আস সালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ
যাকাত শব্দটি আরবি। অর্থ পবিত্রতা বা বৃদ্ধি। শরীয়তের পরিভাষায় যাকাত হলো আল্লাহ পাক উনার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে শরীয়তের নির্দেশ মুতাবেক এক নির্দিষ্ট (নিসাব) পরিমাণ সম্পদ ছদকা গ্রহণের উপযোগী কোন মুসলমানের অধিকারে দিয়ে দেয়া। এ স্থলে দাতা গ্রহীতা থেকে বিনিময়স্বরূপ কোন ফায়দা হাসিল করতে পারবে না। কোন সুবিধা হাসিল করলে বা হাসিলের আশা রাখলে তার যাকাত আদায় হবেনা।
যাকাত একটি আল্লাহ্র বিধান যা ওনার তরফ থেকে ফরজ হিসাবে আমাদের উপর অর্পিত হয়েছে, কোন ওজর আপত্তিই কিন্তু এর থেকে আপনাকে পাপ-মুক্ত করতে পারবে না। আপনি যদি নিসাব পরিমাণ সম্পত্তির মালিক হন, অর্থাৎ আপনার আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী আপনি যদি যাকাত দেবার জন্য এলিজেবল হন তা হলে দয়া করে যাকাত দিন। নিজে যাকাত দিন আপনার অন্য একজন মুসলমান ভাই যার যাকাত সম্পর্কে ধারনা নেই তাকে অনুপ্রাণিত করুন যাকাত দেবার জন্য।
মহান আল্লাহ্ তায়ালা আমাদের মধ্যে ঈমান আর আকিদা মজবুত করুন।
এখন আসুন জানি যাকাত সম্পর্কিত কিছু প্রয়োজনীয় তথ্যাবলি।
যাকাত কার উপর ফরয ?
• যাকাত দাতাকে মুসলমান হতে হবে।
• প্রাপ্ত বয়স্ক ও বিবেক বুদ্ধি সম্পন্ন হতে হবে।
• নিসাব পরিমাণ মাল অর্থাৎ সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ অথবা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রূপা অথবা তার সমপরিমাণ মূল্য বা টাকা তার বৎসরের সকল মৌলিক প্রয়োজনের পর অতিরিক্ত থাকতে হবে। (‘নিসাব’ বলা হয় শরীয়তের নির্ধারিত আর্থিক নিম্নতম সীমা বা পরিমাণকে অর্থাৎ যে পরিমাণ সম্পদ-মাল, অর্থ কোন ব্যক্তির সাংসারিক সকল মৌলিক প্রয়োজন মিটানোর পর বছর শেষে নির্দিষ্ট তারিখে ওই ব্যক্তি মালিকানায় থাকলে যাকাত প্রদান করতে হয় তাকে ইসলামী পরিভাষায় ‘নিসাব’ বলে। মালের প্রকৃতি ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন মালের নিসাব বিভিন্ন। )
• যদি এককভাবে কোন পণ্য বা দ্রব্যের মূল্য নিসাব পরিমাণ না হয় কিন্তু ব্যক্তির সবগুলো সম্পদের মূল্য মিলিয়ে একত্রে সাড়ে ৫২ তোলা রৌপ্য মূল্যের সমান হয় তবে ওই ব্যক্তির নিসাব পূর্ণ হবে। অর্থাৎ যাকাত আদায় করতে হবে।
• সাংসারিক প্রয়োজনে গৃহীত ঋণ কর্তনের পর নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলে যাকাত দিতে হবে।
• স্বামী-স্ত্রীর সস্পদ একই পরিবারের গণ্য হলেও মালিকানা ভিন্ন-হেতু পৃথকভাবে নিজ নিজ সম্পদের যাকাত আদায় করতে হবে।
• নির্ধারিত যাকাত পরিশোধের পূর্বেই সম্পদের মালিক মারা গেলে যাকাত পরিশোধের পর ওয়ারিশগণ মালিক বলে গণ্য হবে।
যাকাত পাওয়ার হক্বদার কে:
নিম্নলিখিত আট খাতে যাকাতের অর্থ ব্যয় করা ফরয। পবিত্র কুরআন শরীফ-এ আল্লাহ পাক তিনি বলেন, “যাকাত কেবল ফকির, মিসকিন ও যাকাত আদায়কারী কর্মচারীদের জন্য, যাদের চিত্ত আকর্ষণ করা প্রয়োজন তাদের জন্য অর্থাৎ নও মুসলিম, দাস মুক্তির জন্য, ঋণে জর্জরিত ব্যক্তিদের ঋণমুক্তির জন্য, আল্লাহ পাক উনার রাস্তায় জিহাদ-কারী এবং মুসাফিরদের জন্য। এটা আল্লাহ পাক উনার নির্ধারিত বিধান এবং আল্লাহ পাক সর্বজ্ঞ প্রজ্ঞাময়।” (সূরা তওবা : আয়াত শরীফ- ৬০)
• ফকির : ফকির ওই ব্যক্তি যার নিকট খুবই সামান্য সহায় সম্বল আছে।
• মিসকিন : মিসকিন ওই ব্যক্তি যার আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি এবং আত্মসম্মানের খাতিরে কারো কাছে হাত পাততে পারে না।
• আমিল বা যাকাত আদায় ও বিতরণের কর্মচারী।
• মন জয় করার জন্য নওমুসলিম : অন্য ধর্ম ছাড়ার কারণে পারিবারিক, সামাজিক ও আর্থিকভাবে বঞ্চিত হয়েছে। অভাবে তাদের সাহায্য করে ইসলামে সুদৃঢ় করা।
• ঋণমুক্তির জন্য : জীবনের মৌলিক বা প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণের জন্য সঙ্গত কারণে ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিদের ঋণ মুক্তির জন্য যাকাত প্রদান করা যাবে।
• দাসমুক্তি : কৃতদাসের মুক্তির জন্য।
• ফি সাবিলিল্লাহ বা জিহাদ : অর্থাৎ ইসলামকে বোল-বালা বা বিজয়ী করার লক্ষ্যে যারা কাফির বা বিধর্মীদের সাথে জিহাদে রত সে সকল মুজাহিদদের প্রয়োজনে যাকাত দেয়া যাবে।
• মুসাফির : মুসাফির অবস্থায় কোন ব্যক্তি বিশেষ কারণে অভাবগ্রস্ত হলে ওই ব্যক্তির বাড়িতে যতই ধন-সম্পদ থাকুক না কেন তাকে যাকাত প্রদান করা যাবে।
কাদেরকে যাকাত দেয়া যাবে না:
• উ-লামায়ে ছূ’ বা ধর্মব্যবসায়ী মাওলানা দ্বারা পরিচালিত মাদরাসা অর্থাৎ যারা জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও অন্যান্য কুফরি মতবাদের সাথে সম্পৃক্ত সেই সমস্ত মাদরাসাতে যাকাত প্রদান করলে যাকাত আদায় হবে না।
• নিসাব পরিমাণ মালের অধিকারী বা ধনী ব্যক্তিকে যাকাত দেয়া যাবে না।
• মুতাক্বাদ্দিমীন অর্থাৎ পূর্ববর্তী আলিমগণের মতে কুরাইশ গোত্রের বনি হাশিম-এর অন্তর্গত আব্বাস, জাফর, আঁকিল রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম গণের বংশধরের জন্য যাকাত গ্রহণ বৈধ নয়। তবে মুতাআখখিরীন অর্থাৎ পরবর্তী আলিমগণের মতে বৈধ।
• অমুসলিম ব্যক্তিকে যাকাত দেওয়া যাবে না।
• যে সমস্ত মাদরাসায় ইয়াতীমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিং আছে সেখানে যাকাত দেয়া যাবে এবং যে সমস্ত মাদরাসায় লিল্লাহ বোর্ডিং নেই সেখানে যাকাত দেয়া যাবে না।
• দরিদ্র পিতামাতাকে, সন্তানকে, স্বামী বা স্ত্রীকে যাকাত দেয়া যাবে না।
• প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ইয়াতীমখানা লিল্লাহ বোর্ডিঙয়ের জন্য যাকাত আদায়কারী নিযুক্ত হলে তাকে যাকাত দেয়া যাবে না।
• উপার্জনক্ষম ব্যক্তি যদি উপার্জন ছেড়ে দিয়ে নামায-রোযা ইত্যাদি নফল ইবাদতে মশগুল হয়ে যায় তাকে যাকাত দেয়া যাবে না। তবে সে যদি উপার্জন না থাকার কারণে যাকাত পাওয়ার উপযুক্ত হয় তবে যাকাত দেয়া যাবে।
• বেতন বা ভাতা হিসেবে নিজ চাকর-চাকরানীকে যাকাতের টাকা দেয়া যাবে না।
স্বামী-স্ত্রীর সম্পদ বা অলঙ্কারের যাকাত কে দেবে?
স্বামী-স্ত্রীর সম্পদ একই পরিবারের গণ্য হলেও মালিকানা ভিন্ন তাই পৃথকভাবে যাকাত আদায় করতে হবে। স্ত্রীর যদি অলঙ্কার ব্যতীত অন্য কোন সম্পদ না থাকে তবে স্ত্রীর হাত খরচের টাকা বাঁচিয়ে বা কিছু অলঙ্কার বিক্রি করে যাকাত আদায় করতে হবে। অলঙ্কারের যাকাত স্ত্রীর পক্ষে স্বামী আদায় করলেও যাকাত আদায় হয়ে যাবে।
যাকাতের হিসাব কখন থেকে করতে হবে?
যাকাত বছরান্তে ফরয এবং বছরান্তে যাকাতের হিসাব করা ওয়াজিব। চন্দ্র বছরের যে কোন একটি তারিখকে যাকাত হিসাবের জন্য নির্ধারিত করতে হবে। বাংলা বা ইংরেজি বছর হিসাব করলে তা শুদ্ধ হবে না। হিসাবের সুবিধার্থে পহেলা রমাদান শরীফ-এ যাকাত হিসাব করা যেতে পারে। মহান আল্লাহ পাক রমাদানের রহমতের কারণে এ সময় সত্তর গুণ বেশি পুণ্য দান করেন। যাকাত যোগ্য সকল সম্পদ পণ্যের বেলায় এই শর্ত আরোপিত কিন্তু কৃষিজাত ফসল, মধু, খনিজ সম্পদ ইত্যাদি ক্ষেত্রে বছরান্তের শর্ত নাই। প্রতিটি ফসল তোলার সাথে সাথেই যাকাত আদায় করতে হবে।
বিগত বৎসরের ক্বাযা (অনাদায়ী) যাকাত:
যদি কারো অতীত যাকাত অনাদায়ী বা অবশিষ্ট থাকে, তাহলে তা ঋণের মধ্যে গণ্য হবে। চলতি বছরে যাকাত আদায়ের পূর্বেই অনাদায়ী ক্বাযা যাকাত আদায় করতে হবে।
এখন আসুন জানি আপনার এ বছরের “যাকাত” কিভাবে ক্যালকুলেটর বা হিসাব করবেন:
যাকাতের হিসাব করার জন্য এখন অনলাইনে অনেক অনলাইন ক্যালকুলেটর চলে এসেছে। আপনি গুগলে গিয়ে যাকাত ক্যালকুলেটর দিয়ে সার্চ দিলেই অনেক গুলি লিঙ্ক পেয়ে যাবেন। তার যে কোন একটিতে গিয়ে আপনি আপনার সম্পদের হিসাবগুলো সঠিক ভাবে বসিয়ে গেলেই সেটি নিজ থেকে আপনার প্রদেয় যাকাত হিসাব করে দেবে।
আমি এখানে আপনাদের সুবিধার জন্য কয়েকটি অনলাইন যাকাত ক্যালকুলেটরের লিঙ্ক দিয়ে দিলাম -
http://www.zakatguide.org/bangla/zakat_calculator.html এই লিঙ্কটি সবচেয়ে বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য এবং সহজ লিঙ্ক ছিল, কিন্তু এই লিঙ্কে এত বেশি পরিমাণ হিট পরেছে এই শেষ এক মাসে যে এটির ব্যান্ডউইথ ক্যাপাসিটি শেষ হয়ে গিয়েছে বলে আমার বিশ্বাস। তবে পরবর্তী বছরের হিসাবের জন্য এটিকে সেভ করে রাখতে পারেন।
www.zakatguide.org
http://www.ahkamuzzakat.com/home.php এই সাইটে গিয়ে আপনি যাকাত গণনা পৃষ্ঠায় গেলে অথবা বাম দিকে একটি আইকন পাবেন যেটায় লেখা সরাসরি যাকাতের পরিমাণ বের করুন যাকাত ক্যালকুলেটর , এখানে ক্লিক করলেও যাকাতের সমস্ত খাতগুলো বাংলায় পেয়ে যাবেন।
যদি অনলাইনে হিসাব করতে সমস্যা হয় তবে অফলাইনে এক্সেল ফাইল ডাউন-লোড করে নিয়ে কম্পিউটারে সেভ করে নেন। আপনার সুবিধা মত সময়ে সমস্ত আর্থিক ডাটাগুলো এক্সেল ফাইলে ইনপুট দেলেই আপনার মোট যাকাত সে অটোমেটিক ক্যালকুলেট করে দেবে।
নিচের লিঙ্কগুলো থেকে আপনি অফলাইনে যাকাত ক্যালকুলেশনের স্প্রেডশিট পেতে পারেন -
https://docs.google.com/spreadsheet/ccc?key=0AvQan3TM-Tv8dGhGOFd1a3ZBM1dUVGtXSmI1c1htVXc
http://www.charityalliance.in/contents/2011/zakat-appeal-2011.htm এই লিঙ্কে গেলে উপরের দিকের কর্নারের দিকে Zakat Calculator বাটনটি দেখতে পাবেন। সেটায় ক্লিক করলেই এক্স এল ফরমেট এ যাকাত ক্যালকুলেটর আপনার কম্পিউটারে সেভ হয়ে যাবে।
অথবা
http://www.charityalliance.in/contents/zakatcalculator.xls এই লিঙ্কে ক্লিক করলেই অফলাইন “যাকাত ক্যালকুলেটর” আপনার কম্পিউটারে সেভ হয়ে যাবে।
নিজে যাকাত দিন, অন্যকেও যাকাত দিতে উৎসাহিত করুন। আল্লাহ্ আপনাদের মঙ্গল করুন।
ঈদ মোবারক, আগাম ঈদের শুভেচ্ছা সবাইকে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন