভিজে চুপচুপে হয়ে একটু ছায়ার আশায় এক লোকাল পার্কে ঢুকে গেলাম

ডালপালা ছড়ানো একটা বড় আম গাছ দেখে হেলান দিয়ে তার ছায়ায় বসে পড়লাম 

বসে থাকতে থাকতেই ঝিমুনি চলে এলো, হয়তো চোখটাও লেগে গিয়েছিলো

হঠাৎ করেই ঝিমুনি চটে গেলো, আশেপাশেই কোথাও থেকে খিলখিল হাসির শব্দ 

তার সাথে টুকটাক কিছু কথা ভেসে আসছিলো, ভালো করে কান দিতেই লজ্জায় আমার কান লাল হয়ে উঠলো

দুজনের প্রেম ভালোবাসার ঘন মুহূর্তের কথাবার্তা চলছিলো

প্রেমিক প্রেমিকা এগুলো পার্কে বলে না নিশ্চয়ই, দম্পতিরা বন্ধ দরজার ওপাশে বলতে পারে

একটু পরেই কাম শীৎকার, আমি আর থাকতে না পেরে ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়িয়ে যেতেই দেখি 

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে, চারিদিক কেমন ম্যাড়ম্যাড়ে অন্ধকার 

হিমেল বাতাসে শরীরে শীত শীত একটা অনুভূতি, চৈত্রের গরমে শীত লাগছে কেন? 

আমার হেলান দেয়া গাছের ঠিক উল্টোদিকে একজোড়া শরীর জোড়া লেগে আছে

খোলা পার্কে? আমাকে দেখেও তাদের কাজের কোন ব্যত্যয় হলো না 

আমার সামনেই বাকি কর্ম সম্পন্ন করছিলো দেখে লজ্জায় মাথা ঘুরিয়ে রাখলাম 

ওরা কর্ম সম্পাদন করে চোখ টিপে বললো - কি হে কাকু! পারফর্মেন্স কেমন দেখলে? 

আমি ধমকে উঠে বললাম, অসভ্যের দল তোদের লজ্জা সরম নেই?


ওরা আশ্চর্য হয়ে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে কতক্ষণ তাকিয়ে রইলো

তারপর কি জিজ্ঞেস করলাম বুঝে উত্তর দিলো - এতে লজ্জা সরমের কি আছে?

তুমি করো না? 

আমি আবার চটে গিয়ে বললাম, দুষ্টের দল এগুলো খোলা আসমানের নীচে করতে আছে?

এগুলো দম্পতিরা গোপনে করে, ঘরের দরজা দিয়ে; তোরা শুরু করেছিস চৈত্রের বিকেলে 

তাও খোলা আকাশের নীচে বনে বাদাড়ে;


ওরা এবার বড় বড় চোখ করে বললো, দম্পতিরা করে মানে?

আজকাল দম্পতি পেলা কোথায় চাচা মিয়া? 

ওগুলো তো আদিম যুগের মানুষের কারবার ছিলো

বিয়েশাদী উঠে গেছে সেই কবেই? 

আর পৌষের সন্ধ্যায় তুমি চৈত্র পেলে কোথায়? স্বপ্ন দেখছ নাকি?  


এবার আমার আশ্চর্য হওয়ার পালা,

বিয়ে শাদী উঠে গেছে মানে?

কবে থেকে রে বুড়বকের দল? তোদের বাবা-মা বিয়ে করেন নি?

নাকি বিয়ে ছাড়াই তোরা দুনিয়াতে এসেছিস?


ওরা বললো? বিয়ে? বাবা-মা? 

ওহ তুমি বায়োলজিক্যাল বাবা-মার কথা বলছ?

আরে বাবা-মা থাকবে না কেন? তবে ওদের খবর কে রাখে? 

নিশ্চয়ই খবর নিলে পাওয়া যাবে সেন্ট্রাল ডাটাবেজে?


আমি চোখ বড় বড় করে বললাম - মানে?

মানে কি আবার চাচা মিয়া? তুমি কোন দুনিয়ায় বাস করছ?

আজকাল বাচ্চাকাচ্চা হতে আবার বিয়ে করতে হয় নাকি? 

দুজন ইচ্ছে করলেই বাচ্চা নিতে পারে,  

আমি বললাম - বিয়ে ছাড়াই বাচ্চা?


ওরা জবাব দিলো - হ্যাঁ! এটাই তো স্বাভাবিক

যখন যাকে ভালো লাগে কয়দিন একসাথে থাকি তারপর ভালো না লাগলে যে যার পথে

এর মধ্যে কারো ইচ্ছে হলে বাচ্চা নিয়ে নেয়, যতদিন খুশি বাচ্চাকে ডলাডলি করে আদর করে  

তারপর আবার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে কেউ ইচ্ছে হলে বাচ্চার রেখে দেয় 

ইচ্ছে না হলে বাচ্চাকে বাচ্চা ব্যাংকে জমা দিয়ে দেয়

তারপর আবার নতুন কারো সাথে কিছুদিন থাকাথাকি, পছন্দ না হলে আবার অন্য কেউ

ছেলে মেয়ে দুজনেরই সমান অধিকার, এটাই এখনকার আইন;


আমি বললাম - তোমাদের নিশ্চয়ই বাচ্চা হয় নি?

মেয়েটি বললো আরে কি বলো কাকু? হয়েছে তো তিনটা  

আমি ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলাম - এই বয়সে তুমি তিনজনের বাবা?

মেয়েটি হেসে দিয়ে বললো - আরে আমি ওর বাচ্চাদের বাবা হতে যাবে কেন? 

তার সাথে তো মাত্র সপ্তাহ খানেক ধরে থাকা শুরু করেছি, ওর তিনজন বাচ্চার তিন বাবা

ছেলেটি কিছুটা লজ্জিত মুখ করে বললো - আমারও দুটো আছে, প্রথমটা ওর মা রেখে দিয়েছে  

আর দ্বিতীয়টা আমিও রাখি নি আর যার পেট থেকে হয়েছে সেও রাখে নি - বাচ্চা আছে বাচ্চা ব্যাংকে 

তোমার ইচ্ছে হলে নিয়ে নিতে পারো চাচা মিয়া, ওটা কিউট একটা মেয়ে; 


আমার মাথা কাজ করছিলো না 

কি সব শুনছি?

একবার ভাবলাম স্বপ্ন দেখছি, মাথা ঝাড়া দিয়ে শরীরে চিমটি কাটলাম 

নাহ! ব্যথা পাচ্ছি তো! তারমানে স্বপ্ন না

আমি দুপুরে শুয়েছিলাম, চৈত্রের দুপুরে

আকাশে ছিলো কাঠফাটা রৌদ্দুর, গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে উঠেছিলো 

গাছে গাছে সবুজ পাতা ছিলো, 

অথচ ঘুম ভেঙেছে শীত শীত আমেজ নিয়ে, সন্ধ্যার প্রাক্কালে, ওরা বলছে পৌষের সন্ধ্যে  

ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম আম গাছের জায়গায় হেলান দিয়ে আছি অশ্বত্থ গাছে 

আমি এবার ছেলেমেয়ে দুটোকে জিজ্ঞেস করলাম, এটা কি আসলেই পৌষ মাস?

ওরা বললো হ্যাঁ তো কাকু 

আমি চোখ বড় বড় করে বললাম - চৈত্র মাসে ঘুমিয়ে পৌষ মাসে উঠলাম?

ছেলেমেয়ে দুটি বড় বড় চোখ করে বললো - তোমার মাথা খারাপ হয়েছে চাচা মিয়া

আট মাস কেউ ঘুমায়? 

এবার আমি অসহায়ের মত তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম এটা কোন সাল বাবা?

ওরা বললো, দিন তারিখ ভুলে গেছ চাচা মিয়া? তোমার কি ডিমনেশিয়া? 

এটা দুহাজার সাতাত্তর সাল

আমি বিড়বিড় করে বলতে লাগলাম - তাই তো হওয়ার কথা, তাই তো হওয়ার কথা

পঞ্চাশ বছর পরেও পৃথিবীটা টিকে আছে এটাই তো বেশি;   


কে যেন ধাক্কা দিচ্ছে, 

আমি গভীর পুকুরের তলদেশ থেকে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি 

মায়াবতী একটি ছোট্ট বালিকা হাতে ফুল নিয়ে আমার গায়ে ধাক্কা দিচ্ছে 

আমায় চোখ মেলতে দেখতেই বললো - আফনেরে বোবায় ধরছিল চাচাজান

এই দুফুর রৈদে পার্কে কি করেন? বাইত যান

বলে সে ফুল বিক্রি করতে আবার পার্কের অন্যদিকে ছুটে গেলো,

যাহ্‌! এতক্ষণ কি সব আজগুবি স্বপ্ন দেখছিলাম!

তবে ওটা কি স্বপ্ন ছিলো? আমার কাছে মনে হচ্ছিলো একদম সত্যি ঘটনা

আচ্ছা! পৃথিবী কি আসলেই ঐদিকে যাচ্ছে?

বিয়েশাদী উঠে যাবে পৃথিবী থেকে? বাচ্চা ব্যাংকে বাবা-মায়ের ফেলে দেয়া বাচ্চারা থাকবে?

আজকাল অবশ্য এমনিতেই যা সব শুরু হয়েছে! 

পরকীয়া ঘরে ঘরে, দম্পতিদের মাঝে ঝগড়া ছাড়াছাড়ি নিত্য দিনের ঘটনা 

ডি এন এ টেস্ট পর্যন্ত যেতে হচ্ছে বাচ্চার বাবার পরিচয় নিশ্চিত করতে,   

আমি ভবিষ্যৎ পৃথিবীর কথা চিন্তা করতে করতে 

ছোট্ট মায়াবতী মেয়েটির অপসৃয়মান অবয়বের দিকে তাকিয়ে রইলাম

তারপর ধীরে ধীরে বাসার পথ ধরলাম .........


 


৩০ এপ্রিল, ২০২২


#কবিতা 


ভবিষ্যৎ পৃথিবী 

 - আহসানুল হক 




    

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন