শুক্রবার, ৩ আগস্ট, ২০১২

তৈল মর্দন



সেই শিশুকাল থেকে শুরু।

শিশু জন্ম নেয়, বাবা মা, দাদা দাদি, নানা নানী সবাই মিলে শুরু করে তৈলমর্দন। খোঁজা হয় ঘানি ভাঙ্গা খাঁটি সরিষার তেল। হাতে পায়ে গায়ে মাখানো হয় তেল। নাক-বোচা শিশুদের নাকে তেল দিয়ে টানাটানি যেন টেনে নাক খাড়া করে ফেলবে। হায় সেই শিশু বয়স থেকে মস্তিস্ক কোষে ঢুকে পড়ে তৈল মর্দনের উপকারিতা।
তারপর দিন যায় মাস যায়, বছর গড়ায়। শিশু একসময় ভর্তি হতে যায় স্কুলে – শুরু হয় শিক্ষা-সফর। বাবা মা পেরেশান। ভালো স্কুলে সন্তানকে ভর্তি করতে হবে। শুরু হয় ভালো স্কুল খোজার পালা, তারপর আবার চলে আসে তৈল মর্দন। আরে ভালো স্কুলে সিট সংখ্যা তো সীমিত। ভর্তি পরীক্ষায় ভালো করলেই কি আর নামকরা স্কুলে চান্স মেলে? এর কাছে ধর্না ওর কাছে ধর্না, ধর্না চলে মন্ত্রী মিনিস্টার পর্যন্ত, চলে বাবা মায়ের তৈল মর্দন মিনিস্টার সাহেবের পায়ে কিংবা তার চামচাগুলোর পিছনে। যত তেল তত শক্তিশালী রেফারেন্স। তৈল মর্দনের সাথে সাথে চলে টাকার খেলা, ঘুসের লেনদেন; ছি ছি এসব কি বলছি আমি? আরে এটা-তো ঘুষ নয়রে বাবা এটাও একপ্রকার তৈল মর্দন। হয় স্কুলের কোন বোর্ড মেম্বারের বাসায় গিয়ে কিংবা ডাইরেক্ট প্রিন্সিপালের হাতে পায়ে চলে ঘুষের তৈল মর্দন। অনেক তেল পুড়ে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সন্তানকে স্কুলে পাঠানো হল। বাবা মা হাফ ছেড়ে বাঁচল। যাক বাবা দেশে উৎপাদিত কিছু তেলের শুভ সৎকার তো হলো! প্রতি বছর নতুন নতুন শিশুর জন্ম হয় – প্রতিবছর নতুন ক্ষেতের নতুন সরিষা উৎপন্ন হয়, ঘানি ভাঙ্গা তেলের ব্যবহার চলতেই থাকে যুগের পর যুগ ধরে একই পথ ধরে।

সন্তান বড় হয়, স্কুল শেষ এবার কলেজের পালা। পুনরাবৃত্তি তৈল মর্দনের পালা। দেশের উৎপাদিত তেলের আবার নতুন করে অনেক ব্যবহার। সরকারি কলেজগুলো-তো আছেই, এবার বেসরকারি নামডাক-ওয়ালা বড় বড় কলেজে না পড়তে পারলে বাবা মার ইজ্জত কোথায় থাকে? শুরু হয় ঢালাও ধর্নার বাহার আর ঘুষের চাকায় ঘানি ভাঙ্গা তেলের ব্যবহার। যাক বাবা এবারও ইজ্জত বাঁচল বাবা মায়ের, বলতে পারে আমার ছেলে বা আমার মেয়ে অমুক কলেজে ভর্তি হতে পেরেছে, গর্বে ফুলে ওঠে তাদের বুক। হায়রে তেল? হায় তার ব্যবহার।

কলেজের পালা শেষ। এবার উচ্চ ডিগ্রী নিতে হবে। হাতে গোনা সরকারী মেডিক্যাল কলেজ, কিছু ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ আর অল্প কটি মাত্র ইউনিভার্সিটি। লাখো ছাত্রছাত্রীর লাইন লেগে যায় যেন ভর্তি পরীক্ষায় ভালো করার জন্য। কোচিং নামক প্রতিষ্ঠান – এ যেন ইউনিভার্সিটির থেকেও বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা – এর থেকে বড় ব্যবসা আর কি আছে আমাদের দেশে? লাখো ছাত্রছাত্রী ছোটে কোচিং সেন্টারে, শিক্ষা নিতে না পরবর্তী উচ্চ শিক্ষার জন্য ভর্তির টিপস এন্ড ট্রিকস জানতে। কিছু কিছু কোচিং সেন্টারের মালিকগণ দেদার পয়সা লুটে এ ফাঁকে। সেখানেও কিন্তু চলে দেদার তৈল মর্দন। যে যত ভালো করে তেল নামক (টাকা) দিতে পারবে সে তত ভালো কোচিং এর নামে (কোশ্চেন পেপার) পেয়ে যাবে।

এবারের তৈল মর্দন চলে অনেক অনেক উঁচু লেভেলে, মন্ত্রী মিনিস্টার ছাড়া কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর একদম উপরের লেভেলের শিক্ষক-গন যারা ভর্তি পরীক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট তাদের ছাড়া তৈল মর্দনে কাজ হয় না। যত উপরের লেভেল তত বেশি তেল, তেলের বন্যা বয়ে যায় যেন সারা দেশ জুড়ে। উচ্চশিক্ষার নামে দামী তেলের ব্যবহার। কি বিচিত্র সেলুকাস – হায় আমাদের দেশ।

ভালো ইউনিভারসিটিতে ভর্তি তো কমপ্লিট হল, এবার তো ভালো রেজাল্ট দরকার। আবার চলে আসে তেলের বাহার। স্যারের বাসার বাজারটা করে দিলে স্যারের সুনজরে আসে কিছু ছাত্র। ম্যাডামের সাথে ভাব জমায় কিছু ছাত্র, বোন বানিয়ে ফেলে রীতিমত, তারপর ম্যাডামকে নিয়ে এখানে ওখানে যাওয়া, ম্যাডামের শপিং এর সাহায্য করা, রাত জেগে স্যারের থিসিস এর কাজ করে দেওয়া – কত কাজ!!!! পড়ালেখার সুযোগ কই তেমন আর, কিন্তু রেজাল্টের দিনে সেই সব ছাত্রদের মুখ থাকে উজ্জ্বল। স্যারের অতি-প্রিয় ছাত্রটি প্রথম দিকে চলে আসে রেজাল্টের দিনে, যদিও পড়ালেখা করেছে স্যারের বাড়ির তথাকথিত দারোয়ান আর বাজার সর্দারের কাজ করে। তৈল মর্দনের কি অপার মহিমা। যে না করেছে সে কখনো এর ফল জানে না। প্রথম শ্রেণীতে প্রথম দিকে রেজাল্ট, এর পর তো হতে হবে ডিপার্টমেন্টের টিচার। চেয়ারম্যান স্যারের বাড়িতে ঘাটি গেড়ে বসে অতি চতুর কিছু ছাত্র ছাত্রীর দল, কে কার আগে স্যারের বাড়ির কাজ করে দেবে? কে দিতে পারে বেশি তেল তার চলে প্রতিযোগিতা। হায় তেল, হায় তৈল মর্দন।

পড়াশুনার পাঠ শেষ, এবার শুরু চাকরী জীবন। আবার ধর্না দেয়া বিভিন্ন উঁচু পর্যায়ের আত্মীয় স্বজনের বাসায় নিয়ে মিষ্টির বাক্স। সাড়া জীবনেও যার বাসায় আত্মীয়তা দেখাতে হাজির হয় নি এখন শুরু হয় তাদের বাসায় আনাগোনা তেলের ড্রাম নিয়ে। তাদের যদি একটি রেফারেন্স পাওয়া যায় তাইলে তো কথাই নেই। চাকরীটা যে পাকাপোক্ত হয় কোন না কোন খানে। আর সরকারী চাকরী? সে তো সোনার হরিণ। এখানে আর তেল কথাটা খাটে না যেন, সরাসরি ঘুষের কারবার। টনে টনে তেলের ড্রাম খরচ হতে থাকে প্রতিদিন ঘুষের আদলে। তেলের ড্রামের বদলে টাকার বস্তা চলে আসে বড় বড় স্যার দের বাসায়। শুরু হয় চাকরিজীবন।

সেখানেও কি শান্তি আছে? বসের সুনজরে পড়তে হবে না? প্রমোশন দেবে কে? চাকরির ইনক্রিমেন্ট, ভালো জায়গায় বদলি। বসের সাথে চলে তেলের গড়াগড়ি, একটি প্রমোশনের জন্য বসের বাসায় না হয় প্রতিদিন বাজার সর্দারই হলাম। চাকরির পাকাপোক্ততা, অযাচিত বোনাস, বছরে বছরে অন্য ক্যান্ডিডেটদের টপকে ইনক্রিমেন্ট।

দেখলেন তো তেলের উপকার? তৈল মর্দনের উপকারিতা ছাড়া কোন অপকারিতা নেই। শিশুকাল থেকে তৈল মর্দন দিয়ে শুরু, কবরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত চলে তৈল মর্দনের খেলা। আসলেই তৈল মর্দনের উপকারিতার কোন শেষ নেই। গাড়ির চাকা ঘোরানো থেকে শুরু করে জীবনের চাকা ঘোরানো নির্ভর করে তেলের যথাযথ ব্যবহার আর তৈল মর্দনের উপর।


হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর কথা মনে পড়ে গেল – “এক তৈলে চাকা ঘোরে আর-তৈলে মন ফেরে।“


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন