বুধবার, ২৮ অক্টোবর, ২০২০

যাত্রা - গল্প

#গল্প

বেশ ভালোই কাটছিলো দিনগুলো। স্ত্রী সন্তান, ভাই-বোন সবাইকে নিয়ে; মা’ও জীবিত ছিলেন সংসারে। আলহামদুলিল্লাহ্, আর কি চাই। টাকা পয়সার ঘাটতি! তা হয়তো ছিলো খানিকটা, কিন্তু সংসারে শান্তির কাছে ওটাকে খুব বেশী আমল পায় নি কখনো। গাধার খাটনি খাটতাম সকাল থেকে সন্ধ্যা, সন্ধ্যার পর বাসা। পঞ্চাশ বছরের পুরুষের জীবনে আর কি চাওয়ার থাকে? 


একদিন শুক্রবার সন্ধ্যার পর সবাই মিলে চায়ের টেবিলে খোশগল্পে মশগুল ছিলাম। মা বললেন, প্রেশারের ঔষধটা শেষ হয়ে গেছে রে খোকা। ছেলে বললো আমি নিয়ে আসি, আমি বললাম না রে, তোরা গল্প কর আমিই গিয়ে নিয়ে আসি; বলে বাসায় পড়ার গেঞ্জিটা খুলে একটা শার্ট পরে রওনা দিলাম ঔষধ কিনতে। বৌ কে জিজ্ঞাসা করলাম, বাসার জন্য আর কিছু লাগবে কিনা? বৌ বললো, নাহ! কিছু লাগবে না। 


ফার্মেসী বাসা থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটা রাস্তা, বড় রাস্তাটা পাড় হয়ে যেতে হয়। আমি সাবধানে দেখেশুনে রাস্তা পার হয়ে ফার্মেসীতে গিয়ে ঔষধ কিনলাম; পরিচিত দু-জনের সাথে দেখা হলো, কুশলাদি বিনিময় করতে করতে পাঁচ ছয় মিনিট দেরি হয়ে গেলো। ঔষধ নিয়ে আবার বাসার দিকে রওনা দিলাম। সাবধানেই রাস্তা পার হচ্ছিলাম, কোথা থেকে হুট করে রাস্তার উল্টোদিক থেকে এক হোন্ডা এসে প্রায় গায়ের ওপর উঠিয়ে দিচ্ছিলো, আমি হোন্ডা থেকে গা বাঁচাতে একদিকে লাফ দিয়ে সরে যেতে গিয়ে হঠাৎ হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলাম, হাঁটুতে বেশ ব্যথা পেয়েছি; চোখে অন্ধকার দেখছি। কোনমতে চোখ কচলে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতেই রাস্তার সাথে গাড়ির টায়ার ঘষার প্রচণ্ড শব্দ কানে আসলো, চোখের সামনে দেখলাম একটা দৈত্যাকৃতি বাসের অবয়ব। পর-মুহূর্তেই মাথায় যেন কেও হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি মারলো; তারপর আর কিছু মনে নেই। 


আমি কি বেঁচে আছি? চারিদিকে অনেক মানুষের কথাবার্তা; কে কে যেন কি কি সব বলছে। আমার কি চোখ বন্ধ না খোলা? কিছুই বুঝতে পারছি না, সব যে কেমন আবছা ঘোলা ঘোলা। চেষ্টা করছি জোর করে পুরোপুরি চোখ মেলতে, কিন্তু কিছুতেই চোখের পাতা নড়াতে পারছি না। এ আমি কোথায় আছি? অর্ধ খোলা চোখে কোন পরিচিত মুখ নজরে পড়ছে না। কে যেন চোখে টর্চ মারলো, বুঝতে পারছি কিন্তু চোখের পাতা নাড়াতে পারছি না। ডাক্তার মনে হয়, তারমানে আমি এখনো বেঁচে আছি, কিন্তু পরিচিত জনারা কোথায়? ডাক্তার কি যেন বলছে, শব্দগুলো যেন মাথায় ঢুকি ঢুকি করেও ঢুকছে না। তারপর আবার চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেলো। 


কতক্ষণ পর সম্বিৎ ফিরে পেলাম জানি না। এবার পরিচিত গলা, ভাই এর গলা, আমার স্ত্রীর গলা, ছেলেমেয়ের গলা। ভাই যেন চিৎকার করে কাকে কি বলছে, ওর কথাগুলো বুঝতে পারছিলাম না। ভাইটা চিরকালই গোয়ার গোবিন্দ অথচ ওর চিৎকার চেঁচামেচিই যেন আমার সম্বিৎ ফিরিয়ে আনলো। স্ত্রী সন্তানদের কান্না শুনছি। আমি প্রাণপণে কিছু বলতে চাচ্ছি অথচ ঠোঁট নাড়াতে পারছি না, আমার স্ত্রী সন্তানকে দেখতে চাচ্ছি অথচ চোখ আগের মতই আমার বশে নেই; আধো আধো আলো আধো আধো অন্ধকারে শুধু ওদের কথাগুলোই কানে যাচ্ছে। ডাক্তারের সাথে আমার ভাই তর্ক করছে, চিকিৎসা নিয়ে, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিয়ে; আরো কি কি যেন! ডাক্তার বললেন সরকারি হসপিটালে আমরা এর থেকে বেশী সুযোগ সুবিধা দিতে পারি না। ওদের কথা থেকে বুঝলাম আমি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হসপিটালে। আমার স্ত্রী বলছেন তাহলে আমরা অন্য কোন প্রাইভেট হসপিটালে নিয়ে যাই! ডাক্তার বলছে, লাভ হবে না; চোখের মণি ডাইলুট হয়ে গেছে, ওরা এর মধ্যেই সিটি স্ক্যান করে ফেলেছে; মস্তিষ্কের প্রায় এক তৃতীয়াংশ ড্যামেজ দেখাচ্ছে। রোগী এখনো বেঁচে আছে এইতো আশ্চর্য! আমিও আশ্চর্য হয়ে গেলাম। তাদের কথা সব শুনছি, কিছু কিছু বুঝছি কিছু বুঝছি না; অসাড় হয়ে পড়ে আছি। ডাক্তার বললেন এখানে এভাবে ফেলে রাখলে কোন লাভ নেই, আপনারা ভেন্টিলেটর খুঁজুন; ওখানে রেখে অন্তত চেষ্টা করে দেখতে পারেন, এখানে থাকলে এমনিতেই মারা যাবে। আমার ভাই, স্ত্রী আরো কে কে যেন চারিদিকে ফোন দিতে লাগলো, শেষমেশ ভেন্টিলেটর এর সন্ধান মিললো শহরের দামী প্রাইভেট হসপিটালগুলোর একটাতে।   খবর পেতে যা দেরি, এবার এ্যাম্বুলেন্স খোঁজার পালা, ওটা পেতে দেরি হলো না। ওরা সবাই মিলে তাড়াহুড়ো করে আমাকে এ্যাম্বুলেন্সে ওঠালো। তারপর আবার অন্ধকার। 


এবার সম্বিৎ ফেরার পর শুনি কে যেন কথা বলছে, একটু পর হালকা নীল এপ্রোন পড়া এক নার্স এসে যেন মাথার কাছে কি করলো, কাকে যেন ডাকলো। একটু পর দেখি সাদা এপ্রোন গায়ে এক ডাক্তার পাশে এসে দাঁড়ালো; চোখের মাঝে আবার টর্চ ফেললো, অনেকক্ষণ ধরে চোখে টর্চের আলো, আমার অসহ্য লাগছে আবার কিছু বলতেও পারছি না। এবার চোখের পাতা টেনে ধরে আবার টর্চ জ্বালালেন নিভালেন, আবার জ্বালিয়েই রাখলেন; আমার চোখে কি খুঁজছে ওরা? জীবন না মৃত্যু! জানি না। শুধু অনুভব করতে পারছিলাম শরীরে বিভিন্ন জায়গায় কি কি যেন লাগানো আছে, কি সেটা বুঝছিলাম না। কোথাও যেন মেশিনের ক্রমাগত টিকটিক টিকটিক শব্দ, আমি আবার তলিয়ে গেলাম অন্ধকারে। 


কতক্ষণ, কতদিন এভাবে কেটেছে জানি না, মাঝে মধ্যে স্ত্রীর গলা শুনতে পাই, মাঝে মধ্যে ভাই এর, মাঝে মধ্যে ছেলেমেয়ের; একবার যেন মায়ের গলাও পেলাম। কেন জানি বাবাকে বড্ড দেখতে ইচ্ছে করছে, অথচ আমি জানি বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন প্রায় ছ বছর হলো; তবুও কেন বাবার কথাই মনে হচ্ছে? জানি না। 


একদিন সম্বিৎ ফিরলো মায়ের ডাকে, অনেক দূর থেকে যেন ডাক শুনতে পাচ্ছি; খোকা উঠ, খোকা উঠ! আমার ঔষধের দরকার নেই, তুই চোখ খোল। আমি প্রাণপণে উঠে বসার চেষ্টা করছি, অথচ অসাড় শরীরটা কোন কথাই শুনলো না। বোন কাঁদতে কাঁদতে এসে মা'কে সরিয়ে নিয়ে যেতে চাইলো, মা কিছুতেই যাবেন না। এর মধ্যে ভাই এলো, ভাই বোন মিলে কথা বলছিলো – ভাবীর কাছে তো আর টাকা নেই রে, এদিকে প্রত্যেকদিন ভেন্টিলেটর চার্জ তো বিশাল অঙ্কের টাকা, ভাবী তার ভাই বোনের কাছ থেকে ধার করছে, আমাদেরও যতটুকু সম্ভব দেওয়া উচিৎ; মা কাঁদতে কাঁদতে ভাইকে বললেন আমার সঞ্চয়ে যা আছে তা ব্যাঙ্ক থেকে উঠিয়ে নিয়ে আয়।  

একদিন স্ত্রী এসে অনেক অনেকক্ষণ হাত ধরে পাশে বসে রইলো, বিড়বিড় করে কি যেন দোয়াদরূদ পড়ছে! আমি প্রাণপণে ওর হাতে হাত রাখতে চাইছি অথচ অসাড় শরীরটা এক সুতোও নড়াতে পারলাম না। আচ্ছা! আমি তো সব শুনছি, আধো আধো কিছু দেখছিও তবুও শরীরে কোথাও কোন সাড়া পাচ্ছি না কেন? একদিন শুনি ডাক্তার ভাইকে বলছেন, আপনারা শুধু শুধুই গুচ্ছের টাকা খরচ করছেন ভেন্টিলেটরে; কোন লাভ হচ্ছে না; এবার ভেন্টিলেটরটা সরিয়ে নিন, ওনাকে যেতে দিন। আমি চমকে উঠলাম। 


একদিন শুনি আমার স্ত্রী আমার ছেলেকে বলছেন, তোর বোনের বিয়ের জন্য আলমারিতে রাখা গয়নাগুলো নিয়ে বেঁচে দিয়ে আয় বাবা, সবার কাছ থেকেই তো ধার করে ফেলেছি, আর তো কেও বাকি নাই। বিল পরিশোধ না করলে তো তোর বাবাকে আর এখানে রাখতে পারবো না; হু হু করে বিল বেড়েই চলেছে। আমার কান্না পেয়ে গেলো, চোখের জল কি গড়ালো! নাহ! তাহলে তো ওরা দেখতে পেত।

 

আজকাল বেশিরভাগ সময় অন্ধকারেই থাকি, মাঝে মাঝে যেন এখানে ফিরে আসি। এক একবার যেন জীবিতরা আমায় টানে, ওদের কাছে বড্ড ফিরে আসতে ইচ্ছে করে; আবার এক একসময় যেন আমার মৃত বাবা, দাদা দাদীর ডাক শুনতে পাচ্ছিলাম। ঘোরের মধ্যে ঠিক বুঝতে পারছি না আমার স্ত্রী সন্তানদের ফিরে আসবো না বাবার কাছে চলে যাব! কোন একদিন সম্বিৎ ফিরলো ডাক্তারের উত্তপ্ত কথায়। ডাক্তার বলছেন আপনারা বিল ক্লিয়ার করুন নয়তো আমরা ভেন্টিলেটর খুলে দিতে বাধ্য হবো। ভাই অনেক কাকুতি মিনতি করছে, আর দুটো দিন সময় দিন; ওনার ফ্ল্যাটটা বিক্রি করারা চেষ্টা করছি। আমার ভাই ডাক্তারকে বলছেন, ভাই আপনার তো অনেক টাকা, আপনি কিনে নেন না! আমরা অনেক সস্তায় ছেড়ে দেব, আমার ভাই কে বাঁচাতে না পারলে ফ্ল্যাট দিয়ে কি করবো? আমার ভেতরটা কেঁপে উঠলো। ফ্ল্যাটটা বেঁচে দিলে আমার ছেলেমেয়েগুলো কোথায় থাকবে? ওদের তো মাথাগোঁজার ঠাই ঐ ফ্লাটটাই। আমি আল্লাহ্‌কে ডাকতে লাগলাম, হে আল্লাহ্! আমাকে এবার নিয়ে যান, আমার সন্তানদের মাথার ওপরের ছাদটা'তো থাকুক! মনে মনেই কাঁদছি শুধু, কেও শুনছে না। 


ভাই এর মুখ থেকে ফ্ল্যাট বিক্রির কথা শোনার পর থেকে হঠাত করেই আমার জীবিতদের মাঝে ফিরে আসার ইচ্ছেটা অসাড় হতে শুরু করলো, সমস্ত স্বত্বা দিয়ে যেন চিৎকার করে বলতে চেষ্টা করছি আমার সন্তানদের মাথার ছাদের বিনিময়ে আমি ফিরতে চাই না। আমি একমনে আল্লাহ্‌কে ডাকতে লাগলাম আমাকে বাবার কাছে নিয়ে যাবার জন্য। 


হয়তো মহান আল্লাহ্ তায়ালা আমার ডাক শুনতে পেলেন। আমার প্রায় অসাড় সম্বিতে একদিন ডাক্তারদের চিৎকার শুনতে পেলাম; নার্স হার্ট-বিট কমে যাচ্ছে, পালস নেমে যাচ্ছে! দৌড়ে কি জানি একটা ইনজেকশন আনতে বললেন, বুকের ওপর যেন আচমকা এক শক অনুভব করলাম; ওরা কি শক দিয়ে আমার হৃদপিণ্ড চালাতে চাচ্ছে? হবে হয়তো! আমার চোখের ওপরের আধো আলোটা ধীরে ধীরে কমে আসতে লাগলো, সামনে একটা অন্ধকার গহ্বর দেখতে পেলাম, গহ্বর এর দূর ওপাশটায় যেন এক অপার্থিব আলো। অনেক দূরে ওপাশে আলোতে যেন বাবা দাঁড়িয়ে আছেন, তারও পেছনে যেন দাদা দাদী, ওনাদের পাশে নানা নানী; ইশারায় যেন আমাকে ডাকছেন। আমি ওদের ডাকে সাড়া দিয়ে গহ্বরে ঢুকে যেতে যেতেই যেন খুব সহসাই আমার সমস্ত জীবনটা চোখের সামনে চলে আসতে লাগলো, আমার জন্ম, আমার শৈশব, আমার কৈশোর, যৌবন, বিয়ে সংসার ছেলেমেয়ে সব, সব দেখতে লাগলাম ছবির মত; তারপর প্রৌঢ়ত্বে এসে ধাক্কা খেলাম বাসের সাথে। আমি গহ্বরের ভেতরে ঢুকে যেতে লাগলাম, মনে একটা অদ্ভুত প্রশান্তি – যাক! আমার স্ত্রী সন্তানদের মাথার ওপরের ছাদটা'তো থাকবে! থাকুক। ওরা ভালো থাকুক, অনেক অনেক ভালো; অনেক অনেক অনেক ভালো। তারপর একসময় সব অন্ধকার হয়ে গেলো। 


০২ অক্টোবর, ২০২০ 


#গল্প

যাত্রা 

- যাযাবর জীবন 

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন