সুন্দরবনে মধু ট্যুর
আমার অনেক দিনের সাধ ছিল সুন্দরবনে মধু আহরণ দেখতে যাব কিন্তু কয়েক বছর ধরেই যাব যাব করেও আর যাওয়া হয়ে উঠেনি। এত বছর সুন্দরবনে এত ভ্রমণ করেছি আর মধু আহরণের মত এক্সাইটিং ট্যুর করিনি ভাবতেই নিজের কাছে কেমন জানি অপরাধী লাগত। তাই এই বছর অনেক আগে থেকেই খোজে ছিলাম কোন ট্যুর কোম্পানি মধু সংগ্রহ ট্যুর এ যাবে। মার্চ মাসের শেষদিকে হঠাৎ করেই দি গাইড ট্যুর লি: এর মালিক হাসান মনসুর ভাই এর অফিসে বসে কথা হচ্ছিল যে এখন আর তেমন কেউ মধু ট্রিপ করে না। মধু ট্রিপ এর মত কষ্টকর ট্যুরে যাবার মত গেস্টও পাওয়া যায় না আর কিছু গেস্ট পাওয়া গেলেও তারা এই ট্রিপ করার খরচ বহন করতেও আগ্রহী হয় না। যার ফলশ্রুতিতে ট্যুর অপারেটররাও মধু ট্রিপ এর আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। কথায় কথায় উনি জানালেন যে এইবার দি গাইড ট্যুর লি: মধু ট্যুর করছে কারণ একজন ফরেইনর কয়েকদিন আগে শুধুমাত্র এই ট্যুর কারার জন্য বুকিং করেছে, যদি অন্য কোন গেস্ট নাও হয় তবু উনি একাই এই ট্যুর এর সকল ব্যয়ভার বহন করবেন এবং হাসান ভাই কেও এই ট্যুর এ গাইড হিসাবে যেতে হবে। শুনে আর আমাকে পায় কে? আমি বললাম ট্যুর যখন হচ্ছে আর আপনি যখন যাচ্ছেন আমাকে অবশ্যই আপনার সাথে নিতে হবে। উনি আমাকে এত বেশি স্নেহ করেন যে না বলার প্রশ্নই আসে না। শুধু বললেন যে, চেষ্টা করে দেখ যদি আরো কিছু গেস্ট পাওয়া যায় তাহলে ভালো হয়। উনি নিজেও এই ট্রিপ সেল করার চেষ্টা করছেন।
শেষ পর্যন্ত আমি কিছু গেস্ট জোগাড় করি, উনাকে বলার পরে বললেন যে ওনার দুই ফরেনর গেস্ট সহ আমরা মোট ১২ জন হয়েছি, তাই ১২ জনের বোট বনবিবি নিয়ে আমরা এইবারের মধু ট্যুর এ যাব। যথারীতি ৩০ তারিখ সকালের বাসে আমার ৮ জন গেস্ট নিয়ে সোহাগ পরিবহনে করে খুলনার উদ্দেশে রওনা দেই, এবং সন্ধ্যায় জেলখানা ঘাটে গিয়ে হাসান ভাই কে ফোন দেই, উনি আগের দিন ফ্লাইটে এসে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ঘাটে নৌকা পাঠিয়ে দিলেন, নৌকা করে বোটের কাছে গিয়ে দেখি উনি বনবিবির বদলে অবসরে বসে আছেন, একটু আশ্চর্য হলাম, কি ব্যাপার হাসান ভাই আপনি যে অবসরে বসে আছেন? মুচকি হেসে বলল উঠে আসতো আগে! অবসর এ উঠে দেখি প্রত্যেকটা দরজায় গেস্টদের নাম লেখা, আমাকে একা একটা কামরা দেয়া হয়েছে। আর অন্যান্য কামরা গুলোতে দেখি আমাদের ১২ জন ছাড়াও আরও গেস্ট এর নাম লিখা আছে। প্রশ্ন বোধক দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকাতেই বললেন যে এই ট্যুর এ আমাদের সাথে উনার নিমন্ত্রিত আরও কিছু সাংবাদিক যাবে, শুনে খুশিতে মনটা ভরে উঠল - যাক অনেক দিন পর মধু ট্যুর এ গ্রুপ সাইজ বেশ বড়ই হয়েছে। সাংবাদিক গ্রুপ আজ রাতের বাসে ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে কাল ভোর বেলায় আমাদের সাথে জয়েন করবে আর ওরা আসার সাথে সাথেই আমরা বোট নিয়ে রওয়ানা দিয়ে দিব।
পরদিন অর্থাৎ ৩১ তারিখ ভোর ছয়টায় ১২ জনের গ্রুপ বোটে উঠে আসল, এবং ওরা ওঠার সাথে সাথেই আমরা বোট ছেড়ে দিলাম। আমাদের এখন মোট গ্রুপ সাইজ দাঁড়িয়েছে ২৪ জন এ। সকালের নাস্তা খাওয়ার পর পরই শুধু ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক শব্দ শুনে লবি থেকে বের হয়ে দেখি সাংবাদিক ভাইরা তাদের কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছে।
সুন্দরবন এর অন্য আর দশটা ট্যুর এর মত খুলনা থেকে মংলা না গিয়ে আমরা চালনা বন্দর পার হয়ে একদম নতুন পথে বুড়িগোয়ালিনির দিকে রওনা হলাম, এই দিকে আমি আগে আর কখনো আসিনি। তাই সকালের মিঠে রোদে জাহাজের ছাদে বসে নতুন এই পথ এর আস্বাদন নিচ্ছিলাম। কিছুদূর যেতেই লোকালয় শেষ হয়ে গেল, শুরু হলো সুন্দরবনের মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য। মাত্র ঘন্টাখানেক যেতেই প্রথম দেখা গেল এক ঝাঁক বানরের পাল। জাহাজের শব্দে নদী পার থেকে দৌড়ে বনের দিকে পালিয়ে গেল। হাসান ভাই বললেন ভালো করে নজর রাখতে, এই রুটে অনেক বানর দেখা যাবে। দুপুরবেলা লাঞ্চ এর আগে দিয়ে হঠাৎ করেই হাসান ভাই বলল, কার সাহস আছে নদীতে নামে সাতার কাটার? সারা জীবন অনেক নদীতে সাতার কেটেছি কিন্তু কখনো সুন্দরবনে কোনো নদীতে নামার সাহস করিনি। কেন জানি নদীতে নেমে সাতার কাটার প্রবল একটা ইচ্ছা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল, আবার মনের ভিতর থেকে কে যেন বলছিল না নামিস না, এই নদী কুমিরে - হাঙরে ভরা - নামা ঠিক হবে না। মনস্থির করতে পারছিলাম না কিছুতেই। এইদিকে হাসান ভাই তাড়া দিচ্ছিল বার বার - কেউ কি আছে যে নদীতে একটু সাতার কাটতে চায় উনার সাথে? মাথায় কি পাগলামি চাপলো আমি বলে উঠলাম - আপনি যদি নামেন তাহলে আমি আছি। আমার বলতে যা দেরি, হাসান ভাই সাথে সাথে বললেন এই জাহাজ থামা, এংকর কর, আর বয়াগুলা পানিতে নামা। জাহাজ এংকর করা শেষ হয় নাই, বয়া শুধু নামানো হলো আর হাসান ভাই দেখি লাফ দিয়ে নদীতে, ২৪ জনের মধ্যে হাসান ভাই ছাড়া আর একজন মাত্র সাহসী পেলাম - অনন্ত নামে একটা ছেলে (আসলে অশান্ত পরে বুঝেছিলাম) যে হাসান ভাই এর পর পর এ দেখি পানিতে লাফিয়ে পড়লো আর তার পরপর এ আমি। পানিতে পরেই ভেসে উঠে দেখি জাহাজ থেকে অনেক দূরে সরে এসেছি, পানিতে স্রোতের টান ভয়াবহ রকম বেশি। যাই হোক কিছুক্ষণ সাতার কেটে কোন অঘটন ছাড়াই আমরা আবার জাহাজে উঠে পরলাম। এর পর আরো প্রায় ৩ ঘণ্টা জাহাজ চালানোর পর বিকাল ৪টার দিকে আমরা বুড়িগোয়ালিনি পৌছুলাম। পথে দেখতে পেলাম প্রচুর বানর, কিছু হরিণ, কিছু বন্য শূকর এবং হরেক প্রজাতির পাখি।
মধু ট্যুর এর কিছু ছবি ফ্লিকারে আপলোড করলাম, ইন্টারেস্টেড হলে ফ্লিকার থেকে দেখে নিতে পার।
ফ্লিকার লিংক –
http://www.flickr.com/photos/nirbasone_eka/sets/72157624530477018/
বুড়িগোয়ালিনি আমার কাছে নতুন এক অভিজ্ঞতা, নদীর একপাশে সুন্দরবন আরেক পারে জনবসতি। সারাদিন নদী ভ্রমণের পরে সবাই অস্থির হয়েছিলাম ডাঙ্গায় নামার জন্য। সবাই মিলে তাই ছোটবোট ‘ঈমা’তে করে রওনা দিলাম বুড়িগোয়ালিনি বাজারের উদ্দেশ্যে, ছোট বাজার কিন্তু বেশ ছিমছাম। বাজারে বসে সিঙ্গারা, চপ, পুরি, চা এর ধুম পরে গেল, মাত্র ছোট দুটি দোকান; দেখতে দেখতে তাদের সিঙ্গারার স্টক শেষ হয়ে গেল। আমরা এইবার রওয়ানা দিলাম নদীর পাড় ধরে হাঁটাপথে মৌয়ালদের নৌকার দিকে, বেশ খানিকটা হাটতে হল আমাদের, প্রায় দুই মাইল মত জায়গা। (মৌয়াল - যারা সুন্দরবন থেকে মধু আহরণ করে তাদের মৌয়াল বলে।) মৌয়ালদের ঘাটে গিয়ে দেখি এইবার মাত্র অল্পকিছু মৌয়াল নৌকা এসেছে মধু আহরণে। সন্ধ্যার আগে ওরা মিলাদ পরে মোনাজাত করল, এটাই ওদের রীতি। প্রতিবছর এইদিনে ওরা আগে দোয়া মাহফিলে সমবেত হয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে যাতে করে মধু আহরণে গিয়ে গ্রুপের কেও বাঘের পেটে না জায়। ওখান থেকে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা পার হয়ে গেল, যে জার মত করে হেটে ফিরছিল; আমি একটু আস্তে হাঁটছিলাম চারিদিকে জেলেপাড়া দেখতে দেখতে, সুতরাং সবার পিছনে পরে গেলাম; একা একা দুই-মাইল হেটে ঘাটে ফিরে দেখি যে ঘাটে আমাদের ছোট নৌকা নেই, আমি একদম একা ঘাটে। একটু ভয় ভয় করছিল কেন জানি - নতুন জায়গা বলেই হয়ত আর বনের মধ্যে একদম একা নীরব নিরজন একটা জায়গা দাঁড়িয়ে আছি ভয় পাওয়াই বোধয় স্বাভাবিক। হাসান ভাইকে ফোন করলাম, অনেকক্ষণ ধরে রিং বাজছে কিন্তু কেও ধরছে না, প্রায় ১৫ মিনিট ক্রমাগত চেষ্টা করার পর উনি ফোন ব্যাক করলেন, বলল যে উনি অনেক আগেই জাহাজে গিয়ে ঘুমিয়ে ছিলেন, ক্লান্ত লাগছিল বলে দুই-মাইল হেটে উনি আমাদের সাথে আর মৌয়ালদের ঘাটে যান নি। আমি বললাম যে আমাকে ফেলে সবাই জাহাজে চলে গিয়েছে আর আমি একা ঘাটে বসে আছি। শুনে উনি সাথে সাথে নৌকা নিয়ে রওয়ানা হলেন ঘাটের দিকে। এবার একটা মজার কথা বলি, জাহাজ থেকে উনার আসতে ১০ মিনিট লাগল আর আমি একা ১৫ মিনিট ঘাটে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এই ২৫ মিনিটে নতুন আবিষ্কার করলাম সুন্দরবনের মশা, সে যে কি ভয়ংকর মশা তা না দেখলে অথবা কামর না খেলে বিশ্বাস করা যাবে না। হাজার হাজার মশা মনে হচ্ছিল আমাকে ঘাটের ব্রিজ থেকে তুলে নিয়ে নদীতে ফেলে দিবে। আমি ঠিক দাঁড়িয়ে ছিলাম না বলে মশা তাড়ানোর জন্য নাচছিলাম বললেই বোধহয় সঠিক বিশেষণ দেয়া হয়। হাসান ভাই ঘাট থেকে আমাকে তুলতে তুলতেই টের পেলেন মশার আক্রমণ, বললেন এইগুলি কি? আমি বললাম ২৫ মিনিট ধরে আমি ওদের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছি। যাই হোক আমরা জাহাজের দিকে রওয়ানা হলাম, হাসান ভাই বলল চলো একটু নদীতে ঘুরে জাই দেখি নদীর বাতাসে মশা লাগে কি না। মাঝ-নদীতে মশা একটু কম মনে হলো। নদীতে আমরা ১৫ মিনিট ঘুরে জাহাজে গিয়ে উঠলাম, আমাদের দেখে সবাই তখন বলে উঠল যে কেও খেয়াল করেনি যে আমি রয়ে গেছি, সবাই ভেবেছিল যে আমি তাদের সাথে এক-গ্রুপেই নৌকায় উঠেছি, আসলে অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল আর তারা সবাই একসাথে ছিল বলেই ভেবেছিল আমিও গ্রুপের সাথে আছি। ধন্যবাদ মোবাইল ফোন কোম্পানিদের যে ঐরকম রিমোট জায়গায়ও যে তারা তাদের সেবা চালু করতে পেরেছে, না হয় আমার কপালে আরও দুর্ভোগ ছিল সেদিন।
যাইহোক ডিনার শেষে এইবার ঘুমাবার আয়োজন, কিন্তু ঘুমাতে যাব কি? চারিদিক থেকে দেখি মশা ঘিরে রেখেছে আমাদের, এই অবস্থায় মশারী ছাড়া ঘুমাবার প্রশ্নই আসে না । কিন্তু রুমের ভিতর আগুন হয়ে রয়েছে, এপ্রিল মাসের গরম তার উপর আবার বাতাস পড়ে গিয়েছে, রুমের ভিতর ঘুমানোর প্রশ্নই উঠে না আর বাইরে মশা বাবাজিরা ঘুমাতে দিবে এটা সম্ভব না। কি করি? হাসান ভাই দেখি আমাদের দুরবস্থা দেখে হাসছিল, বললেন মধু ট্যুর এর এই এক বিড়ম্বনা, এই অঞ্চলের এইটাই বৈশিষ্ট্য। উনি দেখি ১০ হাত বাই ১০ হাত বিশাল এক মশারি নিয়ে এসেছেন, জাহাজের ছাদে মশারী টানিয়ে আমাকে ডাকলেন, ভাবী আর উনি দিব্যি মশারীর ভিতর ঢুকে বসে আছেন, আমার জন্য জায়গা করে দিলেন বললেন এ ছাড়া আর কোনো উপায় নাই, এক সাথে গাদাগাদি করে আমরা ৫-৬ জন মশারীর ভিতর শুলাম। আর বাকিদের বললেন যে রুম থেকে মশারি এনে ছাদে ঘুমাও। সে এক নতুন অভিজ্ঞতা। সবাই মিলে জাহাজের ছাদে মশারি টানিয়ে ঘুমানো। আমরা ৩ রাত ছিলাম জাহাজে, প্রত্যেক রাতেই শোয়ার একই আয়োজন ছিল আমাদের। ভাগ্যিস বৃষ্টি ছিলো না তখন।
পরদিন ভোরবেলায় হাসান ভাই এর ডাকে ঘুম ভেঙ্গে গেল সূর্য ওঠার অনেক আগেই, আমরা মুখহাত ধুয়েই ছোট নৌকা ‘ঈমা’তে গিয়ে উঠলাম ভোরবেলায় ছোট খালের ভিতর ঘুরতে। সুন্দরবন ট্যুরে সকালবেলার এই ভ্রমণ আমার অত্যন্ত প্রিয়, তখন মাত্র ভাটা লেগেছে। ২৪ জনের মধ্যে মাত্র আমি সহ ৯জন হলাম সকালবেলার এই ট্যুরে যাবার জন্য, আর বাকি সবাই ঘুমে; আমরা ছোট একটি খালে ঢুকলাম, ঢুকার মুখেই পেলাম বাঘমামার পায়ের কিছু তাজা ছাপ। আমাদের সাথে ছিল সুন্দরবনের অত্যন্ত অভিজ্ঞ গাইড হাসান ভাই, পায়ের ছাপটি দেখে বললেন যে খুব বেশি হলে ঘণ্টা দুই আগের ছাপ, আমরা এগিয়ে যেতে থাকি। পাখির কলকাকলিতে মুখরিত চারিদিকের পরিবেশ। বেশ অনেকটা ভিতরে ঢুকে দেখি যাবার আর রাস্তা নাই, ভাটাতে পানি শুকিয়ে সামনে যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছে, নৌকা ঘুরাতে হবে কিন্তু খালের প্রস্থ এত ছোট যে নৌকা ঘুরানোর মত কোনো জায়গাই নাই, মাঝি ভাই অনেক কষ্ট করেও আমাদের ঈমাকে ঘুরাতে পারল না। আমরা আটকা পরলাম গহিন জংগলের ভিতর।
সম্পূর্ণ অন্যরকম এক অভিজ্ঞতা - চারিদিকে নিস্তব্ধতা, শুধু থেকে থেকে কিছু পাখির কলতান আর যেন আমরা এই পৃথিবী থেকে একদম বিচ্ছিন্ন । এইদিকে দ্রুতগতিতে পানির স্তর আরো নেমে যাচ্ছিল, আর আমরা ধীরে ধীরে নৌকার তলা মাটিতে ঘষা খাওয়ার আওয়াজ পাচ্ছিলাম। যেখানে ৩০ মিনিট আগেও প্রায় বুক সমান পানি ছিল সেখানে এখন পানি এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র হাঁটুর উপর পর্যন্ত। ৮ টা বাজতে চলল, সবারই পেটে ততক্ষণে টান লেগেছে। জঙ্গলের এত ভেতরে মোবাইল নেটওয়ার্ক ঠিকমত কাজ করছে না, এক দাগ মাত্র আছে কিন্তু তা দিয়ে জাহাজের সাথে সংযোগ করা যাচ্ছে না। কথা বলার আগেই বার বার কেটে যাচ্ছে। হাসান ভাই দেখি এইদিকে ঈমার ভিতরে কি জানি খোঁজাখুঁজি শুরু করলেন, জিজ্ঞাসা করতেই বলল অস্থির হয়ো না তো! তোমাদের খাবার ব্যবস্থা করি। এইখানে খাবার পাবেন কোথায়? বলল আমি জাদু জানি। একটু পরে দেখি উনি মাঝিকে নিয়ে নৌকার চুলা ধরিয়েছেন আর নৌকার ভিতর থেকে বের হোল চাল, ডাল, পিয়াজ, মরিচ ইত্যাদি - মাঝিদের খাবারের ইমার্জেন্সি স্টক। উনি মহা উৎসাহে তাই দিয়ে খিচুরি বসিয়ে দিলেন আর আমরা এইদিকে দেখছিলাম ১০-১২টি বানরের কাণ্ডকারখানা। সম্ভবত খিচুরির গন্ধে ওরা চলে এসেছে । গাছের ডালের উপর থেকে উঁকিঝুঁকি মারছে কিন্তু কাছে আসছে না। অনেক চেষ্টা করেও ভাল একটা ছবি নিতে পারলাম না। গাছের ফাঁক দিয়ে শুধু ১০-১২ টা বানরের একবার এইদিকে আরেকবার ওইদিকে জাওয়া দেখলাম। এর মধ্যে একজন জাহাজের সাথে শেষপর্যন্ত কথা বলতে পারল - আমাদের দুরবস্থার কথা জানালো। ওরা বলল টেনশন না করতে, স্পীড-বোট নিয়ে রওয়ানা দিল বলে। হাসান ভাই বলল এত তারাহুরার কিছু নাই আমরা পিকনিক করছি, পারলে কিছু খাবারদাবার আর চায়ের ফ্লাস্ক নিয়ে আসতে। এদিকে খিচুরি হতে হতে প্রায় ৪০ মিনিট মত লাগল, খিচুরি রেডি এইসময় দেখলাম আমাদের ভাবী বীর-দর্পে রাজরানির মত মাছ ধরার ডিঙ্গি নৌকায় করে খাবার দাবার সহ আমাদের ভাইজান সহ আমাদের উদ্ধার করতে আসছেন। খালে ডিঙ্গি নৌকা চলার মত পানিও তখন ছিল না, খালের মুখ থেকে মাছ ধরার এক ডিঙ্গি নৌকা উনি বসে আছেন আর মাঝিরা সহ জাহাজের ৫ জন স্টাফ ওনাকে কাদার উপর দিয়ে টেনে টেনে নিয়ে আসছেন। ভাবি পৌঁছলেন সাথে আমাদের জন্য নাস্তা নিয়ে, কিন্তু ততক্ষণে হাসান ভাই এর খিচুরি হয়ে এসেছে। আমরা ভাবির আনা নাস্তা ডিঙ্গি নৌকার মাঝিদের মাঝে বিতরণ করে খিচুরি আর পিয়াজ-মরিচ ভরতা দিয়ে উদরপূর্তি করলাম। এর মধ্যে হাসান ভাই বললেন এই সুন্দরবনের কাদা চামড়ার জন্য মহৌষধ, দেশের বাইরে এই কাদার অনেক ডিমান্ড আছে - বলেই উনি সাথে সাথে কাদার মধ্যে নেমে গেলেন, উনার পিছনে পিছনে নেমে পড়ল অনন্ত । আমি আর নৌকা থেকে নামলাম না। সারা গায়ে কাদা মাখিয়ে, কাদায় গড়াগড়ি খেয়ে এক একজন আদি-মানব এর রূপ ধারণ করল। কাদা মেখে অনন্ত আবার গাছে চড়ে আমাদের কিছু এক্রবেট করে দেখাল। আমরা ওদের নানা ভঙ্গিমার বিভিন্ন পোজ এর ছবি তুললাম। এইভাবে হাসি খেলায় কেটে গেল ঘণ্টা দুই। জোয়ারের পানি আসা শুরু হয়েছে আবার। ওরা এইবার জোয়ারের পানিতে নিজেদের ধুয়ে পরিষ্কার করে ঈমাতে উঠল। আরো প্রায় ৪০ মিনিট পরে জোয়ারের পানিতে ঈমা ভাসানোর অবস্থায় আসল আর আমরা ৬ঘন্টার অভিযান শেষে জাহাজে ফিরলাম দুপুর ১২টা নাগাদ। এর মধ্যে বাচ্চু ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের সব ফর্মালিটি সেরে, ফরেস্ট গার্ড ও মৌয়ালদের একটা নৌকা সহ জাহাজে ফিরে এসেছে। ঠিক হল আমরা ৩টার দিকে প্রথম বারের মত মধু সংগ্রহ অভিযান এ যাব।
লাঞ্চের পর পরই আমাদের মধু সংগ্রহে যাবার জন্য নিজেকে কিভাবে তৈরি করতে হবে তার জন্য শুরু হল ট্রেনিং সেশন। বনের ভিতর পদে পদে বিপদ, তাই নিজেকে এর জন্য প্রয়োজন মানসিক ও শারীরিক ভাবে নিজেকে প্রস্তুত করে নেয়া। সঠিক ভাবে তা করতে না পারলে শুধু নিজের না দলের জন্যই তা বিপদের কারণ হতে পারে। মধু সংগ্রহে সাধারণত ৪ থেকে ৫ জনের একটি দল হয়। তবে এইবার আমাদের গ্রুপ সাইজ যেহেতু বড় তাই ৪-৫ জন এর দল করলে অনেকগুলি ছাটা মারতে হবে এবং এতে দুই দিন সময়ে প্রত্যেকের ভাগে মাত্র একটি করে ছাটা জুটতে পারে, তার চেয়ে গ্রুপ সাইজ বড় হলে এক এক জনের ভাগে দুইটি ছাটাতে অংশগ্রহণ করা সম্ভব হবে। তাই আমরা ২৪ জনকে ৩টি গ্রুপে ভাগ করে নিলাম, ৮ জন করে ৩টি দল । গ্রুপ-এ, গ্রুপ-বি এবং গ্রুপ-সি, আমি পরলাম গ্রুপ-এ তে। এইবার ছাটাতে যাবার আগের প্রস্তুতির প্রশিক্ষণ, প্রস্তুতিগুলো আমি পয়েন্ট আকারে দিলাম তাতে করে ভবিষ্যতে যারা মধু ট্যুরে যাবেন তাদের জন্য নিচের পয়েন্টগুলি শুধু মনে রাখলেই চলবে না এই প্রস্তুতিগুলো আবশ্যিক -
১। ফুলহাতা মোটা কাপড়ের শার্ট বা গেঞ্জি পরতে হবে।
২। ফুলপ্যান্ট পরতে হবে, মোটা কাপড়ের (জিনস বা গ্যাবারডিনের) হলে ভাল হয়।
৩। পায়ে পড়ার জন্য আর্মিদের গাম-বুট অত্যাবশ্যক।
৪। মাথাসহ মুখমণ্ডল গামছা দিয়ে ভালোভাবে পেঁচিয়ে যেতে হবে, শুধুমাত্র যেন চোখদুটি বের হয়ে থাকে।
৫। কোনো ভাবেই দলছুট হওয়া চলবে না। একবার ছাটা মারা শুরু হলে যত কষ্টই হোক না কেন, হেটে বা দৌড়ে দলের সাথে একত্র হয়ে থাকতে হবে।
৬। সাতার জানা এই ট্যুরের জন্য আবশ্যিক, সাতার না জেনে এই ট্যুরে গেলে শুধু নিজের জন্যই না বরং দলের জন্য বিপদ বয়ে আনবে।
মধু ট্যুরের কয়েকটি স্থানীয় শব্দ (এইগুলি জানা থকলে বর্ণনা বুঝতে সুবিধা হবে।
মৌয়াল - যারা সুন্দরবনের ভিতর থেকে মধু আহরণ করে ।
পোকা - স্থানীয় ভাসায় মৌমাছিকে মৌয়ালরা পোকা বলে।
ছাটা দেওয়া বা ছাটা মারা - বনের ভিতের মধুর চাক খুঁজে বের করা। অত্যন্ত কষ্টসাধ্য কাজ, এর জন্য মাঝে মাঝে গভীর বনের ভিতর দিয়ে মাইলের পর মাইল হেটে হেটে মৌচাক খুঁজে বের করতে হয়। সাধারণত মৌয়ালরা ২টি বা ৩টি দলে বিভক্ত হয়ে মৌচাক খুঁজতে বের হয়। ২ বা ৩ জনে মিলে একটি দল। এক দলের থেকে আরেক দলের দূরত্ব খুব বেশি হয় না, এক দলের লোক আওয়াজ দিলে আরেক দল যাতে তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারে। ২ বা ৩টি দল সমান্তরাল ভাবে ৪০০ থেকে ৫০০ গজ দূরত্বে থেকে মৌচাক খুঁজতে খুঁজতে এগিয়ে চলে। নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করতে তারা মুখ দিয়ে বিশেষ শব্দ করতে করতে সমান্তরাল ভাবে মৌচাকের খোজ করেন।
কারু - মৌচাকে ধোয়া দিয়ে মৌমাছি তাড়ানোর জন্য টাইগার ফার্ন দিয়ে তৈরি ঝোপ এর মশাল, এই ঝোপের মশাল প্রচুর পরিমাণে ধোয়া উদগিরন করতে পারে।
১তারিখ বিকাল ৩টায় শুরু হল আমাদের প্রথম ছাটা মারা, প্রথম গ্রুপেই আমি ছিলাম। জাহাজ থেকে স্পিড-বোটে করে ছোট খালের ভিতর দিয়ে মধুর চাক খুঁজতে খুঁজতে এগিয়ে চলা। ৮ জনের মৌয়াল দলের প্রধান ইব্রাহিম ভাই। প্রায় ২২ বছর ধরে উনি মধু সংগ্রহে সুন্দরবন আসেন। বোটে যেতে যেতে উনার সাথে ছাটা মারা নিয়ে অনেক কথা হচ্ছিল। মধু আহরণ করতে গিয়ে প্রতিবছর বেশ কিছু মৌয়াল শেষ পর্যন্ত আর বাড়ি ফিরতে পারে না, তারা মামার (বাঘের) শিকারে পরিণত হয়। মধু আহরণের সবচেয়ে বড় বাধা বাঘ, পুরো সুন্দরবন এর মধ্যে সাতক্ষিরা রেঞ্জ এ বাঘের হাতে প্রাণ হারানোর হার সবচেয়ে বেশি আর বুড়িগোয়ালিনি পড়েছে এই সাতক্ষিরা রেঞ্জ এর মধ্যে। আর সুন্দরবনের সবচেয়ে বেশি মধু উৎপাদন এই অঞ্চলেই হয়ে থাকে। কোন অঞ্চলে ছাটা দিবে তা কিভাবে ঠিক করা হয় জিজ্ঞাসা করতেই বললেন যে, ওনাদের অভিজ্ঞতা দিয়ে। বনের চারিদিকে নজর রাখতে রাখতে খালের ভিতর দিয়ে নৌকা চালাতে থাকেন। ওনাদের দলের মধ্যে মৌচাক খোজার বিশেষ অভিজ্ঞ একজন থাকেন। আমরা সুবিধার জন্য ওনার নাম দিলাম লোকেটর । ইব্রাহিম ভাই এর বিশেষত্ব হলো মৌচাক কাটায়। মৌচাক খোজার অভিজ্ঞ ব্যক্তি যে অঞ্চলে মনে করেন মৌচাক আছে (সাধারণত গাছের উপর দিকে মৌ মাছিদের উড়া অথবা তাদের গতিবিধি দেখে তা নির্ধারণ করা হয়) সেখানে তার নৌকা থেকে নেমে ছাটা মারা শুরু করেন। কখনো কখনো এই ছাটা মারা ৪-৫ ঘণ্টা ধরে চলে। কখনো ২-১ ঘণ্টার মধ্যে অনেক মধু সংগ্রহ হয়ে যায়। ছাটা মারার সময় তাদের সাথে থাকে - বাঘ তাড়ানোর জন্য হাত বোমা বা পটকা, (বাঘ যেন কাছে না আসে তার জন্য তারা পটকা ফুটাতে ফুটাতে এগিয়ে চলেন) মধু কেটে তা মৌচাক থেকে নামানোর জন্য একটি বেতের গামলা, মধু কাটার জন্য বিশেষ ভাবে তৈরি দা, মধু সংগ্রহের জন্য এলুমিনিয়ামের হাড়ি। একবার ছাটা মারা শুরু করলে তারা সাধারণত মধু দিয়ে হাড়ি ভরতি হওয়ার আগ পর্যন্ত ছাটা মারতে থাকেন। এক এক ছাটায় তারা ৫-৬ টি মৌচাক ভেঙ্গে মধু সংগ্রহ করেন। সব মৌচাকেই মধু পাওয়া যায় না। হয়ত দেখা গেল ৫টি চাক ভাঙলে ৩টি অথবা ৪টি তে মধু পাওয়া যায়। মধু দিয়ে হাড়ি ভর্তি হয়ে গেলে তারা ছাটা শেষ করে আবার নৌকায় ফিরে আসেন এবং পরবর্তী ছাটার জন্য আবার নিজেদের প্রস্তুত করেন।
কথা বলতে বলতে মৌয়াল দলের একজন (যিনি মৌচাক খোজার অভিজ্ঞ লোক), ইব্রাহিম ভাইকে ইশারা করলেন, ভাই বললেন আমাদের এই খানে নামতে হবে বলে স্পিড-বোট ডাঙ্গায় ভিড়াতে বললেন। ডাঙ্গায় আগে মৌয়ালের দল নামলো, আমাদের স্পিড-বোট এ অপেক্ষা করতে বললেন। একটু পরেই পটকা বোম এর বিকট শব্দে অন্তরাত্মা কেপে উঠল। পর পর তিনটি বোম ফাটালো তারা। ইব্রাহিম ভাই আমাদের সাথেই ছিলেন। বললেন এই-জায়গাটা ভালো না, গত মাসে এই জায়গায় মধু কাটতে এসে একজনকে মামা (বাঘে) নিয়ে গেছে, তাই আগে পটকা ফাটিয়ে এই সাবধানতা। আমাদের প্রস্তুত হতে বললেন। আমরা স্পিড-বোট থেকে নেমে নাকে মুখে, মাথায় গামছা পেঁচিয়ে নিজেদের প্রস্তুত করলাম। জাহাজ থেকেই আমরা ফুলপ্যান্ট, ফুলশার্ট এবং বুটজুতো পরে এসেছিলাম। শুরু হলো আমাদের প্রথম ছাটা মারা।
বোট থেকে নেমেই আমরা সবাই একত্র হলাম। সারা সুন্দরবন জুরেই টাইগার ফার্ন, কিন্তু আমরা যেই জায়গায় নেমেছি তার আশেপাশে এই গাছ খুব বেশি নেই, সুতরাং নেমেই আমরা কারু বানানো শুরু করতে পারলাম না, একসাথে একটু এগিয়ে যেতেই পেয়ে গেলাম টাইগার ফার্নের বন। মৌয়ালরা টাইগার ফার্ন কেটে কারু বানানো শুরু করল। কারু বানানো শেষ করে দুটি দলে বিভক্ত হয়ে আমরা গভীর বনের ভিতর দিয়ে হেটে চলেছি। এক দলে ৪জন মৌয়াল আরেক দলে ইব্রাহিম ভাই এবং আর একজন মৌয়াল এর নেতৃত্বে আমরা ৮ জন, আমাদের সামনে পিছনে এক জন করে মোট দুইজন ফরেস্ট গার্ড, মোট ১২জন এর দল। সবার মাথা মুখ পেঁচানো গামছা দিয়ে, দেখে মনে হচ্ছিল যেন একটা ডাকাত দল। আমাদের কারো মুখে কোন শব্দ নাই, শুধুমাত্র ইব্রাহিম ভাই তাদের বিশেষ সাংকেতিক শব্দের মাধ্যমে মৌয়ালদের অপর দলের সাথে সংযোগ রক্ষা করছিলেন। যত জংগলের ভিতরে ঢুকছি তত যেন গভীর হচ্ছে জংগল, সামনে এগুনোর কোন পথ নাই, ইব্রাহিম ভাই দা দিয়ে গাছ কেটে কেটে আমাদের পথ করে দিচ্ছিলেন। বেশিদূর হাটতে হলো না, ১৫ মিনিট হাটার পরই অপর মৌয়াল দল থেকে অন্যরকম একটি শব্দ শুনলাম, ইব্রাহিম ভাই বললেন ওরা মৌচাক পেয়েছে। সংকেত বিনিময় করতে করতে আমরা অপর দলের সাথে মিলিত হলাম। মৌয়ালদের অপর দলটি আমাদেরকে মৌচাক দেখালো, কেওড়া গাছের উপর মাটি থেকে ৬ফুট উপরে একটি ডালে বেশ বড় একটি মৌচাক দেখলাম। আগেই কথা হয়েছিল যে যেহেতু এই দলে বেশিরভাগ ফটোগ্রাফার এসেছে সুতরাং মৌচাক পেলে আগে ফটো তুলতে দিয়ে পরে মৌচাকে ধোয়া দিতে হবে। ইব্রাহিম ভাই বললেন খুব সাবধানে শব্দ না করে এক এক বারে দুই তিনজন করে আপনারা আগে ছবি তুলেন। এর পর প্রায় ৩মিনিট ধরে শোনা গেল শুধু ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক - মৌমাছির গুঞ্জনকেও যেন হার মানায়। এদিকে ইব্রাহিম ভাই আমাদের আর সময় দিতে নারাজ, বললেন পোকা খেপে গেলে আর কারু নিস্তার থাকবে না। কারুতে আগুন দেয়া হল, আমাদের বলা হল যেন আমরা সবাই একসাথে দলবেঁধে এক জায়গায় থাকি। একজন কারু নিয়ে মৌচাকের নিচে ধরলেন আর ইব্রাহিম ভাই আরেকটি কারু নিয়ে ওনার দা ও বেতের ঝুড়ি নিয়ে গাছে উঠে গেলেন। আর বকি দুইজন আরো দুটি কারু জালিয়ে আমাদের দুইপাশে ধোয়া দিয়ে আমাদের ঢেকে রাখলেন। মৌচাকের নিচ থেকে ধোয়া দিতেই এক অভাবনীয় দৃশ্য দেখলাম যা আমার জীবনে আগে কখনো দেখিনি। মৌমাছিতে কালো হয়ে থাকা মৌচাকটি থেকে দল বেধে ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছি উড়ে যাচ্ছে আর ধীরে ধীরে কালো মৌচাকটি একদম ধবধবে সাদা হয়ে গেল। অপরূপ দৃশ্য, যারা চোখে দেখেনি তারা কল্পনাও করতে পারবে না মৌচাকের এই অপরূপ রূপ। আমরা নিচ থেকে দেখছিলাম ইব্রাহিম ভাই এর দা ধীরে ধীরে সাদা মৌচাকটিতে বসে যাচ্ছে আর চাকটি দুইভাগে ভাগ হয়ে গেল। এদিকে আমরা ধোয়ার মধ্যে বসে থাকলেও আমাদের ক্যামেরা কিন্তু থেমে নেই, মৌমাছির গুঞ্জনের মত করেও ক্যামেরাগুলোও ক্রমাগত ক্লিক ক্লিক গুঞ্জন করেই যাচ্ছে। দুই মিনিটের মাথায় ইব্রাহিম ভাই গাছ থেকে নেমে আসলেন আর আমাদের ওনাকে ফলো করতে বললেন। চারটি কারুর ধোয়ার মধ্যে থেকে ওনার পিছনে পিছনে আমরা এগিয়ে যেতে লাগলাম আমদের বোটের দিকে। ১৫ মিনিট পরে ফিরে আসলাম বোট এ। সবাই উৎসুক মধুর চাক দেখার জন্য, কিন্তু ইব্রাহিম ভাই এর কথায় সবাই আমরা নিরাশ। এই চাকে কোন মধু পাওয়া যায় নি। এই চাকটি কাছাকাছি বলে আগেই কোন এক মৌয়ালের দল এটি থেকে মধু কেটে নিয়ে গেছে। এই চাকে আবার ১২ থেকে ১৫ দিন পরে মধু জমবে। যাই হোক কোনরকম দুর্ঘটনা ছাড়াই আমাদের প্রথম ছাটা শেষ করলাম।
আমাদের এইবার জাহাজে ফেরার পালা, কিন্তু কেন জানি এত অল্পসময়ের এডভ্যঞ্চারে মন ভরল না। আমাদের সাথে হাসান ভাই এসেছেন কিন্তু ছাটায় যান নি যেহেতু উনি আমাদের এ গ্রুপের সদস্য না। উনি এসেছেন আমাদের সাহস যোগাতে। স্পিড-বোট এই বসে ছিলেন সারাক্ষণ। আমরা জাহাজে ফিরলেই গ্রুপ-বি বের হবে পরবর্তী ছাটাতে। মন খারাপ করে বসে আছি, মনে হচ্ছিল কেন যে ১৫ মিনিটে মৌচাক পেয়ে গেছি? এর জায়গায় যদি এক ঘণ্টা লাগত মৌচাক পেতে তাইলে মন ভরে জংগলে ঘুরতে পারতাম। হাসান ভাই আমার মন খারাপ দেখে জিজ্ঞাসা করলেন কি হল ? ভাল লাগে নাই? আমি বললাম কি যে বলেন না, ১৫ মিনিট হেটেই মৌচাক পেয়ে গেলাম এইটা কোন ছাটা হল? কি একটু ভেবে বললেন - তোমাদের সময় ছিল দেড় ঘণ্টা কিন্তু তোমরা ১৫ মিনিটেই মৌচাক পেয়ে গেছ। হয় এখন জাহাজে ফিরতে পার অথবা যদি ইচ্ছা কর তাইলে ৪৫ মিনিটের জন্য আরেকটি ছাটা মারার স্পেশাল পারমিশন আমি দিতে পারি তোমাদের। শুনে গ্রুপের সবাই হই হই করে উঠল। আমরা পরবর্তী ছাটা মারার জন্য আর একটি লোকেশন খুঁজতে লাগলাম। স্পিড-বোট চালিয়ে আরো গভীরে যেতে যেতে মৌয়ালের দল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মৌচাক খুঁজতে লাগল। এক জায়গায় উঁচু এক গাছের মাথায় কিছু মৌমাছি উড়তে দেখে ইব্রাহিম ভাই বোট ভিড়াতে বললেন। বোট থেকে নামতে গিয়ে আমাদের গ্রুপের একমাত্র বিদেশি গেস্ট ওয়ান্ডা (আমি নাম দিয়েছিলাম ওয়ান্ডার ওমেন) প্রথম দুর্ঘটনা ঘটায়। বোট থেকে লাফ দিয়ে নামার সময় পিছলা খেয়ে একবারে কাদায় ধপাস। শুধু বসে পড়া নয় কাদার মধ্যে একবারে শুয়ে পরল । তাড়াতাড়ি আমরা দুইজনে মিলে ওনাকে তুললাম। ওনাকে তুলতে তুলতেই ইব্রাহিম ভাই বললেন আপনারা সবাই বোটে উঠেন তাড়াতাড়ি - এইখানে থাকা নিরাপদ নয়। এই মৌচাক আমাদের আগে আরেক গ্রুপ ভেঙ্গে গেছে, মৌমাছিরা খেপে আছে। আমরা আবার বোটে উঠে নতুন মৌচাকের সন্ধানে বের হলাম। এর মধ্যে ইব্রাহিম ভাই এর সাথে কথা বলে জানলাম যে এই অঞ্চলে মৌমাছির কামড়ে মানুষ মড়ার কোন রেকর্ড নাই তবে মৌমাছি কামড়ালে প্রচণ্ড ব্যথা হয়, এবং এর কোন ঔষধ নাই, একমাত্র কামড়ের জায়গায় মধু মাখলে একটু আরাম হয়। ভয় শুধুমাত্র মামাদের (বাঘ) নিয়ে। কথা বলতে বলতে প্রায় আরও ২০মিনিট স্পিড-বোট চালিয়ে আসার পরে আমাদের লোকেটর মৌয়াল বলল এক জায়গায় নেমে পরতে। তবে সাবধান করল যে এই স্থানে মৌচাক পেতে কিন্তু অনেকদূর হাটতে হবে। আমাদের আবার হাটার বা দৌড়ানোর সমস্যা কি? শুরু হলো আমাদের দ্বিতীয় ছাটা মারা।
এইবার যেখানে নেমেছি তা যেন আগের জায়গার থেকেও দুর্গম লাগছিল। ঢোকার মুখে অরণ্য এইখানে যেন প্রাচীর তুলে আছে। আগের মতই আবার আমরা একই ভাবে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলাম। ইব্রাহিম ভাই আগে আগে দা দিয়ে সামনের জংগল পরিষ্কার করতে করতে এগুচ্ছিলেন আর আমরা সবাই তার পিছনে পিছনে। ৫-৭মিনিট এইভাবে পথ চলার পর গরানের বন শেষ হয়ে গেল কিন্তু সামনে পড়ল বিশাল এক টাইগার ফার্ন এর মাঠ। ইব্রাহিম ভাই হঠাৎ থমকে গেলেন। কি এক সাংকেতিক শব্দ করলেন, মৌয়ালদের অপর গ্রুপ থেকেও অনুরূপ শব্দ ভেসে আসল। ইব্রাহিম ভাই দেখি দুইটা পটকা ফাটালেন পর পর, শব্দে আমাদের কানে তালা লেগে গেল। একটু পরেই দেখি ওইদিক থেকেও দুইটি পটকার শব্দ ভেসে আসল। হাতে করে আরও কয়েকটি পটকা রেডি করে উনি ফার্ন বনের ভিতর দিয়ে এগোতে লাগলেন। ফরেস্ট গার্ডদের বললেন বন্দুক লোড করে রেডি রাখতে। এ কিসের আলামত তা কেবল আমিই বুঝতে পেরেছি (এই ঘন টাইগার ফার্ন এর এত বড় মাঠ আর ঘন জঙ্গল মামাদের খুবই প্রিয় জায়গা - দুর্ঘটনা ঘটার এর চেয়ে উৎকৃষ্ট জায়গা আর হয় না) । অন্যরা যাতে টের না পায় বা ভয় না পায় তাই আমি কানে কানে ইব্রাহিম ভাই এর কাছে বললাম, এই মাঠ না পার হয়ে ঘুরে গেলে ভাল হত না? উনি বললেন আপনি বুঝতে পেরেছেন না? কিন্তু উপায় নাই, অনেক ঘুরে যেতে হবে আর মাঠ পার হয়ে আরেকটু সামনে গেলেই বোধহয় মৌচাক এর দেখা পাব। কিছু মৌমাছি দেখছিলাম মাঠ পার হয়ে উড়ে যাচ্ছে। আল্লাহ ভরসা চলেন আগাই। যেতে যেতে উনি আরো ৪টি বোমা ফাটালেন। আমরা সবাই খুব দ্রুত হাঁটছিলাম আর শব্দ করে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলাম। আমাদের মধ্যে একমাত্র খোকন ভাই বোধহয় আমার মত আসল ঘটনা বুঝতে পেরেছিলেন, তাই ওনার গলার ভয়েজ ছিল সবচেয়ে বেশি। এই মাঠ পার হতে আমাদের প্রায় পাঁচ মিনিট লাগল, মাঠ পার হওয়ার পর আমার গায়ের সব লোম দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। কি পার হয়ে আসলাম তা শুধু আমিই জানি। আল্লাহর কাছে লাখো শুকুর যে কোন দুর্ঘটনা ঘটে নাই। মাঠ পার হয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছি, কিছুদূর যাবার পরে দেখি জোয়ারের পানিতে সামনের প্রায় সিকি মাইল পানি আর পানি, খুব বেশি গভীর না তা বুঝতে পারছিলাম, ম্যানগ্রোভের শ্বাসমূল পানির উপর দিয়ে দেখা যাচ্ছিল। ফিরে যাবার পথ নেই, সামনে আগাতেই হবে। এ যেন ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত আগুনে ঝাপ দেয়া। একটু একটু করে পানি ভেঙ্গে এগুতে থাকি। কোথাও উঁচু কোথাও নিচু, কোথাও গিরা পানি তো কোথাও হাঁটু পানি আবার মাঝে মাঝে ডুবে যাচ্ছিলাম কোমর পানিতে, এর মধ্যে যন্ত্রণা আবার ম্যানগ্রোভের বড় বড় চোখা আগাগুলি, বুটজুতোর নিচে মট মট করে ভাঙছিল ওইগুলা। এখন বুঝতে পারছি আর্মিদের এই প্রায় হাঁটু পর্যন্ত গাম-বুট কেন এই ট্যুরের আবশ্যিক অংশ । ভর দিয়ে ব্যালেন্স রাখার জন্য ইব্রাহিম ভাই আমাদের প্রত্যেককে একটি করে গাছের ডাল কেটে লাঠি বানিয়ে দিলেন। কোনরকম ৭-৮মিনিট অক্লান্ত পরিশ্রম করে ম্যানগ্রোভের এই অংশ পার হলাম। না কোন দুর্ঘটনা ছাড়া এই অংশ পার হওয়া গেল না। আমাদের ওয়ান্ডার ওমেন এবং মনি আপা দুই জনেই এর মধ্যে একবার করে আছার খেয়ে ফেলেছেন । মনি আপা যদিও বেশি ব্যথা পান নি কিন্তু ওয়ান্ডা ভালই ব্যথা পেয়েছেন। এই বৈতরণী পার হওয়ার পর আরো প্রায় ১০ মিনিট হাঁটলাম। তবে এই পথ এত বেশি দুর্গম নয়। মোটামুটি ঘন জংগল ছিল তাতে আমাদের বেশি অসুবিধা হচ্ছিল না। হঠাৎ করে মৌয়ালদের আরেক গ্রুপ থেকে কিছু সাংকেতিক শব্দ ভেসে আসল। ইব্রাহিম ভাই বললেন আপনাদের কষ্ট সার্থক হয়েছে। আমরা আরেকটি মৌচাকের সন্ধান পেয়েছি। সংকেত বিনিময় করতে করতে আমরা ওই গ্রুপের সাথে মিলিত হলাম। চারিদিক ঘিরা একটি ঝোপের ভিতর একটি নিচু কেওরা গাছ কিন্তু গাছটি বেশ মোটা, মাটি থেকে মাত্র ৩-৪ হাত উপরে বিশাল আকৃতির একটি মৌচাক। যথারীতি ইব্রাহিম ভাই ফিসফিস করে আমাদের বললেন ফটো-সেশন শুরু করতে। আমাদের এইখানে পৌঁছানোর আগেই অন্য গ্রুপের মৌয়াল ভাই এরা কারু বানিয়ে রেডি হয়ে রয়েছে। একজন শুধু বললেন খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে, পোকারা খুব খেপে আছে। আমি ছবি তুলতে তুলতে প্রায় মাটিতে শুয়ে আছি। আমার আগেই ফটোগ্রাফার ভাই এরা সব জায়গা দখল করে আছে। ছবি তোলার জন্য আমি কোন জায়গাই পাচ্ছি না। হাতে আমার দুটি ক্যামেরা, একটি ডিজিটাল আরেকটি ভিডিও। মাইকী অনেক লম্বা আর দুই পা ফাঁক করে এক মনে তার ক্লিক ক্লিক করে যাচ্ছে, আমি ওর দুই পায়ের ফাঁক দিয়ে শুয়ে পরলাম মাটিতে, মনে হলো এর চেয়ে ভালো আর যায়গা হতে পারে না আমার জন্য। এক হাতে ভিডিও ক্যামেরা মৌচাকের দিকে জুম করে ধরে রেখে আরেক হাতে ডিজিটাল ক্যামেরা টিপতে লাগলাম ক্লিক ক্লিক করে। এইবার ইব্রাহিম ভাইকে গাছে উঠতে হল না, একজন নিচে ধুয়া দিল - মৌমাছির দল আগের মতি এক সাথে মনে হলো চাক ছেড়ে সব উড়ে গেল আর আরেকজন তার সুনিপুণ হাতে ১ মিনিটের মধ্যে মধুর চাক কেটে নিয়ে আসলেন। বেতের বলের থেকে মধুর হাড়িতে মধু ও চাক ঢালার সময়ও পেলেন না আমাদের চারিদিকে ঘিরে ধরলেন কারুর ধোয়া দিয়ে। আর একটু একটু করে পিছাতে বললেন। কিছুদূর গিয়ে বললেন এইবার আল্লার নাম নিয়ে দৌড় দেন । পোকারা খেপে গেছে, আক্রমণ করবে। আগের রাস্তায় ফিরে না গিয়ে উনি আমাদের নিয়ে চললেন নতুন রাস্তায়, যে দিক দিয়ে শর্ট কাটে খালের পার পৌঁছানো যায়। প্রায় ২০ মিনিট দৌড়ে আমরা খাল পারে আসলাম, মৌয়ালরা এখনো তাদের হাতের কারু ছাড়ে নাই। এখনো ওগুলো থেকে ধোয়া উঠছে। মৌয়ালদের একজন তাদের সাংকেতিক ভাসায় চিৎকার করে কি জানি ম্যাসেজ পাঠাল, একটু পরেই দেখি হাসান ভাই তা স্পিড-বোট সহ আমাদের উদ্ধার করতে হাজির।
এই চাক থেকে আমাদের সংগ্রহ হয়েছে প্রায় দুই কেজি মধুর । আমরা আবার সবাই ঝাঁপিয়ে পরলাম বেতের বলে রাখা মধুর চাক এর ছবি তুলতে। এর পর খোকন ভাই কৃপণের মত আমাদের ছুড়ি দিয়ে এক টুকরা এক টুকরা করে কেটে খেতে দিল। - ওহ যেন অমৃত খেলাম। চাক থেকে কেটে এই আমার প্রথম মধু খাওয়া। ওনার কাছ থেকে চেয়ে আর মাত্র একটি টুকরা পেলাম। বাকি গুলো উনি বোতল বন্দি করে ফেললেন। মজার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে করতে আমরা জাহাজে ফিরে এলাম। এই ট্যুরে আমাদের এলোকেট করা সময় এর চেয়ে প্রায় ৩০ মিনিট সময় বেশি লেগে গেল। কি আর করা। এই দিকে গ্রুপ-বি আমাদের জন্য অধির আগ্রহে বসে আছে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আমাদের এক এক জনের চেহারা হয়েছে দেখার মত। গ্রুপ - বি আমাদের ধরার জন্য ঈমা নিয়ে খানিকটা এগিয়ে এসেছে। আমরা ওদের স্পিড-বোট দিয়ে দিয়ে ঈমাতে করে জাহাজে ফিরলাম। যে জায়গায় ওরা নেমেছে ওইখানে দেখলাম কিছু বানর এক গাছ থেকে আরেক গাছে লাফ দিয়ে পালাচ্ছে। পরে জানতে পারি যে গ্রুপ-বি সেই সন্ধ্যায় আর কোন মৌচাক খুঁজে পায় নি।
সন্ধ্যা থেকে ডিনারের আগ পর্যন্ত আমরা সবাই ব্যস্ত ছিলাম যার যার ক্যামেরার ছবি ডাউন-লোড করতে, সবাই মিলে সবার ছবি দেখছিলাম। মোটামুটি সবার ক্যামেরাতেই প্রায় একই রকম ছবি উঠেছিল, ছবিগুলো একসাথে করলে কোনটা যে কার ক্যামেরাতে তোলা তা পরে আর আইডেন্টিফাই করার কোন উপায় থাকবে না। সবাই মোটামুটি বেশ ভালই ছবি পেয়েছে। আমাদের গ্রুপ-এ এর আজকের অভিযান সবদিক দিয়েই সার্থক হয়েছে। রাতে ডিনার সেরে সবাই মিলে ছাদে বসলাম। অনন্ত, মিতু , জাহেদ ওরা সবাই মিলে গান ধরল, আমরা ঘুমাতে গেলাম প্রায় ১টারও পরে - তখনো ওদের গানের আসর পুরো জমজমাট।
পরদিন সকালের শিডিউল ছিল গ্রুপ-সি এর, যথারীতি ভোর ৬টায় ওরা স্পিড-বোট নিয়ে জংগলে চলে গেল। আমি ঘুম থেকে উঠে গিয়েছিলাম ৬টারও অনেক আগে, মনে একটু বাসনা ছিল যদি গ্রুপ- সি এর কেউ ঘুম থেকে না উঠতে পারে তাইলে আমি শূন্যস্থান পূরণ করব। আমার আশায় গুড়ে-বালি দিয়ে এই দলের সকল সদস্যই ভোরের ছাটায় চলে গেল। ভোরবেলার সুন্দরবনের কোন তুলনা হয় না। নানারকম পাখির কিচিরমিচির, সূর্যদেবের উদয়ন। সূর্যোদয়ের ছবি তুলতে দেখি অনেকেই ইতিমধ্যে জাহাজের ছাঁদে উঠে এসেছে। এর মধ্যে দেখি আরো অনেকগুলো মৌয়ালদের নৌকার সারি আমাদের ছাড়িয়ে গভীর বনের দিকে যাচ্ছে। আমরা নাস্তা করতে করতে ৮টার দিকে গ্রুপ- সি ফিরে আসলো, সবাই উৎসুক হয়ে স্পিড-বোট ঘিরে ধরলাম। ওরাও সার্থক হয়ে ফিরেছে। প্রায় ২ কেজি মধু নিয়ে ফিরেছে। জিজ্ঞাসা করলাম এডভেঞ্চার কেমন হল? সবার চোখেই তৃপ্তির আলো, এক কথায় বলল - অসাধারণ। এইবার আবার গ্রুপ- বি এর পালা, যেহেতু কাল সন্ধ্যায় ওদের ট্রিপ সার্থক হয় নি তাই এবার শিডিউল চেঞ্জ করে আমাদের গ্রুপের বদলে গ্রুপ - বি কে আবার সুযোগ দেয়া হল। ১০টার দিকে এই গ্রুপ ফিরে আসলে আবার আমাদের পালা। গ্রুপ- বি ১০টার মধ্যেই ফিরে আসল ১কেজি মধু নিয়ে। আজ দেখি সকাল থেকেই সার্থকতার দিন শুরু হলো। কি জানি আমাদের কপালে কি আছে। আমরা সবাই তৈরি হয়ে সাড়ে দশটার দিকে বের হয়ে গেলাম, এইবার আর স্পিড-বোট নিয়ে না - আমরা ঈমা নিয়ে বের হলাম। যেহেতু ঈমার ধারণ ক্ষমতা বেশি তাই হাসান ভাই বললেন অন্যান্য গ্রুপ এর সদস্যরাও একসাথে যেতে পারে , কিন্তু শর্ত হলো তাদের ঈমাতে বসে থাকতে হবে। শুধু গ্রুপ - এ এর সদস্যরাই ছাটাতে যাবে। অন্যান্য দুই গ্রুপ থেকেই দেখলাম অনেকে বনে যাবার ব্যাপারে আগ্রহী। জাহাজে বসে না থেকে প্রায় ১৭-১৮জন মত আমরা ঈমাতে গিয়ে উঠলাম। এর মধ্যে আজকে আর মৌয়ালরা প্রথম গ্রুপের সাথে জাওয়ার পর আর বোটে উঠেনি, তারা তাদের ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে প্রথম গ্রুপের সাথে চলে গেছে আরে পরবর্তী গ্রুপ আসার আগে পর্যন্ত তার বনের ভিতর তাদের ডিঙ্গি দিয়ে মৌচাক কোথায় কোথায় থাকতে পারে তা খুঁজে দেখে স্থান নির্ধারণ করছিল। তাতে পরবর্তী গ্রুপের জন্য সময়ও কিছুটা বাঁচছিল ।
এই ছাটাতে আবার গ্রুপ - এ এর টার্ম, আমরা ঈমা নিয়ে খালের ভিতরে এগিয়ে ১১টার দিকে মৌয়ালদের নৌকার দেখা পেলাম। আগের গ্রুপ উঠে যাওয়ার পর তারা প্রায় ১ ঘণ্টা সময় পেয়েছে এবং এই সময়টা তারা কাজে লাগিয়ে ৩টি মৌচাক খুঁজে রেখেছে আমাদের জন্য যাতে আমাদের ছাটাতে গিয়ে বেশি খোঁজাখুঁজি করতে না হয়। আমরা আসার পর পরই ছাটাতে বের হয়ে গেলাম। ইব্রাহিম ভাই আমাদের নৌকায় উঠে বললেন এইবারের মৌচাকের লোকেশন খুবই বাজে এবং দুর্গম, সুতরাং মেয়েদের এই জায়গায় যেতে কিন্তু খুব কষ্ট হবে। শুনে মনি আপা আর এই ছাটাতে যাবার ব্যাপারে উৎসাহিত হলেন না। ওনার সাথে আমাদের গ্রুপ এর আরো দুইজন নিরুৎসাহ দেখালো। কিন্তু আমাদের ওয়ান্ডার ওমেন - ওয়ান্ডাকে কোনভাবেই নিরুৎসাহিত করা গেল না। হাসান ভাই বললেন যেহেতু জায়গা খালি আছে তাহলে অন্য গ্রুপ এর কেও উৎসাহী হলে আমাদের গ্রুপ এর সাথে যেতে পারে। এই গ্রুপে আমাদের সাথে সঙ্গী হল অনন্ত আর জাহিদ। ওয়ান্ডা গ্রুপ এর একমাত্র মেয়ে। এটি ছিল আসলেও একটি দুর্গম পথ। নৌকা থেকে নেমেই বনে ঢুকাই ছিল কষ্টসাধ্য ব্যাপার। আমাদের নৌকা যেখানে ভিড়েছিল সেটি ছিল বনে ঢুকার মুখে প্রায় ৮-১০ফুট খাড়া পাড়। আমরা মাটিতে নামলাম না বলে বলতে হয় হাঁটু পরিমাণ কাদায় নামলাম। এখন এই পাড় বেয়ে কাদা ভেঙ্গে ১০ফুট উপরে উঠতে হবে। মৌয়াল ভাইরা আগেই আমাদের জন্য ডাল কেটে লাঠি বানিয়ে রেখেছিল, এই লাঠি ছাড়া এই পথ বেয়ে উঠতে গেলে আসলে কাদার উপরে হামাগুড়ি দিয়ে উঠতে হত। লাঠি থাকা সত্ত্বেও মৌয়াল ভাইদের সহযোগিতায় একজন আরেকজনকে ধরে আমরা চেইন বানিয়ে আস্তে আস্তে পাড় বেয়ে জংগলে উঠলাম। ১০ফুট উঠতে সময় লাগলো প্রায় ১০ মিনিট। বনে উঠে প্রায় ৫ মিনিট চলার পরে যে পথ দেখলাম তা আরও ভয়ংকর - পার হতে হবে আরও একটি খাড়া খাড়ির খাল, মনে হয় যেন ইংরেজি এস শেপের একটি গর্ত । ৮ফুট গভীর হয়ে নিচে নেমে গেছে আবার এই গর্ত দিয়ে অনেকদূর (প্রায় ১০০গজ) গিয়ে এস পার হয়ে গিয়ে অন্যদিকে আবার খাড়া ৮ফুট উঠতে হবে। ভাগ্য ভাল যে এখন পুরা ভাটা, জোয়ারের সময় হলে এটি সাতরে পার হতে হত। কিন্তু এখনো বা খারাপ কি, খালের নিচে একটু পানি বইছে ঝিরি আকারে। বিকল্প কোন পথ না থাকায় আমাদের নেমে যেতে হল খাড়া খালের মধ্যে, কোথাও কোথাও হাঁটু কাদা ছাড়িয়ে ঊরু পর্যন্ত ডুবে যেতে লাগল। কোন মতে দুই হাতে লাঠি ভর দিয়ে অনেক কষ্টে পা টেনে টেনে এক পা দু পা করে এগোতে লাগলাম। ১০০গজ যেতে প্রায় ১৫-২০ মিনিট লেগে গেল। আবার উঠে বনে ঢুকে ৫ মিনিট যেতেই সামনে পড়ল আমাদের অকাংখিত মৌচাকটি, যেটি মৌয়াল ভাইরা আগে থেকেই আমাদের জন্য খুঁজে বের করে রেখেছিল। ইব্রাহিম ভাই বললেন ভাইরা খুব সাবধান, পোকারা কিন্তু খুব গরম হয়ে আছে (খেপে আছে)। কোন শব্দ করা চলবে না। আমরা আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে ক্যামেরা নিয়ে মৌচাকের কাছাকাছি যাচ্ছি, হায়দার একদম কাছে গিয়ে ছবি তুলতে তুলতে ধুপ করে মাটিতে পরে গেল। কারুতে তখন আগুন মাত্র দেয়া হচ্ছিল, এর মধ্যেই মৌমাছিরা উড়ে আসা শুরু করল আমাদের দিকে, আমি মাত্র ক্যামেরা খুলে একটি ছবি তুলতে পেরেছি। হঠাৎ মনে হোল আমার সারা শরীর অবশ হয়ে গেছে, গামছার উপর দিয়ে কপালে মনে হল কেউ যেন আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। তার পর মনে হোল হাত যেন আমার অবশ, হাতেও কামড় খেলাম; সে যে কি ভয়াবহ যন্ত্রণা তা যারা মৌমাছির কামড় খায় নাই তারা কখনো চিন্তাও করতে পারবে না, এগুলো পোষ মানা চাষ করা সাধারণ মৌমাছি না এগুলোকে বলে সুন্দরবনের জায়েন্ট হানি বি। দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম - শুধু আমার সামনে দেখলাম জাহিদ ভাই শিভারিং করছে আর আহ উহ বলে কাৎরাচ্ছে। হঠাৎ তখন সামনে কারুর ধোয়া দেখতে পেয়ে সাবকন্সাস ভাবেই হয়তোবা অন্ধের মত ধোয়ার নিচে ঢুকে গেলাম একজন মৌয়াল ভাইকে জড়িয়ে ধরে। মৌয়াল ভাই বললেন ভাইরা পালান, নাইলে বাচার কোন উপায় নাই। আমি প্রায় ওনাকে জড়িয়ে ধরে রেখেই কারুর ধোয়ার আড়ালে থেকে ওনার পিছনে পিছনে দৌড়াতে লাগলাম। দৌড়াতে দৌড়াতে সামনে গিয়ে একবারে পিছলা খেয়ে আবার ঐ ভয়ংকর খালের ভিতর পড়লাম। কোমর পর্যন্ত ডেবে গেল মনে হয়, মৌমাছির কামড়ে চোখে কিছুই দেখছি না, কে জানি আমাকে ওইখান থেকে হাত ধরে টেনে নিয়ে চলেছে। আমার দুই কাঁধে দুই ক্যামেরা, একটি ডিজিটাল আরেকটি ভিডিও ক্যামেরা। কিভাবে খাল পাড় হয়েছি আর কিভাবে কার হাত ধরে বনের ভিতর দিয়ে ছুটে নদী পারে এসেছি তা এখনো জানি না। মৌয়াল ভাইদের একজন সেদিন আমাকে টেনে নিয়ে না আসলে কি যে হত তা আমার জানা নাই। আমরা সবাই কোন মতে টেনে হিচরে ঈমাতে উঠতেই নৌকার সবাই বুঝে গেছে ঘটনা। পোকারা তখনো আমাদের পিছনে পিছনে এতদূর উড়ে চলে এসেছে। মৌয়ালরা বলল তাড়াতাড়ি এইখান থেকে নৌকা নিয়ে নদীর গভীরে বাতাসের মধ্যে চলে যেতে হবে, নাইলে আজ আর কারও রক্ষা নাই। আমরা ঈমা ছেড়ে দিয়ে মাঝ নদীতে চলে আসলাম। নদীর বাতাসে কিছুদূর নৌকা চালিয়ে গিয়ে অন্যপাড়ে দাঁড়ালাম। হাসান ভাই সবাইকে মৌমাছির কামড়ের স্থানগুলোতে মধু লাগাতে বলল। মধু লাগানোর পরে মনে হোল যেন ব্যথা একটু সহনীয় পর্যায়ে এসেছে। এতক্ষণে খেয়াল হল আমার ক্যামেরার কথা - ক্যামেরার অবস্থা কি? ক্যামেরাগুলো তখনো আমার দুই কাঁধে ঝুলছিল। এক এক করে নামাতেই আমার মনটা হু হু করে কেঁদে উঠল। দুটি ক্যামেরাই কাদা মাখানো - ভিডিও ক্যামেরাতো একদম কাদা দিয়ে ডুবানো এই ক্যামেরা দিয়ে আর ভিডিও করার প্রশ্নই উঠে না আর ডিজিটালটির শাটারের দিকে শুধু একটু কাদা মাখা। দৌড়ে খালে পড়ার সময়ই ক্যামেরা গুলোর বারোটা বেজেছে। জাহিদ ভাই বললেন কড়া রোদে আগে শুকাতে দেন পরে দেখা যাবে কি অবস্থা। আমরা যারা ঈমাতে উঠতে পেরেছিলাম তাদের নিয়েই ঈমা তাড়াহুড়া করে এইপাড়ে চলে এসেছিল, আর মৌয়ালদের নৌকায় আমাদের অন্য গ্রুপের আরো কিছু সদস্য বসে ছিল (যারা আমাদের গ্রুপের সাথে ছাটায় জায় নি) আর মৌয়ালদের নৌকা আমদের সাথে না গিয়ে অন্য আরেকদিকে চলে গিয়েছিল মৌমাছির হাত থেকে বাচার জন্য। এইবার মাথা গোনার পালা কয়জন কোন নৌকায় উঠেছে। শিমুল ভাই মিসিং। শিমুল ভাই যদিও আমাদের গ্রুপে ছিলেন না তবে মৌয়ালদের নৌকায় গিয়ে বসে ছিলেন। আর ভাবি ছিলেন ঈমাতে। এদিকে চিন্তায় ভাবি অস্থির হয়ে রয়েছেন। মৌয়ালদের নৌকা তখনো আমাদের কাছে আসে নাই। আমরা দূর থেকে দেখছিলাম সেটি ভেসে অন্যদিকে যাচ্ছিল। ঈমা হল ইঞ্জিন চালিত আর মৌয়ালদের নৌকা হাতে বাওয়া সুতরাং ওদের তো দেরি হবেই। শিমুল ভাই ওই নৌকায় আছে কিনা তা দেখার জন্য ভাবি অস্থির হয়ে রয়েছেন। এদিকে মৌয়ালদের নৌকা আমাদের দিকে না এসে দেখি আরেকদিকে যাচ্ছে, দূর থেকে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। অপর পাড় ঘেঁষে কিছুদূর নৌকাটি চলার পরে দেখতে পেলাম আবার পাড়ে ভিড়ছে, সমস্যা কি কিছুই বুঝতে পারছি না। একটু পরে দেখলাম পাড় থেকে কাদের যেন তুলে নিচ্ছে ওরা। তুলে নিয়ে আরেক দিক দিয়ে আবার ওরা বনে ঢুকে গেল। প্রায় ৩৫ মিনিট পরে মৌয়ালদের নৌকাটি ঈমার কাছে ফিরে আসলে জানা গেল আসলে দল ভাগ দুটি হয় নাই - তিনটি ভাগ হয়ে গেছে। দৌড়াদৌড়িতে বুঝা যায় নাই, খোকন ভাই মৌয়ালদের মধ্যে একজন নিয়ে আরো দুইজন সহ কোন নৌকাতেই উঠেন নাই। উনি আমাদের সাথে না এসে আরেক দিকে দৌড় দিয়ে ঘুরা পথে নদী পাড়ে এসেছিলেন । মৌয়ালদের নৌকা ওনাদের দেখতে পেয়ে ঘুরিয়ে তুলে এনেছে। কিন্তু মজার বিষয় হলো এত ঘটনা ঘটার পরও ইব্রাহিম ভাই কিন্তু ঠিকই ঐ মৌচাক ভেঙ্গে মধু নিয়ে এসেছেন। আমরা যখন পালাতে ব্যস্ত তখন উনি মধুর চাক ভাঙছিলেন। আর খোকন ভাইদের ওঠাতে ওঠাতে অনেকটা দুরে সরে গিয়েছিলেন বলে এবং সেখানে মৌমাছিগুলো আর ওনাদের দিকে আসে নাই বলে ইব্রাহিম ভাই ওনাদের নিয়ে আমাদের জন্য দেখে রাখা আরও দুইটি মৌচাক ভেঙ্গে মধু নিয়ে এসেছেন তাই এত দেরি হল। মৌয়ালদের নৌকা আসতে দেখা গেল আমাদের শিমুল ভাই নৌকায় বসে আছেন। ভাবির মুখে হাসি ফিরে এলো। এখন আমরা কি করব - জাহাজে ফিরব? জাহাজ আমাদের কাছ থেকে প্রায় ৩০মিনিটের পথ, জাহাজে ফিরে গিয়ে আবার আমাদের এই পথ দিয়েই আরো গভীরে যেতে হবে। হাসান ভাই বললেন তার দরকার নাই, উনি মোবাইলে জাহাজের সাথে যোগাযোগ করে জাহাজকে সামনে নিয়ে আসতে বললেন। জাহাজ আসতে আসতে আমরা সবাই মিলে আজকের সংগ্রহ করা ৩টি চাক থেকে (প্রায় ৬কেজি) মধু টেস্ট করতে বসে সবাই মিলে প্রায় এক কেজি মধু সাবাড় করে দিলাম। হাসান ভাই বলছিলেন
তোমরা এই দুপুর বেলায় এত মধু খেও না, গরমে টিকতে পারবে না। মিতু একাই প্রায় ১০০গ্রাম এর উপরে খেয়ে ফেলেছে আর বলছে মধুতে বেশি গরম লাগলে পানিতে নেমে বসে থাকবে তাও এই বনে বসে এই মধু খাব নাতো কখন খাব, ওর সাথে সাথে খোকন ভাইও সমান তালে চালিয়ে গেল, আমিই বা বসে থাকি কেন? কথা বলতে বলতেই কয়েক চামচ সাবাড় করে দিলাম। মৌমাছির কামড় খেয়েছি, ক্যামেরার বারটা বাজিয়েছি শুধু এই মধু সংগ্রহে এসে তাই যেন রাগ করে আরো বেশি খেয়ে ফেললাম। দেখা গেল এই ছাটায় কম বেশি প্রত্যেকে মৌমাছির কামড় খেয়েছে। সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থা হায়দার ও জাহিদের। গল্প করতে করতে জাহাজ চলে আসলো আর ঘটনাবহুল আমাদের সকালের সেশনের ছাটা শেষ হল।
আমরা জাহাজের সাথে ঈমা এবং মৌয়ালদের নৌকা বেধে নিয়ে ঐ স্থান থেকে আরও আধাঘণ্টার পথ এগিয়ে থাকলাম বিকালের ছাটা মারার জন্য। জাহাজে উঠেই আমি আমার ভিডিও এবং ডিজিটাল দুইটা ক্যামেরাই পুরাপুরি খুলে রোদে শুকাতে দিলাম। এর মধ্যে দুপুরের খাবার খেয়ে আমরা সবাই বসে লাউঞ্জের মধ্যে গল্প করছিলাম। জাহাজ নদীর মাঝামাঝি এংকর করা আর মৌয়ালদের নৌকা বনের কাছে খুঁটি দিয়ে বাধা। হঠাৎ করে দেখি জাহাজের লাউঞ্জের বাইরে একটা দুইটা করে মৌমাছি উড়া-উড়ি করছে, মৌয়ালদের নৌকার দিকে চোখ যেতেই দেখি মৌয়ালরা নৌকা ছেড়ে দিয়েছে, আর একজন মাত্র মৌয়াল মাথা মুখ সব গামছায় ঢেকে নৌকা বাইছে আর বাকিরা কুমিরের ভয় উপেক্ষা করে সবাই নৌকা ধরে সাতার কেটে জাহাজের দিকে এগুচ্ছে। হাসান ভাই বললেন ওদের মৌমাছি আক্রমণ করেছে, তাড়াতাড়ি উনি জাহাজ থেকে স্পিড-বোট পাঠালেন মৌয়ালদের উদ্ধার করতে। স্পিড-বোট ওদের টেনে নিয়ে জাহাজের কাছে চলে এসেছে কিন্তু মৌমাছিরা পিছু ছাড়ছে না, এইদিকে আমরা জাহাজের লবির সব জানালা বন্ধ করে বসে আছি, জানালার কাচের উপর দিয়ে মৌমাছি আমাদের ঘিরে রেখেছে, মৌয়ালরা কোনমতে জাহাজে উঠে মনে হয় প্রাণ বাঁচিয়েছে। এক এক জনের চেহারার দিকে তাকানো যায় না, মৌমাছি কামড়িয়ে সবার চোখ-মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। মৌমাছির আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে আমরা জাহাজ ছেরে দিলাম। প্রায় ১৫ মিনিট জাহাজ চালানোর পরে আস্তে আস্তে মৌমাছি সরে গেল। আমরা আরও ১০মিনিট জাহাজ চালিয়ে আরেকটু সেইফ জায়গায় গিয়ে এংকর করলাম।
আমার দুটি ক্যামেরাই রোদে ভালো করে শুকিয়ে নিয়ে, ক্লিনার দিয়ে মুছলাম, কিন্তু দুর্ভাগ্য যে ভিডিও ক্যামেরা কোন সাড়া দিল না। মনে হয় একবারেই গেছে। আর ডিজিটালটা ব্যাটারি বদলানোর পরে কাজ করছিল তখনকার মতো।
বিকালে ৩টার দিকে আজকের শেষ ছাটা মারার জন্যে বের হওয়ার কথা, মৌয়ালরা জানালো যে এই অঞ্চলে কেন জানি পোকারা খুব গরম হয়ে আছে, আজকের ছাটা মারা খুব রিস্কি হয়ে যাবে। আর আমাদের গ্রুপ সাইজ বড় হওয়ায় মৌয়ালদের পক্ষে আমাদের সবাইকে ধোয়া দিয়ে কাভার দেওয়া সম্ভব হয়ে উঠছে না। সকালের বাজে অভিজ্ঞতার কথা আমরা কেউ ভুলি নাই তখনো। এই কথা শুনে স্পিড-বোট নিয়ে ফরেইনর গ্রুপ কয়েকজন মৌয়ালকে নিয়ে আলাদা ভাবে ছাটা মারতে অন্যদিকে চলে গেল। আমাদের যেতে হবে ঈমা নিয়ে, কিন্তু ঈমা অন্য একটা কাজে বুড়িগোয়ালিনি চলে গেছে, আসতে দেরি হবে। সকালের তিক্ত অভিজ্ঞতার পরে এবং মৌয়ালদের কথা শুনে বেশিরভাগ লোক আর বিকালের ছাটাতে যেতে রাজি হচ্ছিল না, তাই আর আগের গ্রুপ না করে সম্মিলিত ভাবে এই গ্রুপে আমি সহ আমরা মোট ৯জন হয়েছি। হাসান ভাই বললেন যেহেতু এইটি শেষ ছাটা তাই আর গ্রুপ সাইজ ছোট না করে যারা যাবার জন্য ইন্টারেস্টেড তারা সবাই যেতে পারে। তবে শর্ত হলো এখন যেতে হলে মৌয়ালদের হাতে বাওয়া নৌকাতে করে যেতে হবে অথবা ঈমার জন্য আরো প্রায় ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করতে হবে। আমরা মৌয়ালদের নৌকায় করেই রওয়ানা হলাম। শুরু হোল আমাদের শেষ ছাটা।
মৌয়ালদের হাতে বাওয়া নৌকায় করে আমরা জাহাজ থেকে রওয়ানা হলাম, বেশ খানিকটা পথ - প্রায় ১৫ মিনিট নৌকা বেয়ে মৌয়ালদের উপদেশ মত এক-জায়গায় ভিড়ানো হল। আস্তে আস্তে আমাদের পথ মনে হয় বেশি দুর্গম হয়ে উঠছে। নৌকা থেকে নেমেই গভীর বন। হেতাল আর টাইগার ফার্নের জংগল।
মৌয়ালরা নেমেই একসাথে ৪-৫টি হাতবোমা ফাটালো মামাকে সাবধান করে দিতে যাতে আমাদের ধারে কাছে না ভিড়ে। মৌয়ালরা নিজেদের মধ্যে কি জানি আলোচনা করে নিয়ে আমাদের বলল - এইবার আমরা আর দুইভাগে বিভক্ত না হয়ে একসাথে থেকে মৌচাকের সন্ধান করব। এই জায়গা ওদের কাছে কেন জানি আগের চেয়েও বেশি রিস্কি লাগছে। আমরা যার যার মতো করে গাছের ডাল কেটে কিছুটা শরীরের ভার রাখার জন্য আর কিছুটা আত্মরক্ষার জন্যই একটি করে লাঠি বানিয়ে নিয়ে ইব্রাহিম ভাই এর নেতৃত্বে দা দিয়ে টাইগার ফার্ন কাটতে কাটতে আর একটু পর পর পটকা ফাটাতে ফাটাতে আমরা এগিয়ে চললাম। একসময় ফার্ন-বন শেষ হলো, শেষ-মাথায় পড়ল একটা ছোট খাল। পিছানোর উপায় নাই তাই সবাই মিলে নেমে পড়লাম খালে, হাঁটু পানি পরে কোমর পানি ভেঙ্গে খাল পাড় হলাম। না থাকা পথ ধরে আমাদের এই পথচলা, পায়ের নিচে মট মট করে ভাংছে ম্যানগ্রোভের শ্বাসমূল, সামনে আবার হেতাল বন - পটকা ফাটাচ্ছি আর সামনে এগোচ্ছি ধীরগতিতে অতি সাবধানতার সাথে। প্রায় ৩০মিনিট হয়ে এলো, আমরা শুধু সামনে এগিয়ে যাচ্ছি কিন্তু এখনো কোন মৌচাকের সন্ধান করতে পারলাম না। আর একটু সামনে এগিয়ে একটু ফাকা একটা জায়গা পেলাম যেখানে জংগল একটু পাতলা হয়ে এসেছে। কিন্তু সামনে আঁকাবাঁকা খাল আর প্যাচপ্যাচে কাদায় ভরা । প্রায় হাঁটু কাদা ভেঙ্গে আমরা পথ চলতে লাগলাম। বন একটু হালকা দেখে মৌয়ালরা আবার তাদের ট্র্যাডিশন মত দুইভাগ হয়ে গেল। যথারীতি ইব্রাহিম ভাই এর নেতৃত্বে আমরা এক দল আর ৩জন মৌয়ালদের অপর দল। দুই দলই সমান্তরাল ভাবে ৪০০-৫০০গজ দূরত্বে এগোচ্ছি দুর্গম পথ ভেঙ্গে। আমাদের ডান দিকে একটি টাইগার ফার্নের বন দেখতে পেলাম যেটির অপর পাড় দিয়ে মৌয়ালদের অন্য দলটি এগুচ্ছিল। এবারও ওদের কাছ থেকে বিশেষ সেই সংকেত শুনতে পেলাম। ওরা মৌচাক পেয়েছে। আমরা আবার ফার্ন বনের ভিতর দিয়ে একজন আরেকজনের গায়ে লেগে লেগে পটকা ফুটাতে ফুটাতে এগোচ্ছি। বনের মাঝামাঝি গিয়ে দেখি মৌয়ালদের অপর দল কারু বাধছে। মাটি থেকে প্রায় ৭-৮ফুট উপর গড়ান গাছে একটি মাঝারি সাইজের মৌচাক। মৌমাছিগুলি চাকে না বসে বেশ উরা-উড়ি করছে। মৌয়ালদের একজন বলল - পোকারা কিন্তু খুব গরম, আপনারা সবাই কারুর ভিতর থেকেন। বলতে বলতে আমাদের ক্যামেরা খোলারও সময় পাই নাই। কারুতে মাত্র আগুন দেয়া হয়েছি কি হয় নাই এর মধ্যে দেখি আমাদের চারিদিকে মৌমাছি ঘিরে ধরেছে। আমরা একজন প্রায় আরেকজনের উপর শুয়ে-পরেছি। ছবি তুলব কি? আরো ভাল করে গামছা দিয়ে নাকমুখ পেচাতে ব্যস্ত আর এক এক জন মনে হয় কারুর ধোয়ার ভিতর দিয়েও টাইগার ফার্ন এর জংগলে সেঁধিয়ে যাচ্ছে। আমার চশমার ফাঁক দিয়ে শুধু দেখলাম অনন্ত ফার্নের কাটা উপেক্ষা করে নিজেকে ফার্নের ভিতর ঢুকিয়ে ফেলেছে। এদিকে মৌমাছির দল যেন কারুর ধোয়া উপেক্ষা করে আমাদের সাড়াশি আক্রমণ শুরু করে দিয়েছে। মনে হয় ২-৩ মিনিট এইভাবে আমরা বনের ভিতর পড়ে রইলাম, এর মধ্যে মৌয়ালরা তাদের কাজ সেরে ফেলেছে - মৌচাক থেকে চাক ভেঙ্গে মধু হাড়িতে নিয়ে ফেলেছে। আমাদের বলল এভাবে থাকলে ওদের আক্রমণ আরও বাড়বে। ধোয়ার ভিতর থেকে আপনারা দৌড়ান। সামনে পিছনে ৬টি কারু জালিয়ে ওর ধোয়ার মধ্যে থেকে আমরা দিগ্বিদিক হয়ে দৌড়াতে লাগলাম। ধোয়ায় চোখে কিছুই দেখছি না, শুধু কারুর ধোয়া ফলো করে দৌড়চ্ছি কোথায় যাচ্ছি কোন পথে যাচ্ছি কিছুই জানি না। সামনে বাঘ আছে না সাপ আছে কিছুই তখন মাথায় নাই। চোখমুখ ঢেকে শুধু আগে বাড়া। দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ সামনে দেখি খাল, একজন আরেকজনের পিছনে পিছনে খালের ভিতর নেমে গেলাম। হয়তোবা নিজের অজান্তেই ক্যামেরা বাচাতে এক হাতে ক্যামেরা উঁচু করে ধরে আরেক হাতে লাঠি নিয়ে পানিতে নেমে গেলাম। নেমেই বুঝলাম বোকামি হয়ে গেছে, এটা হাঁটু পানি বা কোমর পানির খাল নয়। মুহূর্তের মধ্যে ডুবে গেলাম। নোনা পানি পেটে ঢুকতেই সাবকন্সাস ভাবেই সাঁতরাতে শুরু করলাম কিন্তু ভেসে উঠতে পারছি না। পায়ে আর্মি গাম-বুট এমনিতেই কাদায় ভিজে ৫কেজি হয়ে আছে - বুটের ভারেই তলিয়ে যেতে লাগলাম। অনেক কষ্টে ডুব সাতার দিয়ে একটু এগিয়ে পায়ে যেন কাদামাটির ছোঁয়া পেলাম। হাত থেকে তখনো কেন জানি লাঠিটি পরে যায় নি। লাঠিতে ভর দিয়ে কাদায় জোরে একবার পা দিয়ে ধাক্কা দিতেই আবার ভেসে উঠলাম। কোন মতে হাচরে পাঁচরে এক মৌয়াল এর হাত ধরে অপর পাড়ে পৌঁছলাম। উঠেই আবার দৌড় দৌড়। প্রায় ১০ মিনিট দৌড়ানোর পর মনে হলো যেন মৌমাছি আর আগের মত নাই। এখনো আমাদের চারিপাশে কিছু মৌমাছি ঘুরাঘুরি করছে কিন্তু তা যেন আর আক্রমণের ভঙ্গিতে না। একটু খোলা জায়গায় এসে সবাই থামলাম। এতক্ষণে নজর পড়ল আমার ক্যামেরার উপর। লোনা পানিতে ডুবে গিয়েছিলাম ক্যামেরার অবস্থা কি? না দুর্ভাগ্য আমার পিছু ছাড়ছে না। ক্যামেরা বেয়ে টপ টপ করে নোনা পানি পড়ছে। এইবার আমার এত সাধের ক্যামেরা শেষ, লোনা পানিতে ডুবার পর কোন ডিজিটাল ক্যামেরা ঠিক হয়েছে বলে আমার জানা নাই। এইদিকে দেখলাম জাহাংগির ভাই এরও মুখ শুকনো - ওনার ক্যামেরারও আমার দশা, তবে উনি আমার মত এত গর্তে পড়েন নি। লোনা পানির ঝাপটা লেগেছে ক্যামেরাতে ওনারটা পুরাপুরি আমারটার মত সাতার কাটে নাই।
মৌয়ালরা জিজ্ঞাসা করছিল এবার আমরা কি করব? আরো মৌচাকের খোজে ছাটা মারা শুরু করব না জাহাজে ফিরে যাব? আমার ক্যামেরা নাই তাই আর ছাটা মারার ইচ্ছাও নাই। আমি জাহাজে যাওয়ার পক্ষে মত দিলাম আর অন্যদের বেশিরভাগ এরই দেখি একই মত, দুই তিনজন শুধু বলল যে তারা আরেকটি মৌচাকের সন্ধানে যেতে চায়। এইদিকে আমাদের সাথে আসা ফরেস্ট গার্ডরাও বেকে বসল - তাদের বক্তব্য হল ভাই আমরা নিজের জীবন বাজি রেখে আপনাদের সাথে বনে আসি ঘুরাঘুরি করি কিন্তু এইবারের মত অভিজ্ঞতা আমাদের কখনো হয় নি। ৫কেজি রাইফেল নিয়ে শুকনাতে ঘুরাঘুরি করা এক কথা আর পানি ভেঙ্গে রাইফেল নিয়ে সাতার কাটা আরেক কথা। সুতরাং জাহাজে ফিরে জাওয়াই ঠিক হল। আবার অনেকটা ঘুরা পথ পাড়ি দিয়ে খালের ভিতর দিয়েই আমরা নদীমুখে এসে পড়লাম যেখানে নৌকা রেখে গিয়েছিলাম তার থেকে অনেকটা দূরে। মৌয়ালরা তাদের বিশেষ সাংকেতিক শব্দ দিয়ে নৌকার সাথে যোগাযোগ করলো, একটু পরে দেখি আমাদের উদ্ধার করতে নৌকা চলে আসল। এরপর নৌকা করে জাহাজে, ভিজে এক একজন চুপচুপা হয়ে আছি, আমার এবং জাহাংগির ভাই দুজনেরই মন খারাপ ক্যামেরা হারিয়ে। জাহাজের বাকি লোকরা আমাদের চেহারা দেখেই ঘটনা আচ করে নিলো। হাসান ভাই শুধু বললেন গোসল করে নিজেদের আগে পরিষ্কার করে নাও। গোসল শেষ করে লবিতে গিয়ে বসলাম আর আমাদের এই শেষ ছাটার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলাম সবাইকে। গল্পে গল্পে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতে লাগল। আজকের রাতই সুন্দরবনের ভিতরে আমাদের শেষ রাত। এর মধ্যে ঈমা চলে এসেছে। হাসান ভাই বললেন আজকের জন্য অনেক এডভেঞ্চার হয়েছে, এখন চল আমরা ফ্রেশ বাতাসে একটু নৌকা ভ্রমণ করি। ঈমা নিয়ে উনি নদীতে ঘুরতে যেতে চান - কে কে সংগে যাবে। অনেকে দেখলাম এই এডভেঞ্চার এর পর আর যেতে ইচ্ছুক না, শেষ পর্যন্ত আমরা ১২জন মত গিয়ে ঈমাতে উঠলাম। নৌকা ছেড়ে দিল মাঝ নদীতে গিয়ে নৌকার ইঞ্জিন বন্ধ করে দিলেন - স্রোতের টানে যে দিকে খুশি সেদিকে যাক। মিতুল অন্তুরা সবাই মিলে গান ধরল, যে যার মত গাইছে একজন গাইছে আরেক দল গলা মেলাচ্ছে, পাতিল দিয়ে ঢোল বানানো হল অন্তু নিয়ে এসেছে একতারা। বাউল গান চলল অনেকক্ষণ। আমরা ঢেউয়ের টানে টানে আবার জঙ্গলের কিনারাতে চলে এসেছি। আবার ইনজিন স্টার্ট দেয়া হল, ফিরে গেলাম মাঝ নদীতে গিয়ে আবার নিস্তব্ধতা। এর মধ্যে কিন্নর কন্ঠে মনি আপা শুরু করলেন রবীন্দ্র সংগীত। একটার পর একটা করে প্রায় আমাদের ১২-১২টা গান শোনালেন। ওই পরিবেশে নিস্তব্ধতার মধ্যে ওনার গান অপরূপ শোনাচ্ছিল। আমরা ঘুরে ফিরে রাত ৯টার দিকে জাহাজে ফিরলাম ডিনারের জন্য। আজ শেষ রাত তাও ডিনার এর ব্যবস্থাও একটু অন্যরকম। আজকের ডিনারের মেনু বার-বি-কিউ সাথে চাইনিজ আইটেম । সবাই মিলে আড্ডা দিতে দিতে গল্প করতে করতে ডিনার শেষ করে আবার বসলাম একসাথে । হাসান ভাই ডিক্লেয়ার করলেন যে উনি ভাবিকে নিয়ে আজ রাত ঈমাতে হানিমুন করবেন , আমরা জাহাজে ঘুমাবো আর উনি ঈমাতে করে হানিমুনে বেরুবেন তবে ভদ্রতা করেই হয়ত আমাদের বললেন ৩-৪ জন ইচ্ছা করলে ওনার সাথে ঈমাতে থাকতে পারে। আমরা সবাই মিলে বললাম কাবাব মে হাড্ডি হতে চাই না। আপনারা দুইজনে মিলেই হানিমুনে জান। একটু পরেই উনি আমাদের ছেড়ে ঈমা নিয়ে হানিমুনে গেলেন শুধু যাবার সময় বলে গেলেন বেশি হৈ চৈ করে অন্যের ঘুম নষ্ট করিস না তোরা।
আমাদের শুরু হল আবার গানের আসর, চলল রাত ৩টা পর্যন্ত। টায়ার্ড হয়ে এক একজন রাতে ঘুমাতে গেলাম সাড়ে তিনটার ও পরে। সুন্দরবনের শেষ দিন শেষ হলো এক্সট্রিম এডভ্যঞ্চার এর মধ্যে দিয়ে।