বুধবার, ১৫ আগস্ট, ২০১২

শব্দজটের রক্তস্রাব


জন্মের পর থেকে মায়ের মুখ থেকে কিছু শব্দ শুনেছি, বাবার কাছ থেকে কিছু ডাক শুনে এসেছি, ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠেছি আর চারিদিকের শব্দজটের মাঝ থেকে কিছু অক্ষর নিয়ে শব্দ তৈরি করেছি নিজে নিজে। হযবরল শব্দমালা গাঁথতে শিখেছি, ধীরে ধীরে পুরো বাক্য তাও যেন হযবরল। প্রথম প্রথম একটু আধো আধো বোল, তারপর যেন কথার ফুলঝুরি ছুটতো মুখ দিয়ে। এটা কি ওটা কি, এটা কেন সেটা হয়নি কেন ইত্যাদি কথার যন্ত্রণায় অস্থির বাবা মা, দাদা-দাদু, চাচা ফুপু, খালা মামারা। আমি কথা বলা শিখেছি, আমার মায়ের ভাষায়; আমারই বাংলা ভাষায়।

মায়ের মুখ থেকে ছড়া শুনে শুনে ঘুমুতে যেতাম, মাথার মধ্যে কোথায় যেন গান হয়ে বাজতো সেই শব্দমালাগুলি। সে-সময় ওগুলোকে মনে করতাম ঘুম পাড়ানি গান; আজ এত বছর পরে বুঝি আসলে ছিল তা কবিতামালা, বাংলার বিখ্যাত সব কবিদের এক একটি মহান সব কবিতা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, সুকান্ত ভট্টাচার্য, সুকুমার রায় আরো কত শত কবিদের কবিতা শুনে বড় হয়েছি তার সবগুলো আজ ঠিক যেন মনেও নেই। তবু আজো সেই সব হাজার বার শোনা শব্দমালা মনের মাঝে কেমন জট পাকিয়ে আসে, যেন কবিতা হতে চায় – যেন আমাকে দিয়ে কিছু লিখিয়ে নিতে চায়। গদ্য না পদ্য, ছড়া না কবিতা ঠিক বুঝতে পারি না। তবে ছোটবেলা থেকে শিখে আসা বর্ণমালা শিক্ষা থেকে শুরু করে বাংলা ডিকশনারির লাখো শব্দ মাথার ভেতরে ঘুরপাক খায় প্রতিনিয়ত। কি জানি এগুলো কি কবিতা না কথামালা বুঝি না। মায়ের পেট থেকে পড়ে যে ভাষায় কথা বলে এসেছি তা সে ভাষাটা বড্ড সহজ মনে হয় – কথা বলতে, কথা বোঝাতে, চিঠি লিখতে, ভালোবাসার কথা বলতে; তবে কি কবিতা লেখাটাও এত সহজ – ঠিক যেভাবে কথা বলি তার মত করে? কি জানি বুঝি না বাবা অতশত, তবে আটপৌরে সাবলীলতায় লেখা চলে আসে মনের ভেতর। কলমের আঁকিঝুঁকি কেটে যাই খেয়ালী মনের ক্যানভাসে গল্পের ছলে, কোন ব্যাকরণ না মেনে। এ কি কবিতা না গল্প নাকি এর এক নতুন নাম গল্প-কবিতা?

মাঝে মাঝে মনের ভেতর কেমন এক বোধ কাজ করে, হঠাৎ করেই সামনে যখন অন্যরকম কিছু দেখি, মাথার ভেতরে যন্ত্রণার কিছু শব্দজট পাকিয়ে ওঠে। চুল টেনে ধরি নিজে নিজে মাথা ঝাঁকি দিয়ে – শব্দজটের হাত থেকে রেহাই পেতে। তবে কি কবিতা এসে মাথায় ভর করছে? প্রসব বেদনায় কাতর হয়ে কাগজ কলম খুঁজে যাই, এদিক ওদিক হাত বাড়াই; শব্দ জটের মধ্য থেকে একটি পূর্ণ বাক্য বের করে আনতে। প্রসব হয় না কবিতা, বের হয়ে আসে কিছু হাবিজাবি কথা সহজ সাবলীল মায়ের ভাষায়, শব্দে শব্দের ঠোকাঠুকিতে ব্যাকরণ বিহীন কিছু বাক্য কথা।

আকাশে মেঘ দেখলেই মনের মাঝে মনে হয় ঝমঝম বৃষ্টি পড়ছে। কি যেন এক অতৃপ্তি, কি যেন নেই, কাকে যেন মনে পড়ছে – মাথার ভেতর ঝনঝন করে শব্দগুলো ভাসছে। মেঘ নিয়ে কিছু লিখতে ইচ্ছে করছে, বৃষ্টি নিয়ে, শরতের আকাশ নিয়ে, বৈশাখী ঝড়ো-হাওয়া কিংবা শ্রাবণের বারিধারা সব যেন মাথার মধ্যে একসাথে ঘুরপাক খাচ্ছে। কোন একটি না বলা গল্প যেন একটু একটু করে রূপ নিচ্ছে মনের ভেতর, কাওকে খুঁজছি আশেপাশে বলার জন্য মনের আনচান করা শব্দজটের কথা, গল্পের ছলে, কবিতার ভাষায়। হায় আমি যদি কবিতা লিখতে পারতেম তবে তা হয়তো কিছুই হত না; হত শুধু শব্দজটের রক্তস্রাব, কবিতা রূপের প্রসব বেদনায় কাতর এক দীর্ঘশ্বাস।

রাতের আকাশের দিকে চেয়ে থাকি নির্ঘুম চোখে, অন্ধকার রাতে তারার মেলা বসে পুরোটা আকাশ জুড়ে। জ্যোৎস্না রাতে চারিদিক ভেসে যায় আলোর বন্যায়, ঠিক তখনই তোমার কথা মনে পড়তেই মাথার ভেতর শব্দজটগুলো এলোমেলো পাকিয়ে যায়, কেমন এক নীল বেদনায়। মনের মাঝে হাতড়ে বেড়াই চারিধার, তোমার মুখচ্ছবি দেখব বলে স্মৃতির পাতাগুলো খুলে খুলে পড়ে যাই একে একে। তোমায় খুঁজে না পেয়ে মাথার ভেতর ব্যকরণহীন কিছু বাক্য গড়ে ওঠে, না আছে তার কোন সন্ধি না আছে সমাস না আছে কাল। শুধুই অর্থহীন কিছু ভাবনা তোমাকে মনে পড়ার। তোমাকে না পাওয়ার মনের মাঝের সব পুঞ্জিভূত ক্ষোভ দিয়ে একটি বাক্য রচনা করতে চাইছি, এক কথায় প্রকাশ কিংবা না জানা কোন সমাসের ভাষায় মনের সব শূন্যতা নিয়ে একটি বাক্য আগে গঠিত হোক, তারপর না হয় সাজাব বাক্যের পর বাক্য, গল্পের ভাষায় কবিতা লেখার ছলে। তোমার উপেক্ষার কথা লিখে যাব আকাশে বাতাসে নদী স্রোত জলে।

আমার কবিতা লেখার দরকার নেই, লিখে যাব মনের কথাগুলো গল্পের ছলে এলোমেলো ব্যাকরণে। ঘাস ফড়িঙের ডানায় ভর করে লুকিয়ে থাকুক না হয় সেসব কথামালাগুলো, সবুজ ঘাসের বনে।



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন