আহ কি দিনই না ছিলো! সেইসব দিনগুলো
- যাযাবর জীবন
মধ্যবিত্ত জীবনটা উত্থান পতনে ভরা
বিশেষ করে আমরা যারা সত্তর বা আশির দশকে জন্ম নিয়েছি
তারা যুদ্ধ করতে করতেই এগিয়ে চলেছি
জীবন যুদ্ধ,
উচ্চবিত্তরা সবসময়ই আলাদা;
প্রতিযোগিতা তো সব যুগেই থাকে
তবে আমরা বোধহয় খুব বেশী অসুস্থ প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হই নি আমাদের সময়ে,
ফ্যামিলি প্ল্যানিং তখনো বোধহয় অতটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে নি,
চাচা, মামা, ফুফু, খালা সবার ঘরেই তিন চার পাঁচ থেকে আট দশটি সন্তান,
মহল্লার ভেতর টিনের চালে ঘেরা ছোট্ট ছোট্ট বাড়ি
বাড়িতে হয়তো দু তিনটে শোবার ঘর, আর একটি বড় ড্রইং রুম
সবাই মিলে গাদাগাদি একসাথে বসবাস, একসাথে হৈ চৈ,
আমাদের কারো নিজস্ব বলে কিছু ছিলো না
এর জামা ও, তার প্যান্ট সে
যে যেটা সামনে পেত, যার যেটা গায়ে লাগতো সেদিনের জন্য সেটাই তার
সৌহার্দের একান্নবর্তী পরিবার,
আহ কি দিনই না ছিলো! আমাদের সেইসব দিনগুলো,
উচ্চবিত্তদের জীবন আমার জানা নেই;
ছেলেবেলায় আমাদের প্রতিযোগিতার মধ্যে প্রধান ছিল
ভাই বোনদের মাঝে প্রতিযোগিতা,
কে কার আগে ঘুম থেকে উঠবে
কে কার আগে স্কুলের জন্য তৈরি হবে
কে কার আগে হোমওয়ার্ক শেষ করে খুনসুটিতে মাতবে
কে কার আগে খাওয়ার পাটিতে বসবে
মা আজ কার পছন্দের ভর্তাটা বানিয়েছে
মা আজ কার পছন্দের সব্জী রান্না করেছে
কে কার আগে যার যার পছন্দের মুরগীর টুকরোটা তুলে নেবে
(রানটা কিন্তু ছিলো বাবার, ওদিকে নজর দিতাম না কেও)
কে কার আগে মাছের প্রিয় টুকরোটা নেবে
(মাথাটা কিন্তু বাবার, ওদিকে নজর দিতাম না কেও)
কে তাড়াতাড়ি বিছানায় যাবে, কে মায়ের পাশের জায়গাটা দখল করবে
এই সব পারিবারিক ইতং বিতং আর কি,
আহ কি দিনই না ছিলো! আমাদের সেইসব দিনগুলো,
উচ্চবিত্তদের জীবন আমার জানা নেই;
আমাদের প্রতিযোগিতা ছিলো স্কুলে
তখন সাধারণত সব ভাইবোনই একই স্কুলে পড়ার রেওয়াজ ছিলো
তবুও মাঝে মধ্যে যদি প্রাইমারি আর সেকেন্ডারি লেভেলে স্কুল আলাদা হয়ে যেত,
সকালে উঠেই কে কার আগে তৈরি হবে
কে কার আগে স্কুলে যাবে
আবার কে বাসে করে স্কুলে যাবে কিংবা আসবে
কে কে দলবেঁধে হেঁটে যাবে কিংবা ফিরবে
ইত্যাদি ইত্যাদি,
আবার বন্ধুবান্ধবদের মাঝে
কে হোমওয়ার্ক করে নিয়ে গেলো
অনুপস্থিত বন্ধুর প্রক্সি কে দিলো
কে স্যারের স্কেলের বাড়ি খেলো
কাকে বেঞ্চের ওপর দাঁড়াতে হলো
কে কে আজ নীলডাউন হলো
ইত্যাদি ইত্যাদি,
বাড়ি ফেরার পথে এর ওর গাছের দিকে নজর দিতে একটুও ভুল হতো না
কার গাছে কাঁচামিঠা আম ধরেছে, কার গাছে আম পেকেছে
কোন গাছের ডাবে বেশী পানি
কোন গাছের কাঁঠাল মিষ্টি
কোনদিন কার গাছে হামলা দেয়া হবে
দুষ্টুমি আর দুষ্টুমি,
আহ কি দিনই না ছিলো! আমাদের সেইসব দিনগুলো,
উচ্চবিত্তদের জীবন আমার জানা নেই;
তবে একটা জিনিষ ছিলো না আমাদের মাঝে
সম্ভবত তখনকার কারো মাঝেই,
তা হলো বাবা-মার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলা
যত অপছন্দই হোক না কেন তবুও বাবা-মার অবাধ্য হওয়া,
আসলে এটা সাহসের কোন ব্যাপার না
অবাধ্য হওয়াটা তখন মনেই আসতোই না,
হয়তো কখনো সখনো একটু মন খারাপ হতো
তারপর সব ভুলে যেতাম খেলার মাঝে,
আহ কি দিনই না ছিলো! আমাদের সেইসব দিনগুলো,
উচ্চবিত্তদের জীবন আমার জানা নেই;
আজকাল পুরনো দিনগুলোর কথা মনে হলেই বড্ড ভাবালু হয়ে যাই
একান্নবর্তী শব্দটাকে ডিকশনারির পাতায় পাতায় খুঁজে যাই
কোথায় ভাই, কোথায়ই বা বোন
কোথায় সন্তান
পরিবার পরিজন!
সেদিন হুট করেই চাচাতো ভাইটা মারা গেলো
ভাই-ভাবীর এক ছেলে এক মেয়ে
প্রতিষ্ঠিত দুজনই
খুব বেশী রকমই প্রতিষ্ঠিত
একজন কানাডা থেকে একজন থাকে আমেরিকা
এখন তারা উচ্চবিত্ত,
ভাই-ভাবী পুরো বাড়িতে একা
পুরো বাড়ী না বলে বরং পোড়োবাড়ি বললেই বোধহয় ভালো হয়,
একটা কাজের মহিলা আছে, যার কাঁধে পুরো সংসার
সংসার বলতে ভাই-ভাবীর দেখাশোনা
সময় সময় বাড়ির বাজার সদাই করা
মাসে মাসে বিল বাট্টা দেয়া
আর বয়স্ক ভাই-ভাবীর দেখাশোনা;
ভাতিজা ভাতিজি আসে বছরে কিংবা দু বছরে একবার
এক সপ্তাহ কিংবা বেশী হলে দশ দিনের জন্য
তাদের সন্তানদের পড়ালেখার ব্যাঘাত ঘটবে বেশী থাকলে
বয়স্ক বাবা-মাকে ওখানে নিয়ে কোথায় রাখবে?
কেই বা তাঁদের দেখাশোনা করবে?
তো যা বলছিলাম -
ভাই মারা যাওয়াতে ভাতিজাকে ফোন করে বললাম
তোমার বাবা মারা গিয়েছেন, দাফন করে ফেলি;
শুনে তার সন্তানত্ব মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো,
কি বলেন চাচা? বাবা'কে শেষ দেখা দেখব না?
আপনি ফ্রিজারের ব্যবস্থা করেন আমি দেখি কত তাড়াতাড়ি আসতে পারি,
আমি মৃদু স্বরে বললাম
বাবা, মুর্দার কষ্ট হয়, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দাফন করতে হয়,
শুনে কি রাগ! কি রাগ!
আপনাকে যা করতে বলেছি তা করেন
না পারলে আমি অন্য কাওকে দিয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছি,
অগত্য!
ভাই এর ঠিকানা হলো বারডেমের ফ্রিজার
তাও অনেক কষ্টে, অনেক দেন দরবার করে সেখানে একটু জায়গা করতে পেরেছি;
ভাতিজা আমার এলেন দিন পাঁচেক পরে
এর আগে তার ফ্লাইট শিডিউল ম্যাচ করে নি,
মাটি দেয়া সম্পন্ন হলো মৃত্যুর ছয় দিন পর;
তার দুদিন পর ভাতিজা আমার মাকে একা ফেলে রেখে আবার উড়াল দিলো
কত কাজ ফেলে রেখেই না তাকে আসতে হলো!
আর কাওকে তো লাগবেই বাড়ি পাহারা দেবার
তাছাড়া কাজের বুয়া তো আছেই
মা বাড়ির পাহারাদার,
হ্যাঁ! আমি আমার মধ্যবিত্ত ভাই এর উচ্চবিত্ত ভাতিজার গল্প বলছি।
এক এক সময় ভাবি
একসময় বুড়ো বুড়ি আমরাও পরে থাকবো একা
ছেলে মেয়েগুলো যার যার কাজে
হয় দেশে কিংবা বিদেশে
তারাও কি উচ্চবিত্ত হয়ে উঠবে?
আচ্ছা! খুব বেশী উচ্চবিত্ত হলে কি পারিবারিক বন্ধন ছিন্ন হয়ে যায়?
মনুষ্যত্ব লোপ পায়?
ভাগ্যিস বিত্ত আমায় উচ্চ করে নি;
ওহে মানুষ! যত উচ্চবিত্তই হও না কেন!
ছায়াটা কিন্তু মাটিতেই পড়বে।

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন