শুক্রবার, ২৬ অক্টোবর, ২০১২

কোরবানি ও অলিক কিছু চিন্তা

কোরবানি ও অলিক কিছু চিন্তা

-যাযাবর জীবন

“ক্যামেরার টপ শট
ঈদের আগের দিন বিকেল বেলা
বড় বাড়ির উঠোন
৪ টি বড় বড় গরু
২টি দাঁড়িয়ে বাকি দুটো বসে
তার একটু পাশে ৪ টি বিশাল আকারের খাসি
১টি দাঁড়িয়ে বাকিগুলো বসে
কোরবানির জন্য কেনা
৪টি ফ্যামিলির ছোট ছোট বাচ্চা ছেলেরা গরুগুলোকে ঘিরে
কতগুলো ফুটফুটে বাচ্চা মেয়েরা একটু দূরে
যেন ভয় পাচ্ছে গরুগুলোর কাছে যেতে
ওরা খাসি বা ছাগল গুলোকে কাঁঠাল পাতা খাওয়াচ্ছে।

ক্যামেরা ক্লোজ শটে
একটি শিশু বাচ্চা ছেলের মুখ
হাসিতে দাঁত বের হয়ে আছে
দেখেছ? আমাদের লাল গরুটা সবচেয়ে বড়
দেখতে কি সুন্দর নাদুস নুদুস।

ক্যামেরা ঘুরে ক্লোজ শটে
আরেকটি শিশু বাচ্চা ছেলে
আরে নাহ আমার সাদা গরুটা দেখ
ওটাই সবচেয়ে বড়
উঁচু লম্বা সব গরুগুলোর চেয়ে।

ক্যামেরা আবার ঘুরে ক্লোজ শটে
আরেকটি শিশু বাচ্চা ছেলের মুখ
হাসিতে সবগুলো দাঁত বের হয়ে পড়েছে
ধুর তোমরা সবাই বোকা
দেখ না আমার কালো গরুটা
দুই লাখ টাকা দিয়ে কিনে এনেছি বাবা আর আমি
ষাঁড় গরু এটা, হাটের সবচেয়ে গাঁট্টাগোট্টা
এখানকার সবগুলো গরুর মধ্যে সবচেয়ে দামি।

এবার ক্যামেরা ঘুরে ক্লোজ শটে
চতুর্থ শিশু বাচ্চা ছেলের মুখে
চিন্তিত একটু যেন এই ছেলে
চারটি গরুর মধ্যে সবচেয়ে ছোট গরুটি তার
তবু মুখে কি এক প্রশান্তির হাসি
সাদা কালো ছোট গরুটির গায়ে হাত বুলায়
পরম মমতায়
একটু খানি কে যেন ভাবে
বাকি সবাইকে বলে
নিয়তে বরকত, কোরবানির ভাবনায়
গরুর দামে কি আসে যায়?
কোরবানির এই গরুটি কেনা
আমার বাবার অনেক কষ্টের পয়সায়।

ক্যামেরা প্যান করে টপ শটে
চার রঙা চারটি গরু
চারটি গরুর গা ঘেঁসে চারটি বাচ্চা শিশু
একটু দূরে দাঁড়িয়ে চারটি শিশু মেয়ে
মুখে কোন কথা নেই তাদের
খাসি বা ছাগলকে কাঁঠাল পাতা খাওয়াচ্ছে।

চতুর্থ শিশুটির কথা শুনে
ক্যামেরা জ্যুম করে বাকি তিনটি শিশুর মুখে
এক এক জনের এক এক রকম এক্সপ্রেশন
কারো তাচ্ছিল্য কিংবা কারো যেন বুঝদার হাসি।

ক্যামেরা এগিয়ে গিয়ে জ্যুম করে
বড়ির উঠোনের লোহার শিকের গেটে
গেট বন্ধ তালা মারা
দারোয়ান দাঁড়িয়ে গেটে
পাশের বাড়ির কয়েকটি বাচ্চা ছেলের মুখ
যাদের বাবার সামর্থ্য হয়নি কোরবানির গরু কিংবা ছাগল কেনার
করুণ চোখে তাকিয়ে দেখতে থাকে
বড় বাড়ির কোরবানির পশুগুলোকে
মলিন মুখে, কি এক অসহায় চোখে
ক্যামেরার ফোকাস তাদের মলিন মুখ
ডি ফোকাস বড় বাড়ির শিশুগুলোর মুখ
ক্যামেরার ডি ফোকাস তাদের মলিন মুখ
ক্যামেরা ফোকাস বড় বাড়ির শিশুগুলোর হাসিখুশি মুখ।

ঈদের দিন দুপুরবেলা
ক্যামেরার লং শট
বড় বাড়ির খাবার টেবিল,
সবাই মিলে খাচ্ছে
কোরবানির মাংস, বড় ছোট সবাই
গল্পে মশগুল
সকলের মুখে হাসি
ক্যামেরা ফোকাস আউট।

ক্যামেরা ফোকাস ইন
পাশের বাড়ির খাবার ঘর
মাটিতে আসন পেতে বাবা মা আর দুটি সন্তান
জ্যুম শটে সাদা ভাতের গামলা
একটি বাটিতে আলু ভর্তা
একটি বাটিতে ডাল
আর ঈদ উপলক্ষে মায়ের রান্না
একটি মুরগীর মাংসের বাটি
মাদুরে খেতে বসা সবাই
ক্যামেরা ফোকাস আউট
এন্ড কাট”।

কেন এমন হয়?
কোরবানির অর্থ কি?
আমরা কি পারি না আমাদের কোরবানির মাংসের ভাগ দিতে
পাশের বাড়ির ওই প্রতিবেশীকে?
এটাই তো হওয়া উচিত কোরবানির প্রকৃত অর্থে।
তবে কেন আমরা ভুলে যাই প্রতিবেশীকে?
এই আমাদের ত্যাগের শিক্ষা?
এই আমাদের কোরবানির দীক্ষা?
কেন বড় বাড়ির গেটে ফকিরের ভীর লেগে থাকে দু টুকরো মাংসের আশায়
আর বড় বাড়ির কর্তা গিন্নী মুখ ঝামটে ঝামটে মাংস বিলিয়ে যায়
ফকিরদের মাঝে, যেন এটাই তাদের কোরবানির আসল মানে
কতটুকু বিলালো তার কি হিসেব রাখে
নাকি হিসেব কষে তার ডিপ ফ্রিজে কত বেশি মাংস আঁটে?
বাকি যা থাকে ছুড়ে ছিটিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা ভিক্ষুকের পানে।
আজকের সমাজে গরীব প্রতিবেশীর খবর নেওয়ার সময় কোথায়
কিংবা মানসিকতা?
আমরা কি দিনে দিনে মনুষ্যত্ব হারাচ্ছি
নাকি অনেক টাকায় কেনা কোরবানির গরু নিয়ে গর্ব করে
সম সোসাইটির বাকি সবাইকে বলে বেড়াচ্ছি
ভাবী জানেন? আমার কর্তা এবার গরু কিনেছে এক লক্ষ টাকায়
কিংবা আরেকজনের তাচ্ছিল্য ভরা মুখে শোনে
মাত্র একলক্ষ টাকা? আমার কর্তা এবার হাটের সবচেয়ে দামী গরুটি কিনে এনেছে
আট লক্ষ বা দশ লক্ষ টাকায়।
যেন টাকাটা হাতের ময়লা, ঠিক যেমন পাশের বাসার অভুক্ত প্রতিবেশী।
এরই নাম কি কোরবানি???
ত্যাগের শিক্ষায় কবে আর আমরা কোরবানির শিক্ষা নেব?
কোরবানির মাধ্যমে কবে ত্যাগের দীক্ষায় দীক্ষিত হব?
মনুষ্যত্বহীন বিবেক কথা কয়
মানুষ যেন বুঝেও মুখ ফিরিয়ে রয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন