মঙ্গলবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০২২

গ্রাম্য শহর - মনকথা

গ্রাম্য শহর 

 - আহসানুল হক 


মানুষের গ্রাম থাকে, থাকে গ্রামের বাড়ি। আমার কোন গ্রাম নেই, নেই গ্রামের বাড়ি। 


এই শহরেই আমার জন্ম, এই শহরেই বেড়ে ওঠা। সেই ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছি এটাই আমার গ্রাম, এটাই আমার বাড়ি, এখানেই আমার নাড়ি। 


একটা সময় এই শহরটা ঠিক শহর ছিলো না, ছিলো গ্রাম গ্রাম একটা মফঃস্বল অনুভব। এখানে বিল্ডিং বলতে ঐ উঁচু তিন দলা একটা বিল্ডিং, আর চারিদিকে ধু ধু খেলার মাঠ। অনেক দূরে দূরে এক একটা বাড়ি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলে টিমটিমে কুপির বাতি আর নয়তো হ্যারিকেন। যারা একটু অবস্থাপন্ন ছিলো তাদের বাড়িতে হ্যাজাকের সাদাটে আলো। 


তারপর এক সময় কারেন্ট আসলো, ওটা আমার কেন জানি ভালো লাগতো না। তার থেকে ঢের বেশি ভালো ছিলো জোনাকির আলো, জ্যোৎস্না হলে তো কথাই নেই। আর যেদিন কারেন্ট চলে যেতো? আমরা এক ভোঁ দৌড়ে খাল পাড়ে। আমাদের আর পায় কে? বিকেলের খেলা দুপুর রাত অবধি গড়াতো; যতক্ষণ বাবা বা চাচার বাজখাই রাম-বকা কানে না ঢুকতো। 

আজকালকার ছেলেমেয়েরা কুপিবাত্তি চেনে কোথায়? হ্যারিকেন বাত্তির নাম শুনলেও হ্যাজাক বাতির কথা কয়জন জানে আমার সন্দেহ আছে।  


খালটা মরে গেছে সেই কবেই! নদীগুলোও প্রায় মরো মরো। জ্যোৎস্নার আলোতে নদীর পানিতে ঝিকিমিকি খেলা দেখি না কতযুগ হয়ে গেছে! তাও ভালো! যে এখনো চাঁদ ওঠে, এখনো জ্যোৎস্না ফোটে; এখনো কারেন্ট চলে গেলে রাতের বেলায় ছাদ আমায় আয়! আয়! ডাকে। 


আমি প্রায়শই জ্যোৎস্না রাতে ছাদের ওপর পাটি পেতে ঘুমিয়ে পড়ি। শেষ রাতের দিকে কেমন এক হিম হিম অনুভূতিতে দু হাঁটু পেটের ভেতর কুঁকড়ে শুয়ে থাকি, যেন মায়ের পেটের ওমের ভেতর শুয়ে আছি। দূর থেকে কুকুরের কান্না শোনা যায়। এখনো রাতে কুকুর কাঁদলে কেন জানি মনে অশুভ চিন্তা উঁকি দেয়। আহা! কোথায় জানি কাকে কি অলক্ষণ ডাকছে। কুকুরে কুউউউউউ কুউউউউউউ কান্নার সাথে জ্যোৎস্না মাখতে মাখতে ঘুমিয়ে পড়ি। 


আশেপাশের তিন চারটি মসজিদ থেকে ফজরের আজান ভেসে আসে। আমি আলসেমি ছেড়ে উঠে পড়ি। তারপর নামাজ পড়ে ঘরের বিছানায় কাঁথা-মুড়ি শুয়ে পড়ি। বৌ নামাজ শেষ করে শুতে এসে মাঝে মধ্যে খোঁচা দেয় - চাঁদনির সাথে প্রেম হলো? 


আমি মৃদু হেসে হু হলো, বলে পাশ ফিরি।  


শহর আমাকে অনেক দিয়েছে, নাগরিক সভ্যতা; ইট কাঠের দালান থেকে বড় বড় অট্টালিকা। 

কিছু কি কেড়ে নেয় নি?

গ্রাম, মেঠো-পথ, ধানক্ষেত, নদী-নালা, খাল-বিল, খেলার মাঠ; পড়শিদের সাথে আন্তরিকতা!

এ শহর আমাকে অর্থ দিয়েছে - স্বার্থপরতা শিখিয়ে।

এ শহর আমাকে সম্পর্কহীন করেছে - আত্মীয়তার বন্ধন কেড়ে নিয়ে। 


আমাকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় - সুযোগ দিলে তুমি কি আবার গ্রামে ফিরে যাবে?


আমি এক কথায় জবাব দিব - 'হ্যাঁ'। 



১০ অক্টোবর, ২০২২


#মনকথা 


গ্রাম্য শহর 

 - আহসানুল হক 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন