জাগো তোমরা জাগো, জেগে ওঠো বাংলার মানুষেরা
জেগে ওঠো বাংলাদেশ
একটিবারের জন্য হলেও জাগো
প্রতিবাদের জন্য জাগো, প্রতিরোধের জন্য জাগো;
যেমন জেগেছিলে বাহান্নতে ভাষার জন্য রক্ত দিতে
যেমন জেগেছিলে একাত্তুরে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে যেতে
যেমন জেগেছিলে পঁচাশিতে স্বৈরাচার হঠিয়ে গণতন্ত্র নিয়ে আসতে
তেমনি ভাবে জাগো, আরেকটি বারের জন্য জাগো।
আজ এই মহান ফেব্রুয়ারি মাসে একবারের জন্য হলেও জেগে ওঠো
জেগে উঠুক তোমাদের ভেতরের আত্মসম্মান
বাংলাভাষার জয়গানের জন্য হলেও জাগো, ভাষা শহীদদের কথা ভেবে
ভাষা আন্দোলনের কথা ভেবে, রক্তে রঞ্জিত রাজপথের কথা ভেবে।
আজ আমার বড়ই কষ্ট লাগে যখন আমারই সন্তানরা
অনর্গল ইংরেজি ভাষায় কথা বলে যায়, স্কুলে ও বাসায় পরস্পরের মধ্যে
দুইশ বছরের দাসত্ব কি আজো রয়ে গেছে আমাদের রক্তের মাঝে?
তবে আর এত শত ভাষা শহীদের রক্তের কি মূল্য দিচ্ছি আমরা আজকে
জন্মের পর থেকেই এখন কেন আমাদের সন্তানদের শোনাই ইংরেজি রাইমস?
কই আমাদের বাবা মারা তো শুরু করেছিলেন বাল্যশিক্ষার বাংলা বই দিয়ে
সুকুমার রায়ের ছড়া তো এখনো আমাদের মনের মাঝে গেঁথে আছে
তবে কি আমরা অশিক্ষিত হয়ে আছি?
আমাদের সন্তানরা অবশ্যই ইংরেজি শিখবে শিক্ষিত হবার তরে
উচ্চ শিক্ষার তরে, তবে তার প্রাত্যহিক কথাবার্তার চর্চা হবে কেন বাসায় আর স্কুলে
কেন ভাই বোনের মাঝে আজ কথা হবে ইংরেজিতে?
আমরা কি তাদের সত্যিকারের শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হইনি আজ
বাংগালিত্ব কি তাঁদের রক্তে মিশে নেই আর?
আমার বড্ড দুঃখ হয় যখন আমার সন্তানের হাতে তুলে দেয়া
জীবনানন্দ দাস, নজরুল, রবি ঠাকুরে কিংবা শরৎচন্দ্রের বই হেলায় ঠেলে ফেলে রাখে
বিছানার কোনে কিংবা তুলে রেখে দেয় আলমিরাতে সাজিয়ে, সাজানো খেলনার মত করে;
আর হাতে দেখি তাদের ইংরেজি ভাষার নতুন নতুন সব নাম না জানা নভেল আরো কত কিসব বই
কি মন দিয়ে পড়ে তারা যেভাবে এক সময় আমরা গোগ্রাসে গিলেছি রবিঠাকুর বা শরৎ-বাবুর গল্পের বই
পাঠ্যবই এর নীচে রেখে, বাবা মায়ের চোখের আড়াল করে।
হায় আমাদের সন্তান, কি শিক্ষায় করছি আমরা শিক্ষিত আজকের নব প্রজন্মকে?
তাদের কি দুইশ বছরের ইংরেজ দাসত্বের ইতিহাস শুনিয়েছি কখনো বাবা মা হয়ে
কখনো কি তাদের শুনিয়েছি তিতুমীর আর সূর্যসেনের কথা
কিংবা তাদের বীরত্ব গাঁথা?
কখনো বলেছি তাদের আমার সন্তানেরা তোরা ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে
ওই ফিরিঙ্গি ভাষাভাষী দের জবাব দিবি দুইশত বছরের দাসত্বের
ভাষা শিক্ষা আর নিজ ঘরে ভাষা চর্চার মধ্যে যে পার্থক্য তা কে বলে দেবে?
অমূল্য মাতৃভাষার মাধুর্য কে তাদের শেখাবে?
আজকাল বাসায় ঢুকতেই আমার মনটা বড্ড ছোট হয়ে আসে
যখন দেখি হিন্দি সিরিয়ালের দৌরাত্ম, শাশুড়ি বৌ এর কুৎসিত দৈনন্দিন কার্যকলাপ
যখন বাসার সবাই মিলে গেলে গোগ্রাসে
আজকাল বাসার কাজের লোকজন পর্যন্ত কথা বলে হিন্দিতে
আমরা ভারতবর্ষ থেকে নিজস্ব স্বত্বা নিয়ে আলাদা হয়েছিলেম আরো সাত যুগ আগে
তবু কেন হিন্দি ভাষা আজকের যুবকদের মুখে মুখে ফোটে?
কেন আজো মিলাদ মাহফিলে কিংবা ওয়াজ মাহফিলে বড় বড় আলেম গন
বক্তৃতা করে উর্দু ভাষায়, যে ভাষা আমরা রক্ত দিয়ে বর্জন করেছিলাম বাহান্নর ভাষা আন্দোলনে।
হায় ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু ভাষার দাসত্ব - কবে মুক্তি পাবে বাঙ্গালী জাতি এ দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে?
কেন আমরা প্রতি বছর পালন করে যাই ভ্যালেন্টাইন ডে, এপ্রিল ফুল এর মত দিনগুলোকে?
আমাদের তো রয়েছে গর্ব করার মত স্বাধীনতা দিবসের মত একটি দিন - ছাব্বিশে মার্চ
আমাদের রয়েছে ষোলই ডিসেম্বরের মত বিজয় দিবস
যেদিন আমরা হায়েনাদের হাত থেকে পেয়েছিলাম মুক্তির স্বাদ
আমাদের রয়ে গেছে একুশে ফেব্রুয়ারি, যে দিনটি সারা বিশ্ব মেনে নিয়েছে ভাষা দিবস হিসেবে
একটি জাতি তার ভাষার জন্য যুদ্ধ করে প্রাণ দিয়েছে, শহীদের রক্তে লাল হয়েছে রাজপথ
এ যে কত্তবড় গর্বের দিন তা কি আমরা শিক্ষা দিতে পেরেছি আমাদের আজকের তারুণ্যকে?
একজন জীবনানন্দ দাস, একজন নজরুল, একজন সুকান্ত, একজন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
একজন শীর্ষেন্দু, একজন সুনীল, একজন শংকর একজন হুমায়ুন আহমেদ
একজন নির্মলেন্দু গুন, একজন সামসুর রহমান, একজন তারাশংকর, একজন বিভূতিভূষণ
একজন সুকুমার রায়, একজন জাফর ইকবাল, একজন মহাদেব সাহা, একজন পূর্ণেন্দু পত্রী
একে একে কত শত নাম দিয়ে গেছেন বাংলা সাহিত্যকে অপার সম্মান
রবিঠাকুর দিয়ে গেছেন বাংলাকে নোবেল পুরস্কারের মত বিশ্ব সম্মান
আজ এই ফেব্রুয়ারি মাসে তাদের একটু স্মরণ করি তাঁদের প্রতি দেখাই একটু সম্মান
আজকের এই মাসে একটিবারের মত হলেও একটি বাংলা বই তুলে দেই
আমার পরবর্তী প্রজন্মের হাতে
একটিবার তাঁদের শোনাই আমাদের ভাষা শহীদদের আত্মদানের কথা
একটি বার তাঁদের চিনিয়ে নিয়ে আসি শহীদ মিনার চত্বর
গল্প বলার ছলে তাঁদের বলে দেই একুশে ফেব্রুয়ারির রঞ্জিত লাল রাজপথ
একটি বারের জন্য হলেও আমার সন্তানদের নিয়ে এসে দেখাই বাংলা একাডেমী
দেখাই তাঁদের বাংলা ভাষার লাখো বইয়ের সমাহার
একবারের জন্য হলেও জেগে উঠি আমরা সাবাই মিলে
একটি বারের মত পরিবারের সবাইকে নিয়ে গাই বাংলার গান
যেন আমাদের সন্তানদের রক্তে মিশে থাকে একুশে ফেব্রুয়ারি
একটি দিন, একটি নাম আর একটি গান।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন