বুধবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২০

পশুত্বের গর্ব

এক এক সময় পশুগুলোকে দেখি
এক এক সময় পাখিগুলোকে
প্রকৃতিতে ওরা কি সুন্দরই না মানিয়ে আছে!
আছে নিজেদের স্বজাতিতে সুন্দর মিলে মিশে;

আর প্রতিদিন মানুষ দেখি মানুষের মাঝে থেকে
মানুষে মানুষেও মিল আছে, মানুষের মত করে
কিছু রক্তের বন্ধনে, কিছু সামাজিকতার, বাকিটা স্বার্থের
মানুষের কথা লিখতে গেলেই কলম থেমে যায় অন্ধকারে;

পশু পাখিতে শুধুই ক্ষুধা, পেটের ও কামের
কোন পশুকে দেখিনি হত্যা করতে স্বজাতিকে  
কাম! সে তো স্বাভাবিক, গণ-ধর্ষণ দেখিনি পশুতে পশুতে  
হয়তো ওরা গালি দেয় আমাদের মনুষ্যবৃত্তি বলে?

পেটের ও কামের ক্ষুধা সে তো মানুষেরও আছে
মানুষ মানুষ’কে মেরে ফেলে কারণে আর অকারণে
গণ-ধর্ষণ? সে তো মানুষেই করে; ষড়রিপু কোথায় পশুতে?
মানুষ খামোখাই পশুকে অপমান করে, পশুবৃত্তি বলে;

পশু বাবা-মার বলতে হয় না, পশুর মত পশু হ  
অথচ জন্মের পর থেকেই কোন শিশুটা শোনে নি? মানুষ হ!  
আচ্ছা! তাহলে ওটা কার কার জন্ম হয়েছিলো মানুষের গর্ভে?
মানুষের মনুষ্যত্ব দেখে হয়তো পশুরও বুক ফুলে ওঠে, পশুত্বের গর্বে।

৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২০

#কবিতা
পশুত্বের গর্ব
 - যাযাবর জীবন 

বিষপিঁপড়া - গল্প

শান্তার যখন থেকে জ্ঞান বুদ্ধি হয় তখন থেকেই শুনে এসেছে – বাহ! কি মিষ্টি মেয়ে।

মিষ্টি মেয়েদের কি জ্বালা তা শান্তাই ভালো জানে। সময়ের সাথে সাথে শান্তা বড় হচ্ছিলো আর মিষ্টি মিষ্টি শুনতে শুনতে কেমন যেন মিষ্টির প্রতি বিতৃষ্ণা জেগে উঠছিলো। যখন বয়স ছ সাত হলো তখন থেকেই মনে আছে চাচাতো খালাতো ফুফাতো মামাতো ভাইয়েরা মিষ্টি মেয়ে মিষ্টি মেয়ে বলে ছুতোনাতায় শান্তাকে ছুঁয়ে দিতো; এই ছোঁয়াটা শান্তার মনে যেন কেমন অস্বস্তির জন্ম দিতো। তখন শান্ত ঠিক বুঝতো না তবুও এটুকু বুঝতে পারতো ছোঁয়াগুলোতে কেমন যেন একটা অন্যরকম অনুভূতি, শরীর গুলানো অনুভূতি। কই বাবা মা আদর করলে, ছুঁয়ে দিলে, কোলে নিলে তো এমন অনুভূতি হয় না! অন্যরকম এক অস্বস্তিকর অনুভূতি নিয়ে শান্তা বেড়ে উঠতে থাকে।

শান্তার বয়স যখন দশ এগারো তখন  এই সব ভাইদের সাথে সাথে যেন বাসায় বেড়াতে আসা বাবার কিছু কিছু বন্ধুরাও বাহ! আমাদের মিষ্টি মেয়ে বলে আদরের ছুঁতোয় শান্তার শরীর ছুঁয়ে দিতো। শান্তা কিছু বলতে পারতো না, কেমন এক ঘিন্না মেশানো অনুভূতিতে তার শরীর গুলিয়ে উঠতো। সে পারতপক্ষে এর পর থেকে আর বাবার বন্ধুদের সামনে যেতে চাইতো না।

একদিন শান্তার চাচ্চু বাসায় এলো, সেদিন বাবা-মা নেই; শান্তা একা। চাচ্চু বললেন শান্তা মা একটু পানি দে তো! শান্তা পানির গ্লাস হাতে ড্রইংরুমে এলো। চাচ্চুকে পানি দিয়ে অন্যদিকের সোফায় বসলো। চাচ্চু পানি খেয়ে শান্তার সাথে টুকটাক গল্প করতে করতে উঠে এসে শান্তার পাশে বসলো। শান্তা কিছু মনে করে নি, আপন চাচ্চুই তো! আস্তে আস্তে মামনি মামনি বলে এটা ওটা গল্প করতে করতে চাচ্চুর হাত শান্তার মাথা বেয়ে পিঠে হাত বুলাতে লাগলো, শান্তা চমকে উঠলো; তার গা ঘিনঘিনে অনুভূতিটা প্রবল হয়ে উঠলো। সে চাচ্চুর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখে সেখানে কেমন যেন এক গা ঘিনঘিনে চকচকে অপরিচিত দৃষ্টি। কোথায় জানি! কোথায় জানি! এ দৃষ্টি দেখেছে সে কিছুতেই মনে করতে পারছে না। তারপর চট করেই মনে পড়লো ‘দি ডেভিল’ সিনেমায় হায়েনার চোখের সাথে যেন চাচ্চুর এ দৃষ্টি পুরোপুরি মিলে যাচ্ছে। কথা বলতে বলতেই একবার যখন মাথা থেকে হাত পিঠে না গিয়ে সামনে থেকে বুক বেয়ে পেটে নেমে এলো তখনই শান্তার প্রবল বমির বেগ পেয়ে গেলো, সে দৌড়ে গিয়ে বাথরুমে ওয়াক ওয়াক করতে লাগলো। শান্তার চাচ্চু কি হয়েছে! কি হয়েছে! বলে তার সাথে সাথে বাথরুমের দরজার পাশে এসে দাঁড়ালো। আরেকবার কি হয়েছে মামনি বলতেই শান্তা তীব্র চোখে তার চাচ্চুর দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। চাচ্চু চোখ নামিয়ে নিলেন, ধীর পায়ে হেঁটে বাসা থেকে বের হয়ে গেলেন। শান্তা এ কথা কোনদিন কাওকে বলতে পারে নি, তবে সে তার চাচ্চুর সামনে একা আর কখনোই যায় নি।
 
শান্তার ফুপু থাকেন লন্ডনে, ফুপা রেস্টুরেন্ট ব্যবসা করে প্রচুর টাকার মালিক। ওনারা দুই এক বছর পর পর দেশে আসেন। প্রত্যেকবারই ফুপু শান্তাদের জন্য অনেক অনেক গিফট নিয়ে আসেন, আসল শান্তাদের বাড়িতেই ওঠেন। এবার ফুপুরা এলেন প্রায় দুই বছর পর। এই ফুপুকে শান্তা অনেক পছন্দ করে, ফুপুও শান্তাকে মেয়ের মতই দেখেন। ফুপাও খুবই ভালো আচরণ করেন। ওনারা আসার প্রথম দুইদিন হৈ চৈ করে খুব ভালোভাবেই কেটেছে। শান্তা লক্ষ্য করেছে এবার ফুপার আচরণে কেমন যেন একটু পরিবর্তন এসেছে, আড়ে আড়ে কেমন চোখে যেন শান্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। সবার সামনে মা মা করে অথচ ওনার চোখে শান্তা যেন চাচ্চুর ছায়া দেখতে পায়। তৃতীয়দিন বিকেলে শান্তা ড্রইংরুমে বসে একমনে টিভি দেখছিলো, ফুপা ফুপু দুপুরে লাঞ্চের পর বেডরুমে শুয়ে রেস্ট নিচ্ছিলেন। হঠাত করেই শান্তা লক্ষ্য করলো ফুপা এসে তার পাশে বসেছেন। কি দেখছিস রে মা, বলে একদম কাছ ঘেঁষে বসলেন। শান্তার মনে হঠাত করেই পুরনো অস্বস্তিকর অনুভূতিটা ফিরে আসলো, খালুর রান শান্তার রানে ঘষা খাচ্ছে, খালু কথা বলতে বলতেই শান্তার মাথায় হাত দিয়ে আদর করতে করতে পিঠে নামাতে লাগলো; তারপর খুব হঠাৎই মাথা থেকে শান্তার বুকে হাত চলে আসলো। ঝট করে শান্তা খালুর চোখে তাকাতেই হায়েনার চোখ দেখতে পারলেন, মুখে নেকড়ের হাসি। হতভম্ব শান্তার বুঝতে দেরি হয়ে গেলো মা মা ডাকতে ডাকতে কিভাবে একটা লোক অবলীলায় তার বুক ছানছে। শান্তা লাফ দিয়ে উঠে দৌড়ে তার রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে হাঁপাতে লাগলো। সারা শরীর ঘৃণায় রি রি করছে, শান্তা বাথরুমে ঢুকে শাওয়ারের নীচে ভিজতে লাগলো, যেন ফুপার নোংরা হাতের স্পর্শ ধুয়ে ফেলতে চাচ্ছে।

এবার শান্তা আর চুপ থাকতে পারলো না, রাতের ডিনারের শেষে শান্তা তার ফুপুকে তার রুমে ডেকে নিয়ে আসলো। ফুপু এসে বললো কিছু বলবি? শান্তা অনেকক্ষণ আমতা আমতা করে কাঁদতে কাঁদতে দুপুরের ঘটনা ফুপুকে খুলে বললো। ফুপু কতক্ষণ হতভম্ব চোখে শান্তার দিকে চেয়ে থেকে তার গালে সজোরে থাপ্পড় মেরে বসলেন। ছিঃ শান্তা ছিঃ! এই বয়সেই তোর মনে এইগুলো! তোর ফুপার মত এমন সুফি মানুষের নামে তুই এই কথা বলতে পারলি? তার থেকে বেশি হতভম্ব হয়ে গেলো শান্তা, যেন বলে বিশাল এক অন্যায় করে ফেলেছে। পরদিনই ফুপুরা বোঁচকা বুঁচকি নিয়ে ফুপাদের বাড়ি চলে গেলো। সেই শেষ, ফুপুরা আর কখনো শান্তাদের বাড়ি আসে নি।

শান্তা এখন বড় হয়েছে, কলেজে পড়ে। সে ছেলেদের দৃষ্টি কোনটা কি, ছেলেদের ছোঁয়া কোনটা কি খুব ভালোই বুঝতে পারে। বন্ধুদের মধ্যে অনেক ভালো বন্ধুই আছে যাদের সামনে সে কোন অস্বস্তি অনুভব করে না, আবার কিছু বন্ধু আছে যারা সামনে এলে যেন চোখ দিয়ে চাটে। খালাতো, চাচাতো, মামাতো, ফুপাতো ভাইদের মধ্যেও কয়েকজন খুবই আন্তরিক যাদের দৃষ্টির মাঝেই বোন সুলভ এক মায়া অনুভব করে, তাদের সাথে শান্তা খুব স্বাচ্ছন্দ্য; আর কয়েকটা আছে যারা থাকলে পারতপক্ষে শান্তা ভাইবোনদের আড্ডাতেও বসে না, ঐ গা গুলানো বিবমিষা। আর এখন শান্তার চেহারা যতই মধু হোক না কেন, সময় আর পরিস্থিতি তাকে আমূলে বদলে দিয়েছে; ছোঁয়াছুঁয়ি তো অনেক দূরে তার কথাতেই অনেকে এখন বিষ অনুভব করে। এই বয়সেই শান্তা খুব ভালো বুঝে গেছে কার সাথে কেমন ব্যবহার করতে হবে। শান্তার চাচ্চু আজকাল খুব কমই বাসায় আসে, আসলেও শান্তা এমনভাবে তীব্র এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে! যেন উনি পালিয়ে যেতে পারলে বাঁচেন।

ইদানীং মহল্লার ছেলেপেলেগুলি শান্তাদের বাড়ির আশেপাশে ঘুরঘুর করে, মিষ্টির গন্ধ দূর দূর বোধহয় ছড়িয়ে পড়েছে। শান্তা বাড়ি থেকে বের হলেই পেছনে অনেকগুলো দৃষ্টি অনুভব করে। শান্তার এগুলো সয়ে গেছে, পুরুষমানুষ মাত্রই সুন্দর দেখবে এ আর এমন নতুন কি! তবে আজকাল ছেলেগুলো যেন একটু বেশীই ডেয়ারিং হয়ে গেছে, প্রায়ই এটা ওটা মন্তব্য ছুঁড়ে দেয় শান্তার আসা যাওয়ার পথে, শান্তা না শোনার ভান করে রিক্সায় উঠে যায়। বাড়ি থেকে কলেজ আরা কলেজ থেকে বাড়ি, এর বাইরে সাধারণত শান্তা একা আর কোথাও যায় না। এর মধ্যে একদিন দুজন খুব সাহস দেখিয়ে রাস্তায় শান্তার রিক্সা থামিয়েছিলো, সেই পুরনো কথা – বাহ! কি মিষ্টি! কি মিষ্টি! মনে হয় খেয়ে ফেলি! শান্তা তীব্র দৃষ্টিতে তাদের দিকে চেয়ে থাকে, কিন্তু ওদের মধ্যে এ দৃষ্টির কোন আছর পড়ে না। একজন রিক্সায় উঠতে গেলে শান্তা ধাক্কা মেরে তাকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে চেঁচামেচি শুরু করে দেয়। আশেপাশে থেকে মানুষজন জড়ো হয়ে যায়, ছেলেগুলো দেখে নেব বলে শাসিয়ে চলে যায়। বাসায় এসে এ কথা বলতেই এরপর থেকে মা শান্তাকে সাথে করে কলেজে দিয়ে আসে, কলেজ থেকে নিয়ে আসে; মহল্লার বখে যাওয়া ছেলেপেলেগুলো দূরে সরে থাকে। এভাবেই কাটছিলো শান্তার দিন।

একদিন মা অসুস্থ, শান্তা গায়ে হাত দিয়ে দেখে বেশ জ্বর; তাই কলেজে যাওয়ার সময় সাথে যেতে পারেন নি। কেও কি লক্ষ্য করেছে? শান্তা কলেজে গেলো ভয়ে ভয়ে, নাহ! কেও বোধহয় লক্ষ্য করে নি; কেও সামনেও আসে নি। বিকেলে কলেজ থেকে বের হয়ে দেখে মা আসেন নি; শান্তা ভাবছিলো – তবে কি মায়ের জ্বর বেড়ে গেলো? শান্তা তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরার তাগিদ অনুভব করে। রিক্সাওয়ালাকে বলে, মামা একটু জোরে টানো, তাড়াতাড়ি পৌঁছতে হবে। কলেজ থেকে মহল্লায় ঢোকার মুখে কয়েকটা খালি প্লট, এখনো এখানে বিল্ডিং ওঠে নি; জায়গাটা খানিকটা নির্জন। হঠাত করেই যেন প্লটের ভেতর থেকে ছজন একসাথে বের হয়ে আসলো, সামনে থেকে এসে রিক্সার পথরোধ করে দাঁড়ালো। ওদের মধ্যেই একজনকে শান্তা ঐদিন রিক্সা থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলো; শান্তা ভয়ে কুঁকড়ে গেলো।  আজ আর রিক্সায় ওঠার চেষ্টা না করে শান্তাকে জোর করে টেনে হিঁচড়ে রিক্সা থেকে নামিয়ে নিলো, একা শান্তা এতজন ছেলের সাথে জোড়ে পেরে উঠবে কি করে? রিক্সাওয়ালাকে দুইটা ঘুষি মেরে তাকে রাস্তায় ফেলে ওরা রিক্সার মধ্যেই ঝাঁপিয়ে পড়লো শান্তার ওপর। চার পাঁচ জনার একসাথে বুকে পেটে পাছায় থাবা চালাচ্ছে। শান্তার মনে হলো বিষপিঁপড়া কামড়াচ্ছে। কেও কাপড় খোলার চেষ্টা করছে কেও বা কাপড়ের ওপর দিয়ে শরীর ছানছে। রিক্সাওয়ালাটা সেদিন খুব বুদ্ধিমানের কাজ করেছিলো, সে মাটি থেকে উঠেই চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে, একজনকে এর মধ্যে ধরে মাটিতে শুইয়ে ফেলেছে। আশেপাশের কিছু মানুষেরও ততক্ষণে এইদিকে নজর পরেছে তারা দলবেঁধে ছুটে আসতে শুরু করতেই বখাটেরা চম্পট দিলো। তারপর এ নিয়ে থানা পুলিশ অনেক কিছু হয়েছিলো, দুজনকে পুলিশ ধরে আনতে পেরেছিলো আর বাঁকি চারজনকে খুঁজে পেতে প্রায় মাস খানেক লেগেছিলো। শেষ পর্যন্ত ধরা তারা পড়েছিলো সকলেই। মেয়েদের বোধহয় এটাও এক জীবন, রাস্তাঘাটে সাবধানে চলতে হয় কুকুর দেখে, কে জানে! কখন যে কুকুরগুলো কামড়ে দেবে পেছন থেকে। মহল্লায় এ ঘটনার রেশ থেকেছে অনেকদিন ধরে।

শান্তা এতদিনে বুঝে গেছে - আসলে মিষ্টি তার চেহারা না, মিষ্টি তার শরীরটা; আর তার চারপাশে ঘুরঘুর করছে হাজারে হাজারে বিষপিঁপড়া।  


২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২০

#গল্প
বিষপিঁপড়া
 - যাযাবর জীবন


ছবিঃ নেট থেকে সংগৃহীত ।



মাটি দেও - গল্প

আইজ তিনদিন ধইরা ধলু ব্যাপারির মিজাজ আসমানে উইঠঠা আছে। মিজাজ খারাপ হইলে ধলুর মুখে খালি থুথু আহে, একটু পর পিচিক পিচিক কইরা থুথু ফালাইতাছে; তারপরও মিনিটে মিনিটে মুখ ভইরা যেন এক পুস্কুনি থুথু আইয়া জমে।  

পুস্কুনির পাড় ধলু ব্যাপারির সবচেয়ে পছন্দের জায়গা। পুস্কুনির দক্ষিণ পাড়ে একটা ছোট্ট একচালা বেড়ার ঘর বানায় লইছে। যত্তসব আকাম কুকাম ধলুর এই চালাঘরে। সন্ধ্যাডা হইতে দেরি, চ্যালা আক্কাসের বাংলা মদের বোতল খুইল্লা দিতে দেরি হয় না, লগে পিয়াইজ মরিচ দিয়া বাদাম, নাইলে চানাচুর মাখা রেডিই থাকে। ধলু ব্যাপারি সারাদিন গুদামের কাম শেষে সন্ধ্যা বেলায় আইয়া এই চালাঘরে ঢুকে। নেশা রঙিন হইয়া উঠলে শরীলডা মাইয়া মাইন্সের লাইজ্ঞা কানতে থাহে। আক্কাইস্যা মাঝে মইধ্যে গঞ্জ থাইক্কা মাগী ভাড়া কইরা লইয়া আহে, তারপর নেশা জইমা উঠলে সারারাইত মচ্ছব। ধলু বেশিরভাগ রাইত এইহানেই কাটায় দেয়, মাঝে মইধ্যে মাগীর আমদানি না হইলে নেশায় বুঁদ হইয়া ঘরে ফিরা বৌ এর উপ্রে ঝাপায় পড়ে। আইজ তিনদিন ধইরা তার নেশার বারটা বাজছে, সব ওলোটপালট হইয়া গেছে। যত নষ্টের গোড়া ঐ কামলা সামসুর হারামি বৌডা।

সামসুর যুয়ান সুন্দরী বৌ এর দিকে ধলুর কুনজর পড়ছে অনেকদিন ধইরাই, এতদিন চেষ্টা কইরাও বাগে আনতে পারে নাই। গত সপ্তাহে সামসুরে অনেক ফুসলাইয়া টেকার লোভ দেহাইয়া এক সপ্তাহের লাইজ্ঞা চরের ক্ষেতে কামলাগো সর্দার বানায় পাঠাইতে পারছে। চর গ্রামের থাইক্কা নৌকায় আধা দিনের রাস্তা, তাই ঐহানে কামলারা একবারে সাত দিন কইরা বদলি ডিউটি করে। এর আগে সামসুরে কামলা হিসাবে চরে পাঠাইতেই পারে নাই, তাই সর্দার হওনের প্রস্তাব দিতেই সামসু আর লোভ সামলাইতে পারে নাই। সর্দারের মজুরি কামলা থাইক্কা আড়াইগুন বেশি, আর চরে সব ক্ষেমতাও সর্দারগো হাতে; এইবার সামসু টোপ গিলছে।

সামছু যাইতেই ঐ রাইতে আক্কাসরে পোলাপাইন সহ পাঠাইয়া সামসুর বৌরে হাতপা বাইন্ধা তুইলা লইয়া আইছে। তারপর তিন রাইত ধইরা চলছে মচ্ছব। চিন্তা করছিলো সামসুর বৌরে প্রথম রাইতেই বাগে আনতে পারব, কিন্তু হারামি বেডি এত্ত বদ তিনরাইতেও বাগে আহে নাই। প্রত্যেক রাইতেই জোড় খাটাইতে হইছে। জোড় খাটাইয়া প্রত্যেকদিন কি আর মজা পাওন যায়? হারামি বেটি চতুর্থ রাইতে সুযোগ পাইয়া পায়ের গোড়ালি কামড়াইয়া ধরছিলো, এই যে ধরছে আর ছাড়াছাড়ির নাম নাই। ধলুর পায়ের গোড়ালির মাংস কাইট্টা দাঁত বইয়া গেছিলো, রক্তে তোষক বিছানা সব সয়লাব। চিল্লাইয়া আক্কাসরে ডাইকা হেরে দিয়া পা ছুডাইছিলো। একে লালপানির নেশা তারপর মাগীর তামশা, রাগের চোটে ধলুর মাথা পুরাই আউলায় গেছিলো, বারান্দা থাইক্কা দাওডা আইন্না মাগীরে ধামাধাম কোপাইতে লাগলো, রক্তে পুরা ঘর ভাইসা গেলো। শেষে আক্কাইসা আইসা থামাইয়া দাও কাইড়া লইলো। আক্কাসে ভালো কইরা দেইহা কইলো হুজুর মাগী তো মইরা গেছে! এহন কি হইবো!

ধলুর যেন হুশ ফিরলো, অনেক্ষণ চিন্তা কইরা কইলো, এক কাম কর, লাশটা বস্তায় ভইরা বিশ পঁচিশটা ইটা বাইন্ধা পুস্কুনিত ফালায় দে। মাছে খাইয়া ফালাইব নে। হেই থাইক্কা আইজ তিন দিন হইয়া গেলো ধলু মিয়ার ঘুম হারাম হইয়া গেছে। চোখ লাগলেই হারামি মাগীডা চোখের সামনে চইলা আহে, ধলু ধরফরাইয়া ঘুম থাইক্কা উইঠঠা বসে। একে তো দুশ্চিন্তা যে সামসুর আওয়ার  সময় হইয়া গেছে আরেকদিকে অর্ঘুমে চোখ মুখ সব বইয়া গেছে। সারাক্ষণ মুহের ভিতর থুথু জমতে থাকে আর ধলু পিচিক পিচিক কইরা থুথু ফালায়।

আইজ বিকাল বেলায়ই ধলু ব্যাপারি তার চালা ঘরে ঢুইকা বোতল লইয়া বইছে। আক্কাসরে পাঠাইছে গঞ্জের বাজারে। সন্ধ্যা হইব হইব ভাব, এর মইধ্যেই ধলু মিয়ার আধা বোতল সাবার।  পুস্কুনি পাড়ে কেও নাই, হঠাত কইরাই শুনে কে যেন কানতেছে; ধলু মিয়া এদিক চায় ওদিক চায়, কাওরে দেহে না। চালাঘর থাইক্কা বাইর হইয়া পুস্কুনি পাড়ে আইসা খুঁজতাছে কে কান্দে? হঠাত কইরা পুস্কুনির দিকে চাইয়াই ধলু মিয়ার কইলজায় কামুড় দিয়া উঠলো। দেহে সামসুর হারামি বৌডা পানির থাইক্কা গলা বাইর কইরা তার দিকে চাইয়া রাইছে আর খুনখুন কইরা কানতাছে। ধলুর যেন জ্ঞান বুদ্ধি লোপ পাইলো, চিৎকার কইরা উঠলো – ঐ মাগী কান্দস কেরে?   

সামসুর বৌ এর কান্দা বন্ধ হয় না, বরং বাড়তেই থাকে। খুনখুন কান্নাটা যেন ধলু মিয়ার মাথায় গিয়া বিনতাছে, সাথে সাথে কইত্থাইকা যানি এক অসম্ভব রকম ভয় শরীরে ভর করতে থাকে, ধলু মিয়ার হাত পা অবশ হইয়া আসতে থাকে।
ধলু মিয়া এইবার গলার স্বর নামাইয়া আস্তে আস্তে জিগাইলো, ঐ মাগী! তরে না মাইরা ছালার ভিতর ভইরা ডুবাইয়া দিসি? তুই উঠলি কেমনে?
সামসুর বৌ কথার জবাব দেয় না, খুনখুন কান্না বাড়তেই থাকে, সাথে সাথে বাড়তে থাকে ধলু মিয়ার ভয়।
ধলু মিয়া আবার জিগায় – ঐ মাগী! কি চাস তুই?
সামসুর বৌ এইবার কয় – মাটি চাই ব্যাপারি, মাটি চাই; পানিতে আর ভালো লাগতেছে না, আমারে পুস্কুনি থাইক্কা তুলো, গোসল দেও, জানাজা দেও, কব্বর দেও, মাটি দেও।
ধলু মিয়া এইবার ভয়ের চোটে সাদা হইয়া যাইতে লাগলো, কইলো ভাগ মাগী, ভাগ। দূর হ চোখের সামনে থাইক্কা! দূর হ মাগী, দূর হ।
সামসুর বৌ ঐদিকে ক্রমাগত কইতেই লাগলো – মাটি দেও, মাটি দেও, মাটি দেও, মাটি দেও, মাটি দেও………… যেনো সমস্ত পুস্কুনি জুইড়া পানিগুলোও একসাথে কইতে লাগলো মাটি দেও, মাটি দেও, মাটি দেও; আশেপাশের গাছগুলাও যেন সুর মিলাইলো – মাটি দেও, মাটি দেও, মাটি দেও।
এইবার ধলু ব্যাপারি ঘামতে লাগলো, ভয়ের চোটে দোয়া দুরূদ পড়তে চাইলো কিন্তু কিছুই মনে করতে পারলো না; আর চারিদিক থাইক্কা সবাই যেন কানের ভিতর ড্রাম বাজইতে লাগলো মাটি দেও, মাটি দেও, মাটি দেও …………।
ধলু ব্যাপারি নিজের অজান্তেই আস্তে আস্তে পুস্কুনির দিকে আগাইতে লাগলো, তারপর কে যেন তারে টাইন্না পুস্কুনির ভিতরে নিয়া যাইতে লাগলো। হাটু পানি, কোমর পানি, বুক পানি, তারপর অঠাই; ধলু ব্যাপারি ডুবতে লাগলো আর চারিদিক থাইক্কা রব উঠতে লাগলো মাটি দেও, মাটি দেও, মাটি দেও।

পরদিন সকালে ধলু ব্যাপারির লাশ ভাইসা উঠলো পুস্কুনির মইধ্যেখানে, পানির ভিতর মাথা দিয়া উপুর হইয়া ভাসতে আছে।


২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০

#গল্প
মাটি দেও
 - যাযাবর জীবন


এক বৃহণ্ণলার গল্প - গল্প

খুব ছোট বেলার কথা। হালিম (আসল নামটা উহ্য রাখলাম) আমার বন্ধু। এক সাথে এক ক্লাসে পড়ি। সে সময়কার ছেলেবেলা এখনকার মত ঘরের গণ্ডিতে বন্দী না। একদম উদ্দাম উচ্ছল সরল। সকালে স্কুলে যেতাম, দুপুরে কোনমতে বইখাতা ঘরে রেখেই দুটো খেয়ে দলবেঁধে ছুটতাম খেলার মাঠে। আমাদের মাঝে কে ধনী কে গরীব কার বাবার সামাজিক অবস্থান কি আর বাবা কি করে এগুলো নিয়ে কখনো মাথা ঘামাই নি কখনোই, আসলে ঐ বয়সে এগুলো মাথায় আসেই নি! ঘামাবো কি করে? তখন শুধু স্কুল আর খেলা, ব্যাস! এটুকুই জীবন। তখনকার সবচেয়ে অসহনীয় অংশটুকু ছিলো সন্ধ্যের পর পড়তে বসা। বসতে হতো মায়ের সামনে; কোন দিন পড়তে বসতে ইচ্ছে না করলে বাবার চোখ গরম আর মায়ের হাতের মার; আমাদের সময় কমবেশি এটাই কমন ছিলো।

তো যে কথা বলছিলাম, হালিম। হ্যাঁ হালিম ছিলো সেই ক্লাস ওয়ান থেকে আমার সহপাঠী, আমার বন্ধু। আমরা একসাথে স্কুলে যেতাম, একসাথে টিফিন ভাগ করে খেতাম, একসাথে বিকেলে খেলতে যেতাম। ওহ একটা কথা বলা হয় নি, আমরা ক্লাস ওয়ান থেকে পড়তাম গার্লস স্কুলে। তখন আমাদের মহল্লার গার্লস স্কুলে ছেলেরা পড়তে পারতো ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত, তারপর স্কুল বদল করতে হতো। যেহেতু বাড়ির পাশে স্কুল, আর তখনকার দিনে এত স্কুল কলেজের কোন বাছবিচার ছিলো না আর বয়েস বা গার্লস নিয়ে আমাদের মাঝে কোন মাথাব্যথা ছিলো না তাই গার্লস স্কুলেই আমরা মহল্লার সমবয়সী সব ছেলেমেয়ে মিলেমিশে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে ছিলাম। যখন ক্লাস ফাইভ এর পরীক্ষা দেওয়ার পর আমাদের স্কুল বদলের সময় এলো আমরা সবাই খুব মনমরা ছিলাম। আমার বেশ মনে আছে, স্কুলের শেষ দিনে ক্লাসের মেয়েরা ছলছল চোখে আমাদের বিদায় জানিয়েছিলো, মায়ের মাইর ছাড়াও যে অন্য কোন অনুভূতি জনিত কারণে চোখে পানি আসতে পারে ওটা যেন সেই প্রথম বুঝতে পেরেছিলাম। অনুভূতিটা যে কি তা আসলে তখনো বোঝার বয়স হয় নি।
 
আমরা প্রায় বিশ জন মত ছাত্র ছিলাম ঐ স্কুলে, বাকি ত্রিশ মত মেয়ে; মেয়েরা তো রয়ে গেলো সেই স্কুলেই। আর আমাদের স্কুল বদলের পালা। এর মধ্যে আমি যে স্কুলে ভর্তি হলাম সেটাও তখনকার নামকরা কো-এডুকেশন স্কুল। সেখানেও ছেলে মেয়ে একসাথে। আমার পুরনো স্কুলের বন্ধুদের মধ্যে একমাত্র হালিমই আমার সাথে ঐ স্কুলে চান্স পেলো (স্কুলের নামগুলো উহ্য রাখলাম)। হালিমকে পেয়ে আমি বেশ খুশি, যাক! অন্তত একজন পুরনো বন্ধু তো জুটলো! এই স্কুলে এসে প্রথম সামাজিক অবস্থানের বিভেদের মধ্যে পড়ে গেলাম, ধনী-গরীব, বাবার আর্থিক অবস্থান এগুলো যে বন্ধুত্বের বিষয় হতে পারে তা কিছুদিন যেতেই হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করলাম। আমার খুব মনে আছে প্রথম দুই বছর নতুন স্কুলে মানিয়ে নিতে আমার বেশ কষ্ট হয়েছিলো, কষ্ট হয়েছিলো হালিমেরও, কষ্ট হয়েছিলো আমার মত আরো কয়েকজনের যাদের বাবার আর্থিক অবস্থান আমাদের সমপর্যায়ের। আমরা বাসে করে স্কুলে যেতাম, স্কুল বাস না কিন্তু! তখনকার দিনের ৬ নাম্বার লাইনের বাস। সেই ভোর বেলায় বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম, আবার দুপুরে স্কুল শেষে ৬ নাম্বার বাসেই বাসায় ফিরতাম। বাসে যেতে যেতেই আমার মত সামাজিক অবস্থানের আরো কয়েকজন বন্ধু বান্ধবের সাথে পরিচয়, কেও আমার দু এক ক্লাস ওপরে কেও দু এক ক্লাস নীচে আর কয়েকজন আমারই ক্লাসের। প্রথম বছর মানে ক্লাস সিক্স খুবই কষ্টে কাটালেও পরের বছর মানে ক্লাস সেভেন থেকে যেন অনেকটা সহনীয় (আমি বলবো অভ্যাসে পরিণত) হয়ে গিয়েছিলো। আর ওপর মহলের বন্ধু বান্ধবীরা এক একজন আসতো এক এক নামী দামী ব্র্যান্ডের গাড়িতে চেপে। আমি অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকতাম, যেন অন্য গ্রহের কোন রাজপুত্র কিংবা রাজকন্যা, ভুলে আমার ক্লাসের সহপাঠী হয়ে এসেছে।

ক্লাস এইটে ওঠার পর ওপর মহলের ঐ রাজপুত্র রাজকন্যাদের সাথে তখন বেশ ভালো সখ্যতা হয়ে গিয়েছে, দুই চারজন বন্ধু হিসাবেও যেন আমাদের সাথে মেশা শুরু করেছে, মন থেকে আস্তে আস্তে কালিমা দূর হয়ে যাচ্ছিলো। হালিম তখনো যথারীতি আমার ছায়াসংগী হয়ে। ক্লাস এইট থেকেই শরীরে পিউবারটিক্যাল চেঞ্জ আসা শুরু করেছে, তখনকার দিনে এগুলো খুব গোপন বিষয় ছিলো, কারো সাথে ডিসকাস করার উপায় ছিলো না; বন্ধুদের মধ্যেও এই বিষয়টা নিয়ে যেন সবাই বেশ বিব্রত ছিলো।  সেই সময়, হ্যাঁ সেই সময়ই হালিম যেন কেমন অন্যরকম ব্যবহার করা শুরু করে দিলো। সে যেন খুব হঠাৎ করেই একদম অপরিচিত হয়ে উঠতে শুরু করলো। প্রথম প্রথম ক্লাস মিস দেওয়া শুরু করলো, তারপর বেশ বিরতি; ব্যবহারে ব্যাপক পরিবর্তন অল্প কিছুদিনের মাঝেই। তার মাঝে যেন কেমন একটা মেয়েলি ধাঁচের আচরণ লক্ষ্য করছিলাম। ছেলে আর মেয়ের পার্থক্য ক্লাস এইটের ছাত্রছাত্রীদের বোঝাতে হয় না, ওটা প্রকৃতিই বুঝিয়ে দেয়। হালিমের গায়ে পড়া, গায়ে ঢলা মেয়েলি আচরণে আমরা খুব বিরক্ত, বিব্রত; বিশেষ করে আমি। ওকে প্রায়ই বকাঝকা করি। তোর কি হয়েছে? এমন করিস কেন? বাকি বন্ধুরা মজা করে ওকে প্রায়শই হালিমা বলে ডাকতো। একদিন হঠাত করেই সে স্কুলে আসা বন্ধ করে দিলো।

বেশ কিছুদিন স্কুলে না আসাতে একদিন তার বাসায় গেলাম খবর নিতে, চাচা চাচী আমার সাথে হালিমের দেখা করতে দিলো না। বললো হালিম অসুস্থ পরে আসো। মনে আছে সেদিন খুব মন খারাপ করে চলে এসেছিলাম। তারপর আবার প্রায় মাস খানেক পর হালিমদের বাসায় গেলাম। এবারো তার সাথে দেখা হলো না, চাচি জিজ্ঞাসা করলেন কি দরকার তাকে? আমি বললাম সে স্কুলে যাচ্ছে না অনেকদিন, কোথায় সে? কেমন আছে? চাচি বললেন সে আর আমাদের স্কুলে যাবে না, সে নাকি চিটাগাং তার খালার বাসায় চলে গিয়েছে, ঐখানে কোন এক স্কুলে ভর্তি হয়েছে। আমি বললাম চাচি ফোন নাম্বার আছে? কিংবা ঠিকানা দেন, আমি চিঠি লিখব তাকে। চাচি ফোন নাই, ঠিকানা দেয়া যাবে না বলে প্রায় খারাপ ব্যবহার করেই সেদিন বিদায় দিয়েছিলেন মনে আছে। আমি খুব দুঃখ পেয়ে সেদিন চলে এসেছিলাম। যত না চাচির ব্যবহারে দুঃখ পেয়েছি তার থেকে বেশি কষ্ট পেয়েছি হালিমের ব্যবহারে, আমার বাল্য সাথী যাবার আগে আমাকে একবার বলে গেলো না?

সময় কারো জন্য বসে থাকে না। প্রায় বছর কেটে গেছে, ক্লাস নাইনের পরীক্ষার পর হঠাৎই একদিন রাস্তায় দেখা হয়ে গেলো হালিমের সাথে। কোন মেয়ে যেন পেছন থেকে ডাকছে, এ্যই আহসান! এ্যই আহসান। আমি চমকে পেছনে তাকালাম। দূর থেকে দেখি ববকাট চুলে অপরিচিত এক মেয়ে পেছন থেকে ডাকছে, আমি চিনতে না পেরে দাঁড়ালাম; কাছে আসার পর ভালো করে লক্ষ্য করে দেখি হালিম, আমি অসম্ভব চমকে উঠে জিজ্ঞাস করলাম কিরে হালিম! তোর কি অবস্থা? তুই এমন  মেয়েদের বেশ ধরছিস কেন? সে মেয়েদের মত হাত পা ঘুরিয়ে বললো, সে অনেক কথা; আগে বল আমাকে কেমন লাগছে?
আমি বললাম তোরে কেমন লাগবে? একদম মেয়েদের মত লাগছে; তুই মেয়ে সাজছিস কেন তাই আগে বল?
সে বললো তুই বুঝবি না। আমি আসলেও বুঝি নি, আমাদের সময় বৃহণ্ণলা খুব কমন ফ্যাক্টর ছিলো না। রাস্তাঘাটে হিজড়া দেখা যেত খুব অল্প, তবে তাদের কেন হিজড়া বলে কিংবা ছেলে, মেয়ে আর হিজড়ার পার্থক্য বোঝার মত এত জ্ঞানগরিমা ঐ বয়সে আসলে আমাদের মাথায়ই ছিলো না। আচ্ছা আজ যাই রে, তোর সাথে অন্য একদিন দেখা করব, কিন্তু খবরদার তুই আমাদের বাসায় আসবি না, বলে সে সেদিনের মত চলে গেলো।

এরপর হালিমের সাথে দেখা আবার প্রায় তিন বছর পরে, তাও খুব হঠাৎ করেই। তখন আমি ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি। বৄহণ্ণলা কি ততদিনে আমার জানা হয়ে গেছে। হালিম ততদিনে শারীরিক ও মানসিক ভাবে প্রায় পুরোপুরি বৄহণ্ণলায় পরিণত হয়ে গেছে। আমার বাল্যবন্ধু, তাকে এ অবস্থায় দেখে আমার চোখে পানি চলে এসেছে। হালিম আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো, চল কোথাও বসি। আমার সাথে বসতে তোর লজ্জা করবে না তো! আমি বললাম তুই যেই হোস না কেন তুই আমার বন্ধু, আর বন্ধুর সাথে কোথাও বসতে লজ্জা করবে কেন? চল কোন রেস্টুরেন্টে বসি। সে বললো, না রে! রেস্টুরেন্টে না, ওখানে লোকজন আমার দিকে খুব খারাপ নজরে তাকায়। চল মাঠের দিকে যাই। প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, ওখানে বসে তোর সাথে একটু কথা বলি। জানিস! আমার না কথা বলার কেও নাই। বলে আমাকে নিয়ে আমাদের পুরনো খেলার মাঠে গিয়ে বসলো।

এরপর সে যা বললো তা শোনার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। একজন ছেলে থেকে বৃহণ্ণলা হওয়ার করুণ ইতিহাস।
এটা তার হালিমের মুখ থেকেই না হয় শুনি!

 - আমি ক্লাস সেভেন থেকেই শরীরে কেমন যেন অস্বস্তি অনুভব করতাম, কেমন যেন অন্যরকম একটা অস্বস্তি। হঠাত হঠাত মনে হতো আমি যেন ছেলে না, আমি যেন মেয়ে হয়ে গেছি। ভালো করে শরীরে, গোপন অঙ্গে হাত বুলিয়ে দেখতাম নাহ! আমি তো ছেলেই আছি, তবুও মনের মধ্যে অস্বস্তি। দিন দিন এটা বাড়তে লাগলো, ছেলেদের সঙ্গ মনে কেমন যেন অন্যরকম অনুভূতির জন্ম দিতো। আমি ধীরে ধীরে তোদের দিকে ঝুঁকে পড়ি, তোদের গায়ে হাত দিতাম, খুব ইচ্ছে করতো তোরাও আমার গায়ে হাত দে, একটা ছেলে যেমন একটা মেয়ের গায়ে হাত দেয় ঠিক তেমনি। কিন্তু তুই বা ক্লাসের অন্যান্য ছেলেরা তা তো করতিই না বরং আমায় দূর দূর করতি, বকাঝকা করতি। তোর মনে আছে! একদিন তোর গায়ে অনেকক্ষণ হাত বুলিয়েছিলেম বলে তুই আমাকে কি বকাই না দিয়েছিলি! পারলে যেন সেদিন মারতি আমায়। অথচ আমি খুব চাচ্ছিলাম কেও তো আমাকে মেয়েদের মত ছুঁয়ে দেখুক! কেও তো আমার গায়ে হাত বুলাক। ধীরে ধীরে এ সমস্যাটা প্রকট হয়ে উঠতে শুরু করে।

তোর মনে আছে? ক্লাস এইট থেকে আমি স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেই, তুই খবর নিতে আমার বাসায় গিয়েছিলি। আমি কিন্তু তখন বাসায়ই ছিলাম, বন্দী। ক্লাস এইটের ওঠার পর থেকেই আমি মহল্লার ছেলেদের সাথেও একই ব্যবহার শুরু করি, ওরাও তোদের মত দূর দূর করতো, তারপর শুরু হলো মার; সে কি মার! আমি মার খেতাম আবার তাঁদের ধরতাম, আবার মার খেতাম। বাসায় বিচার আসা শুরু হলো, মাঝে মধ্যে মার খেয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় বাসায় ফিরতাম; ফিরেই আবার মার খেতাম বাবার কাছে, মার খেতাম বড় ভাইদের কাছে। আমার একমাত্র ভরসার জায়গা ছিলো মা।

ততদিনে আমার বুকের আকারে পরিবর্তন চলে এসেছে, মেয়েদের মত না হলেও কিঞ্চিৎ ভারী ভারী অনুভব হতো, বাসা থেকে বের হতে দিতো না তাই বাসায় মেয়ে সেজে বসে থাকতাম, মেয়ে সেজে আয়নায় নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতাম; কেমন যেন এক অন্যরকম আবেশ! অন্য এক অনুভূতি গ্রাস করতো আমাকে, আমি চলে যেতাম স্বপ্ন জগতে; তোদের সবাইকে নিয়ে ফ্যান্টাসি করতাম মনে মনে। তারপর বাবা-মা একসময় আমাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যায়, ডাক্তার অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষার পর আমাকে বৄহণ্ণলা ঘোষণা করেন। এর তেমন কোন চিকিৎসা তাদের জানা ছিলো না, তখন মাত্র অপারেশন এর সম্ভাবনার কথা আলোচনা হচ্ছিলো, তাও পাশ্চাত্য দেশে, ওগুলো আমাদের স্বপ্নের বাইরে। হরমোনাল কিছু ঔষধ পত্র আর আমার পিঠে বৄহণ্ণলা ছাপ নিয়ে বের হয়ে আসি ডাক্তারের চেম্বার থেকে।   

তারপর থেকে বাসায় আমার অবস্থান হলো কুকুরেরও অধম, বাবা ভাই বোন কেও দেখতে পারে না, আমাকে দেখলেই ছিঃ ছিঃ করে, দূর দূর করে; আমার থালা বাসন, এমনকি খাওয়ার জায়গা, শোয়ার জায়গা সব আলাদা করা হলো, যেন আমি এক অচ্ছুৎ; শুধুমাত্র মা ছিলো আমার ভরসা, তাই দুটো খেতে পারতাম। প্রায় বছর খানেক ঘর বন্দী থেকে একদিন মা'কে বললাম আর কতদিন আমাকে আটকে রাখবে, হয় বিষ খাইয়ে মেরে ফেলো অথবা আমাকে বাইরে যেতে দাও। ঘরের ভেতর বন্দী অবস্থায় তো আর সারাজীবন থাকতে পারব না। মা বুঝলো, তারপর থেকে শুরু হলো আমার বাইরের জীবন।
 
পুরনো বন্ধুবান্ধব কারো সাথে যোগাযোগ করি নি, তাও হঠাত হঠাত রাস্তায় দেখা হয়ে যেত; তারা হয় চিনতে পারতো না কিংবা চিনতে পেরে দূর দূর করতো। একদিন তোর সাথেও তো দেখা হয়েছিলো, তোর মনে আছে? আমি বুঝতে পেরেছিলাম তোদের সমাজ আর আমায় মেনে নেবে না, তাই আমি খুঁজতে লাগলাম আমার মত আর কারা কারা আছে? ধীরে ধীরে একজন দুজন করে পরিচয় হতে লাগলো তাদের সাথে; বিশ্বাস কর তারা কিন্তু একবারও আমার সাথে খারাপ আচরণ করে নি, বরং আমাকে টেনে নিয়েছিলো খুব আদরে। আমি তাদের গ্রুপে যাওয়ার পর জানতে পারি এক একজনের এক এক বয়সে আমার মত শারীরিক ট্রান্সফরমেশন হয়েছিলো, কারো কম বয়সে কারো বেশী বয়সে, কারো কারো বা জন্ম থেকেই। আমি ভিড়ে গেলাম হিজরাদের দলে, তাদের সাথে দল বেঁধে থাকতাম, দল বেঁধে চলতাম। বছর খানেক চলার পর বুঝতে পারলাম এরা পড়ালেখা করে নি, আর বেশিরভাগেই এসেছে খুব নিচু ঘর থেকে। হাজার হোক আমার মধ্যে শিক্ষা ছিলো, তোদের সাথে ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছিলাম ভালো স্কুলে; আমাকে পড়াশুনা টানতে লাগলো; আমি আবার পড়ালেখায় মনোযোগ দিলাম। তোদের এক বছর পর আমিও চিটাগাং এর এক কলেজ থেকে মেট্রিক দিলাম; এখনো পড়ালেখা করছি।

খুব কষ্ট লাগলো শুনে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, বাসায় যাস না? সে বললো না রে; খুব কম। মাঝে মধ্যে মাকে যখন খুব দেখতে ইচ্ছে করে তখন পাশের বাসায় ফোন করে মা'কে ডাকি; কিছুক্ষণ কথা বলি। আর মাঝে মাঝে যখন অস্থির হয়ে যাই তখন মা'কে বাইরে কোথাও আসতে বলি, মায়ের সাথে কিছু সময় কাটাই; তারপর কাঁদতে কাঁদতে মা চলে যায়, আমিও কাঁদতে কাঁদতে আমার ঠিকানায়। তার কথায় আমারও চোখ ভিজে উঠলো, সন্ধ্যার গোধূলিতে মন খারাপ করে দুই বন্ধু বসে রইলাম পাশাপাশি; আমি তার হাতে হাত রাখতেই সে চমকে তাকালো। বললো আমাকে ছুঁয়ে দিলি? তোর ঘিন্না করলো না? আমি বললাম না রে, বন্ধুর হাতে বন্ধু যদি হাতই না রাখতে পারলো তাইলে আর বন্ধুত্ব কিসের? সে কান্না জড়িত কণ্ঠে বললো, জানিস! আমার ভাই বোনরাও কিন্তু আমায় ছুঁয়ে দেখে না, কতদিন ভাইবোনদের একটু জড়িয়ে ধরি না!

সেই শেষবার, তারপর আমার আর হালিমের সাথে কোন যোগাযোগ হয় নি; ও যেন একদম ভ্যানিস হয়ে গিয়েছে। আমরা বন্ধুবান্ধবরা একসাথে মিলিত হলে মাঝে মধ্যেই হালিমের কথা উঠে আসতো। এক একজন এক এক কথা বলতো, যার সাথে দূর দূর দিয়ে হালিমের জীবনের সাথে কোন মিল নেই। কেও কেও তার ট্রান্সজেন্ডার হওয়ার বিদ্রূপ করতো, আমার কেন জানি খুব খারাপ লাগতো। হাজার হোক আমার বাল্য সাথী, ওর জন্য কেমন একটা মায়ায় জড়ানো একটা অনুভূতি আমার রয়েই গিয়েছিলো।

এখনো হিজড়াদের কোন দল দেখলে ওদের মাঝে হালিম'কে খুঁজি, আশায় থাকি, কখনো ওকে দেখতে পাবো; আশায় থাকি পেছন থেকে হয়তো কোন একদিন মেয়েলি একটা কণ্ঠ ডেকে উঠবে - এ্যই আহসান! এ্যই!

 

২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০

#গল্প
এক বৃহণ্ণলার গল্প  
 - যাযাবর জীবন


ছবিঃ নেট থেকে সংগৃহীত, এডিট করা।

 


আধুনিক শিল্পকলা

আজকাল নগ্নতার বড্ড অদ্ভুত বিশেষায়ণ
বিভিন্ন নামকরণে নগ্নতার বৈধতা জ্ঞাপন  
কাপড়ের স্বল্পতায় শরীর দেখানোর নাম ফ্যাশন
যৌনতার আবেদনে ক্যাটওয়াক, শরীরের প্রদর্শন
চৌকোনা বাক্সে অঙ্গভঙ্গির নাম সিনেমা, টেলিভিশন
পোষ্টারে, বিলবোর্ডে বিজ্ঞাপনের নামে নারীর প্রদর্শন
আজকাল খুব সহজ হয়ে গেছে যৌনতা
শরীর ঢেকে রাখা? ও মান্ধাতার আমলের চিন্তা;

ক্যানভাসে নদী নালা খাল বিল, প্রকৃতি আঁকছ?
কটা বিক্রি করতে পারো,? তুমি সাধারণ ক্যানভাস বিক্রেতা,   
ওখানে নারী পুরুষ ছড়িয়ে দাও, নগ্নতা নিয়ে আসো!  
তুমি পেইন্টার, ওগুলো মাস্টার পিস, আর হুমড়ি খাওয়া ক্রেতা;

পাথরে জীবন খোদাই!  
সাধারণ ভাস্কর্য তো করে সবাই
পাথর খুঁড়ে যৌন আবেদন ফুটাতে পারো?
তুমি শিল্পের কারিগর, সত্যিকারের ভাস্কর্য;   

কাগজে কলমে জীবনের গল্পগুলো আজকাল পড়ে কজনা?
কবিতা? অল্পকিছু; প্রবন্ধ? হাতেগোনা
গল্পে একটু যৌনতা ছিটিয়ে দাও! তুমি তো কলমের যাদুকর
কবিতায় কাম আঁকতে পার? শরীর? তুমিই কবি, শব্দের যাদুকর;

কবিতায় ঠোঁটে ঠোঁটে কথা, গল্পে বিছানা
পেইন্টিং এ শরীরে শরীর এঁটে থাকা
ভাস্কর্যে যৌনতা ফুটিয়ে তোলা
ফ্যাশনের নামে শরীর প্রদর্শন
এগুলোই আধুনিক শিল্পকলা, শিল্পের বিশেষায়ণ;
কি বললে? অশ্লীলতা!
ওহে! ধ্যান ধারণা বদলাও, তোমার যত্তসব মান্ধাতার আমলের চিন্তা;

আচ্ছা! এই যে নগ্নতা! এই যে শরীর প্রদর্শন!
এই যে যৌনতার নামে শরীর চাটার বন্যা!
তোমার পরিবারে একবার নগ্নতা চিন্তা কর তো!
তোমার মা, তোমার বোন, তোমার স্ত্রী, তোমার কন্যা!

ধ্যাত! ওগুলো তো শিল্পীরা করে, আর্টিস্টরা করে, শিল্পের প্রয়োজনে
কিন্তু ওরাও তো কারো মা, কারো বোন, কারো স্ত্রী কারো কন্যা!
আরে আমার পরিবার ধোঁয়া তুলসীপাতা, ওরা কেন এখানে আসবে?
তুমি যাও তো এখান থেকে! শুধুশুধু যন্ত্রণা করো না;

ওহে শিল্প-রসিক, ওহে শিল্পবোদ্ধা! এই যে আধুনিক শিল্পকলা চাটছো না!
একবার ঐ অর্ধনগ্ন শিল্পীর জায়গায় নিজের পরিবারকে কল্পনা করে দেখই না!
তারপর না হয় বলতে এসো, আমার যত্তসব মান্ধাতার আমলের চিন্তা
পারবে কি? আমি পারি না, জানি তুমিও পারবে না।   

৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২০

#কবিতা
আধুনিক শিল্পকলা
 - যাযাবর জীবন

ছবিঃ নেট থেকে সংগৃহীত। 




নানা সম্পর্কের দিবস

আজ ফেসবুক প্লাবিত বাবা মেয়ের ছবিতে
আজ ফেসবুক প্লাবিত মা মেয়ের ছবিতে
আজ কন্যা দিবস,
কাল ফেসবুক থেকে মেয়ে হারিয়ে যাবে
চলে আসবে অন্যকিছু,
জীবন থেকে কি হারিয়ে যাবে?

মা দিবসে ফেসবুক প্লাবিত থাকে মায়ের ছবিতে
বাবা দিবসে বাবার ছবিতে
অথচ বাবা মা অনেকদিন গত হয়ে গেছেন, এখন রয়ে গেছেন স্মৃতিতে
দিবসগুলোর ঠিক পরদিনই মা বাবা ফেসবুক থেকে হারিয়ে যান   
চলে আসে অন্যকিছু,
স্মৃতি থেকে কি হারান?

বন্ধু দিবসে বন্ধু
ভাই দিবসে ভাই
বোন দিবসে বোন
দিবসগুলোতে একদিনই তাদের স্মরণ
আর ফেসবুকে ছবির প্লাবন
বছরের একটা দিনেই যার যার দিবসে তারা  
ঠিক পরদিনই অন্যকিছু,
মনের মাঝে বড্ড ভাবনা আসে, এই যে ফেসবুকের একদিনের স্মৃতিচারণ!  
বাকি তিনশত চৌষট্টি দিন কোথায় থাকে তারা?

আমার কাছে প্রতিদিনই দিবস,  
বাবা দাদা দাদী নান নানী যারা বেঁচে নেই তারা স্মৃতিতে, দোয়ায়
আর মা স্ত্রী কন্যা পুত্র ভাই বোন বন্ধু বান্ধব যারা বেঁচে আছেন
বছরের তিনশত পঁয়ষট্টি দিনই তারা বাস্তবতায়,
বিশেষ দিবস আমাকে টানে না;  
এই যে বন্ধুরা, এই যে পাঠকরা আমার কথায় আবার কিছু মনে করো না
তোমরা যার যার মত দিবস পালন কর
ফেসবুক ভরে ছবি দাও, আনন্দ কর;
অনুভব অনুভূতি যার যার, এক এক রকম প্রকাশ এক একজনার  
আমি কাগজে কলমে শুধু আমার অনুভবের কথাই বলি  
আর তোমাদের নানারকম দিবসের ছবি দেখে পুলক বোধ করি;

কেও বাঁচে ফেসবুকে  
কেও বাস্তবতায়,
সম্পর্কগুলো অনুভবের, অনুভূতির
সম্পর্কগুলো সবার সাথে সবার।


২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২০

#কবিতা
নানা সম্পর্কের দিবস
 - যাযাবর জীবন

বুনন

তুই সুঁইয়ে সুতা গাঁথিস আপন মনে
আমি কাগজে কলম আঁকি ভাবুক মনে

তুই কাপড়ে সুতা বুনে বুনে নকশা তুলিস
আমি কাগজে শব্দ বুনে বুনে বাক্য গড়ি

তোর সুঁই এর ফোঁড়ে রঙিন সুতোয় নকশিকাঁথা
আমার এলেবেলে কথার ফোঁড়ে কাব্য-গাথা

কত রঙের সুতোই না তোর নকশিকাঁথায়?  
আমি শুধুমাত্র জীবন আঁকি নিরস কবিতায়  

নগদ টাকায় লোকে তোর নকশা কিনে  
কয়জনই বা কবিতা পড়ে আজকে দিনে?

লোকে তোকে শিল্পী ডাকে, তুই খুশি হোস
লোকে আমায় পাগল ডাকে, ওরা খুশি হয়

তোর বোনা সুঁই আর সুতো নকশার কথা বলে  
আমার বোনা শব্দগুলো জীবনের গল্প বলে।


২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০

#কবিতা
বুনন
 - যাযাবর জীবন


ছবিঃ নেট থেকে সংগৃহীত। 

 

 



ভার্চুয়ালের RIP

এই যে ভার্চুয়ালের শৃঙ্খলে বন্দী জীবন!
খুব স্বস্তিকর কি?
এই যে সময়ে অসময়ে আমাদের খুব ব্যক্তিগত মুহূর্তগুলো পোস্ট করি!
এর ওর তার তার জন্মদিন!
এর তার ওর নানাবিধ বার্ষিকী!
এতে ফেসবুকের হাজার বন্ধুর খুব যায় আসে কি?  
তাও নিজের জন্মদিনে, বিবাহ বার্ষিকীতে যদি অন্য বন্ধুরা শুভেচ্ছা জানায়
সেটা এক কথা
যেখানে ফেসবুক নিজেই নোটিফিকেশন পাঠাস সকল বন্ধুদের
সেখানে আগ বাড়িয়ে আজ আমার জন্মদিন, আজ আমার বিবাহ বার্ষিকী
আমাকে উইশ করো, খুব সস্তা হয়ে গেলো না কি?
কি জানি বাপু! আমি কম বুঝি;

আমি কোথায় যাই, কি করি!
ক্ষণে ক্ষণে ছবি তুলি
ক্ষণে ক্ষণে পোস্ট করি
খুব ব্যক্তিগত নয় এগুলো!
খুব কি দরকার মানুষকে বলে বেড়ানো?
আহা উঁহু ইশশ বেশ কুড়ানো!  

আমার অনুভব, আমার অনুভূতি একান্তই আমারই  
তবুও খুশি ভাগ করা নেয়া মেনে নেয়া যায়,
কিন্তু বাবা মা, ভাই বোন কিংবা সন্তানের মৃত্যুদিনগুলো?
ওগুলো তো শুধুমাত্র আমারই স্মৃতি, বেদনার সাদাকালো,  
মানুষ জেনে করবেটা কি?
একটু উঁহু, আহা!
তাতে হবে'টা কি!
যিনি মারা গিয়েছেন ওনার কি কোনো লাভ হবে?
তারচেয়ে নীরবে নিভৃতে জায়নামাজে ভাই বোন সন্তানের জন্য একটু দোয়া
বাবা মায়ের জন্য, রব্বীর হাম-হুমা কামা রাব্বায়ানি সাগিরা
যথেষ্ট নয় কি?

সবচেয়ে উত্তম দোয়া বাবা মায়ের জন্য রব্বীর হাম-হুমা
আর মন থেকে বের হওয়া সন্তানের চোখের পানি
কজন করি? কজন জানি?
অথচ কথায় কথায় ফেসবুক ওয়ালে সেটে দেই মৃত বাবা মায়ের ছবি!  
ওনাদের কোন উপকারে আসে?

এই যে স্ট্যাটাস দেই!
একটু আগে আমার বাবা মারা গেলেন
একটু আগে আমার মা মারা গেলেন
বাবা মা হারিয়ে মনের দুঃখে ভাসতে ভাসতে, ফেসবুকে ঢুকি কি করে!
আরে বাবা ফেসবুকে সময় না দিয়ে দাফন কাফনের কাজটুকুতো আজ করি!
একটা দিন ভার্চুয়াল থেকে না হয় দূরেই থাকি!
একটু দোয়া দরূদ পড়ি!
আর আজকাল মানুষেরও হয়েছে বলিহারি
এই যে মৃত্যু সংবাদ!
ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন কজনা পড়ি?
ধ্যাৎ! তুমি পুরানো কালের মানুষ হয়ে গেছো
আজকাল ফ্যাশন হয়ে গেছে RIP,
অথচ কবর যখন দিচ্ছ মুসলমান'ই তো! তাই না?
তবে মৃতের গায়ে RIP'র স্থান কোথায়?
এটা কোন সংস্কৃতি?
একটু ভাবি!
একবারের জন্য হলেও না হয় একটু ভাবি।

২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০

#কবিতা
ভার্চুয়ালের RIP
 - যাযাবর জীবন



গভীর রাতের বৃষ্টি বিলাস

আকাশটা মেঘ গুড়গুড়
টিপটিপান্তি বৃষ্টির সুর
একটু পরেই ঝুমঝুম ঝুম
নামলো আকাশ একদম ধুম

তাকিয়ে আছি চোখ ঘুম ঘুম
টিনের চালে বৃষ্টি ঝুম
মনের চাল বড্ড উদাস
গভীর রাতের বৃষ্টি বিলাস   

টিনের চালে টাপুর টুপুর
বৃষ্টি নাচছে জল নূপুর
ঘুমঘুম চোখ রাত দুপুর
মনের মাঝে শ্যাওলা পুকুর

শ্যাওলা পুকুর সবুজ সবুজ
তোকে ভাবতেই মন অবুঝ
ঘুম ঘুম চোখ জেগে উঠে কয়
বৃষ্টি রাতে ঘুম আমার নয়

বৃষ্টি হলেই জল টুপটুপ
মন নদীতে একরাশ ডুব
মেঘগুলো সব কথা বলে
মনের ঘরে ঝড় চলে

বাইরেতে বজ্রপাত ভীষণ
ভেতরেতে স্মৃতির ক্ষরণ
যা বৃষ্টি যা রে চলে
ঘুমকে চোখে আসতে বলে  
 
মন ঘরেতে যদিও তালা
স্মৃতিগুলোর বড্ড জ্বালা
বৃষ্টি রাতে মন তুই তুই
লবণ চোখ, কোথায় রে তুই?


২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২০

#কবিতা
গভীর রাতের বৃষ্টি বিলাস  
 - যাযাবর জীবন


ছবিঃ নেট থেকে সংগৃহীত।




সোমবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২০

বদলাচ্ছে সম্পর্কের ধরণ

একটা সময় ছিলো
ভালোবাসার
একটা সময় ছিলো
ধৈর্য পরীক্ষার
প্রেম তখনো ছিলো
প্রেম এখনো আছে
আছে অনুভব অনুভূতি  
শুধু সময়টা বদলে গেছে;

একটা সময় ভালোবাসার আদান প্রদান চিঠিতে
মাসে দু মাসে একটা চিঠি
আর মধুর প্রতীক্ষা
দেখা সাক্ষাৎ? হয়তো বছরে এক আধবার
অনেক লুকোছাপায় খুব গোপনে
হাত ধরাধরি! কেও দেখে ফেলবে না তো!
চুমু? ছিঃ  
শরীর? প্রশ্নই ওঠে না
তখনো প্রেম ছিলো
ছিলো ভালোবাসার পুরোপুরি বিশ্বাস;

তারপর সময় এলো টেলিফোনের
সেও সপ্তাহে একদিন বা দুদিন
আর বাকি দিনগুলো দিনগোনার
দেখা সাক্ষাৎ? মাসে দু মাসে একবার
কিছুটা গোপনে, কেও দেখে ফেলার লজ্জায়
হাত ধরাধরি! রিক্সার হুড ফেলে
চুমু? কালে ভদ্রে
শরীর? খুব হাতে গোনা
তখনো প্রেম ছিলো
ছিলো ভালোবাসার অনেকটাই বিশ্বাস;

আজকাল সময়টা অস্থির, মোবাইল হাতে হাতে
রিং বাজতেই না ধরলে তুলকালাম কাণ্ড
মেসেজের উত্তর না পেলে মোবাইলে আছাড়
দেখা সাক্ষাৎ? ভিডিও কলে তো প্রতিদিনই হচ্ছে
সামনা সামনি? যখন ইচ্ছে তখনই
গোপনীয়তা? সে আবার কি?
হাত ধরাধরি! সে আবার কি?
চুমু? পরিচয়ের প্রথম দিনেই
বিছানা? মন চাইলেই
শরীর? হরে দরে
এটাকেই এখন প্রেম বলে
ভালোবাসার বিশ্বাস? দেখা যাবে সংসার হলে;

তখন প্রেম ছিলো, বিশ্বাসের সাথে
প্রেম এখনো আছে, ধরণটা বদলে গেছে
সময় বদলাচ্ছে খুব দ্রুত, বদলাচ্ছে সম্পর্কের ধরণ
অস্থির এখনকার মানুষগুলো, অস্থির মানুষের মন;
 
কে জানে সামনের দিনগুলোতে কি হয়!
চিন্তা করতেও কেমন জানি লাগে বড্ড ভয়।

২১ সেপ্টেম্বর, ২০২০

#কবিতা
বদলাচ্ছে সম্পর্কের ধরণ
 - যাযাবর জীবন 
 

 

 

স্বামী-স্ত্রী

স্বামী-স্ত্রী;
একটা হাইফেন দিয়ে একত্রিত করন
সে না হয় কলমে লেখার জন্য
সম্পর্কটা এই ভুবনে জুরে দেয়া হয়েছে কিছু বিধানের মাধ্যমে
দুটি নর-নারীর মাঝে, ধর্মীয় বিধান;
আসলে কি সম্পর্কটা এই ভুবনে পরস্পরকে জুরে দেয়া?
আরে এ তো মহান আল্লাহ্‌ তায়ালার বানিয়ে দেয়া জোড়া,  
আমরা বেশিরভাগই এই সম্পর্কের সম্মান করি, মিলেমিশে থেকে
অল্প কেও কেও করি অসম্মান, বিচ্ছেদে;

এই যে নর ও নারী পরস্পর নিশ্চিন্তে ছুঁয়ে থাকে!
ঘুমের মাঝেও একজন আরেকজনকে জড়িয়ে রাখে
একজনের হাত পা শরীর আরেকজনের ওপর নির্ভাবনায় নিশ্চিন্তে,
স্বামী-স্ত্রী না হলে সম্ভব?
অথচ অন্য যে কোন সম্পর্কের নর ও নারী, কেও কি কাওকে ধরতে পারি?
কতই না চিন্তা ভাবনা করতে হয়! এই বুঝি হয়ে যায় ছোঁয়াছুঁয়ি!
সাবধানতার চূড়ান্ত দুজনার মাঝেই সম্পর্কের হিসাবে
অথচ স্বামী-স্ত্রী! নিশ্চিন্তে জড়াজড়ি ঘুমায় বেহিসাবে;

এই সম্পর্কটা পবিত্র
পরস্পর বিশ্বাসের, নির্ভয়তার  
আমরা বেশীরভাগই ধরে রাখি
আর অল্প কেও কেও কলুষিত করি;
কলুষিত করি আমাদের কালো মন নিয়ে
স্বার্থ নিয়ে, তুচ্ছাতিতুচ্ছ ইগোর বশবর্তী হয়ে
কলুষিত করি আমাদের রিপু দিয়ে
পর নর কিংবা নারীতে আসক্ত হয়ে,  
কি আছে ওখানে?
শরীর?
সে তো ক্ষণিকের
তাও সবাইকে লুকিয়ে
নয়তো অবৈধ স্খলনের পর কেন চোরের মত পালিয়ে আসি মুখ লুকিয়ে?
আয়নায় মুখ দেখাতে পারি? বিবেকের সামনে;   

সম্পর্কটা কিন্তু রক্তের না, তবুও কি যেন একটা আছে
একটা অন্যরকম টান, আত্মার সাথে
রক্ত সম্পর্কগুলো বিভিন্ন কারণে ছেড়ে যায় সময়ের সাথে সাথে
অথচ এই একটা সম্পর্ক মৃত্যু পর্যন্ত পরস্পর আঁকড়ে থাকে,
যারা ভালোবাসে;  
মৃত্যু! সে তো মহান আল্লাহ্‌ তায়ালারই বিধান।  
      

২১ সেপ্টেম্বর, ২০২০

#কবিতা
স্বামী-স্ত্রী
 - যাযাবর জীবন


 
ছবিঃ নেট থেকে সংগৃহীত।




মনের টান

এই যে কারণে আর অকারণে তোর দিকে তাকিয়ে থাকা!
এই যে সময় অসময়ে তোকে দেখা!
এই যে ছুতো নাতায় তোকে ছুঁয়ে দেয়া!
এই যে সারাক্ষণ তোর সাথে ঘেঁষে থাকার বাহানা!
সকালে ঘুম থেকে উঠে, বিকেলে চায়ের কাপে
সন্ধ্যায় সামনাসামনি বসে, সুযোগে চুমু ডুবিয়ে
রাতে হাতের নাগালে জড়িয়ে রাখা
আদরে বুকে মাথা
টুকটাক কথা, টুকটাক খুনসুটি  
এই যে অনুভব!
এই যে অনুভূতি!
একে কি প্রেম বলে?
আমি বলি টান,
মনের টান;

কেও কেও বলে শরীর, কেও কেও কাম,
আরে প্রেমে তো কাম থাকবেই
বিয়ের আগে অবৈধ
বিয়েতে বৈধ,
প্রথম যৌবনে না হয় প্রতিদিন
দু চার বছর ঘুরলে সপ্তাহে তিন চারদিন
তারপর সময় গড়ালে আরেকটু কম
যুগ গড়ালে সাপ্তাহিক
কুড়ি গড়ালে পাক্ষিক
জয়ন্তীতে মাসিক
তারপর কালে ভদ্রে;

এই যে শরীর!
জীর্ণ হয়, শীর্ণ হয়
মন কিন্তু টান হয়ে রয়
তাই তো কালের স্রোতে বুড়োবুড়ি
দুজন দুজনকে ছাড়া অচল, রাতে ঠিক জড়াজড়ি;

আরে বোকা!
জড়াজড়ি কাম নয়
ওটা প্রেম
ওটা মন
ওটা মনের টান;

যাদের আছে তারাই বোঝে
বাকিরা শরীর খোঁজে।


২০ সেপ্টেম্বর, ২০২০

#কবিতা
মনের টান
 - যাযাবর জীবন

ছবিঃ নেট থেকে সংগৃহীত। 




একদিন খুব হঠাৎ

একদিন খুব হঠাৎ নিথর হবে হাত
হয়তো দিনের বেলায় চোখে অন্ধকার রাত  
একদিন খুব হঠাৎ কথা বলবে না ঠোঁট
অসাড় জিহ্বায় আর চাটবে না ঠোঁট 


একদিন খুব হঠাৎ বধির হবে কান
চারিদিক সুনসান থেমে যাবে সব গান  
একদিন খুব হঠাৎ চোখে নিভে যাবে আলো
চির চেনা পৃথিবীটা আমার চোখে কালো 


একদিন খুব হঠাৎ থেমে যাবে হৃদয়
কে জানে কখন কার কি হয়!
একদিন খুব হঠাৎ ঘাড় উত্তর দিকে
কি জানি বলছে সবাই কান্না দিকে দিকে 


একদিন খুব হঠাৎ সাদা কাপড় মোড়া
আমার নিথর দেহ আর চারিপাশে তোরা
অনেক ব্যস্ততায় সেদিন মাটি হবে খোড়া
কবরে রাখবি আমায় সাদা কাফনে মোড়া;

তারপর থেকে আমি হয়ে যাব গত
থেমে যাবে জীবনের ব্যস্ততা যত
মৃত্যুটা শাশ্বত, কেই বা আর রবে?
আজ কাল বা পরশু, সবাইকে যেতেই হবে।

১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২০

#কবিতা
একদিন খুব হঠাৎ
 - যাযাবর জীবন


ছবিঃ নেট থেকে সংগৃহীত।




বৃষ্টির গান

ভাবিস না ঘুমিয়ে পড়েছি, জেগে আছে নির্ঘুম চোখ
হাত দিয়ে অনুভব করে দেখ জলীয় বাতাস
তোর তো আবার অনুভূতি কম, আবেগ ষোলোআনা
ভালোবাসার ভাষা কিচ্ছুটি নেই তোর জানা;

এই যে সবুজ দেখিস! বাতাসে ঘাসের গন্ধ
এই যে নদী দেখিস! কুলকুল শব্দ
এই যে নীল দেখিস! আকাশের দিকে চেয়ে
এই যে হলুদ মাখিস! শর্ষে ক্ষেতে গিয়ে
কখনো কালো দেখেছিস? নির্ঘুম চোখ চেয়ে?
লাল দেখেছিস কখনো? বুকের ভেতর চেয়ে?

অনুভব সবার এক নয়
এক নয় অনুভূতি
আমি না হয় ভালোইবেসেছিলাম
কি এমন তাতে হয়েছিলো ক্ষতি!
তুই শরীর ছুঁয়ে ছুঁয়ে ভালোবাসতে চেয়েছিলি
আমি মন ছুঁয়ে ছুঁয়ে তোকে ছুঁয়ে রেখেছিলাম
ছোঁয়াছুঁয়িটা শরীর বৃত্তীয় হলে ভালোবাসা থাকে না
বৃষ্টির সাথে সাথে মন গান বাঁধে না;

এই যে বৃষ্টি হচ্ছে! কখনো বৃষ্টির গান শুনেছিস?
কখনো টিপটিপান্তি
কখনো ঝুমঝুমান্তি
কখনো থেমে থেমে কখনো অঝোর ধারায়
তোর মনে কি গান তৈরি হচ্ছে এখন? বৃষ্টির ধারায়!
বৃষ্টি নামলেই গান বাজে আমার সত্ত্বায় সত্ত্বায়;

কাঁথার নীচে গুটিসুটি শুয়ে বৃষ্টি বিলাস তোর ভালোবাসার আলসেমি
আকাশ কালো হলেই আমি কাকভেজা হব বলে রাস্তায় নামি
দূর দূর দিয়ে কোথাও মিল নেই আমাদের অনুভবে
তবুও পরস্পর ভালোবাসে যাই দুজনই নীরবে;

আজ মেঘ কাঁদছে, বৃষ্টি গাইছে
একটু ভিজবি? চল;
একবার না হয় কান্নায় ভিজতে ভিজতে
ভালোবাসি বল।


১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২০

#কবিতা   
বৃষ্টির গান
 - যাযাবর জীবন


ছবিঃ নেট থেকে সংগৃহীত।




অন্যরকম ভ্রমণ

আমরা কত কত টাকাই না খরচ করি!
কত কত জায়গায় যে বেড়াতে যাই!
কত কত দামী দামী গাড়িতে চড়ি!
কত কত রকমের উড়োজাহাজেই না উড়ি!
আজকাল তো শুনি চাঁদে যাওয়ারও প্যাকেজ হচ্ছে
তবে এইসব দামী দামী যন্ত্রযানগুলিতে কি একশতভাগ নিরাপত্তা আছে?

মানুষের ভ্রমণ কাহিনী শুরু হয়েছিলো কবে?
কেও হয়তো বলবে লক্ষ কোটি বছর ধরে
কেও হয়তো বলবে এই তো মাত্র অল্প কিছু শতাব্দী ধরে;
একটু মনে করে দেখ তো! তোমার ভ্রমণ শুরু হয়েছিলো কবে?
তুমি বলবে তোমার জন্মের পরে
মহান আল্লাহ্‌ তায়ালা বলেন, না রে বান্দা, বহু বহু বহুকাল আগে
তোর রূহের জন্ম হয়েছিলো আলামুল আরওয়াহ তে,  
সেখান থেকে বহু বহু বহুকাল পরে শতভাগ নিরাপদ এক যানে চড়ে
পৃথিবী ভ্রমণে এসেছিলে, মনে পড়ে?
তোমার যন্ত্রযানটার কথা মনে আছে?
মনে নেই?
আরে তোমার মায়ের উদর!    
মাতৃগর্ভ - একশতভাগ নিরাপদ এক বাহন,
তাই না?
ভাবো, মানুষ ভাবো!

এই যে তোমার পৃথিবী ভ্রমণ! কদিনের জন্য? জানো কি?
এই যে লক্ষ কোটি টাকা খরচ করে এখানে ওখানে যাও!
এই যে চন্দ্র পাড়ি দিচ্ছ! এই যে ছুটছো গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে!
সাত আসমান পাড়ি দিতে পারবে?
কিভাবে পারবে বলো? তুমি তো মিল্কিওয়েতেই যেতে পার নি আজো;
তবে আমি বলছি, পারবে
তুমিও পারবে, আমিও পারব
ওখানে যেতে লক্ষ কোটি টাকা খরচ করতে হয় না
ওখানে কোন যন্ত্রযান যায় না
একদিন হুট করে ওপর থেকে ডাক আসবে
ইচ্ছে না থাকলেও ভ্রমণে যেতেই হবে;
কেও কেও সাত আসমান পাড়ি দিয়ে একদম ইল্লিইনে
কেও কেও সাত জমিন নীচে সিজ্জিনে
একদম নিখরচায়;
তুমি কোথায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছ?
আমি ভীত সন্ত্রস্ত
তুমি?
ভাবো, মানুষ ভাবো!   

তারপর একটা লম্বা ঘুম - আলমে বারজাক
যদি ইল্লিইনে যেতে পারো তবে শান্তির ঘুম
আর যদি কর্মফলে তুমি সিজ্জিনে চলে যাও
তবে অসহনীয় অসীম লম্বা এক অশান্তির জীবন;    
আমি ভীত সন্ত্রস্ত
তুমি?
ভাবো, মানুষ ভাবো!   

তারপর কোন এক অসীম অপেক্ষার পর
ভয়াবহ বিচার দিবস,
পৃথিবী থেকে আমলনামায় কি নিয়ে এসেছ?
এই যে মৌজ মাস্তিতে জীবনটা কাটিয়ে এসেছ!
মহান আল্লাহ্‌ পাকের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে পারবে তো!
ভালো কর্মফলে পুরস্কার - জান্নাত
মন্দ কর্মের তিরস্কার - জাহান্নাম;  
আমি ভীত সন্ত্রস্ত
তুমি?
ভাবো, মানুষ ভাবো!    
 
১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২০  

#কবিতা
অন্যরকম ভ্রমণ
 - যাযাবর জীবন


ছবিঃ নেট থেকে সংগৃহীত। 

https://pin.it/5wwS1KG

সম্পর্কের নানারূপ

সম্পর্কগুলো বড্ড আজব
কিছুটা মায়া মমতার
কিছুটা অনুভব অনুভূতির
আর বাকিটা স্বার্থের;

এই যে বাবা-মা আর সন্তানের সম্পর্ক!
খুব পবিত্র
তাই না?
তিলে তিলে মানুষ করে তোলা সন্তান
নিজে খেয়ে না খেয়ে সন্তানকে খাইয়ে
সন্তানের পড়ালেখা, তার সবচেয়ে ভালো কাপড়
সাধ্যের বাইরে গিয়ে,
বাবা-মায়ের কিন্তু স্বার্থ আছে
সন্তান মানুষ হবে, বুড়ো কালে লাঠি হবে
ওদের ওপর ভরসা করা যাবে,
যায় কি?
আমি সাধারণের কথা বলছি
আমি ঘর ঘরের কথা বলছি,
ব্যতিক্রম তো কিছু থাকবেই!

অথচ সন্তান!
হয় লেখাপড়ার নামে বিদেশ যাত্রা
বিদেশ যাত্রা তো অগস্ত্য যাত্রা
তারপর বিদেশী মন-মানসিকতা, তারও পর বিদেশী মেম
তারপর দু চার বছরে দেশে একবার
যদি মর্জি হয়,
আর বাবা মা টেঁসে গেলো তো ঝাড়া হাত পা
তখনো কিন্তু শেষ একবার আসে
বাবা-মায়ের সম্পত্তি কি আছে তার বিক্রি করতে
তারপর টা টা বাই বাই চিরতরে
দেশের জন্য টান কোথায়, অর্ধ বিলাতির!
আর দেশে থাকা সন্তান!
ও তো বৌ এর গোলাম,  
যতদিন বাবা-মা'কে দোয়াতে পারে ততদিন গোয়ালঘর
তারপর তো ভাগাড় আছেই, বৃদ্ধাশ্রম নামক বুড়োবুড়ির ভাগাড়
কে আর নিতে যায় দায়িত্ব! বুড়োবুড়ি আজকাল বড্ড যন্ত্রণার;  
আমি সাধারণের কথা বলছি
আমি ঘর ঘরের কথা বলছি,
ব্যতিক্রম তো কিছু থাকবেই!

ভাই-বোন?
আরে সে তো ছোটবেলা থেকেই স্বার্থের লড়াইয়ে অভ্যস্ত
বাবা-মায়ের ভালোবাসায় কার ভাগ বেশি আর কার কম
এই নিয়ে ছোটবেলা থেকেই স্বার্থের দ্বন্দ্ব
তারপর পড়ালেখার, কে কোন নামী দামী স্কুল কলেজে
তারপর স্ট্যাটাসের, কার চাকরি কিংবা ব্যবসায় বেশী উন্নতি
তারপর মারামারি, বাবার সম্পত্তির
সম্পর্কের বলিহারি;
আমি সাধারণের কথা বলছি
আমি ঘর ঘরের কথা বলছি,
ব্যতিক্রম তো কিছু থাকবেই!

স্বামী-স্ত্রী?
এই যে যুগ যুগ পরস্পর জড়িয়ে থাকা!
সেখানেও স্বার্থ, এটা অবশ্য দ্বিপাক্ষিক
কিছুটা অর্থের প্রয়োজনে, কিছুটা শরীরের প্রয়োজনে
কিছুটা অভ্যাসে, কিছুটা পরস্পর নির্ভরশীলতায়  
আর নয়তো নিছক সন্তানের দিকে মুখ চেয়ে,
যে সম্পর্কগুলোতে ভালোবাসা বেঁচে থাকে সেগুলো টিকে থাকে
যে সম্পর্কগুলোতে বিশ্বাস থাকে সেগুলো টিকে থাকে
আর নয়তো সম্পর্ক কাটে পরকীয়া ভাইরাসে;
আমি সাধারণের কথা বলছি
আমি ঘর ঘরের কথা বলছি,
ব্যতিক্রম তো কিছু থাকবেই!

বন্ধু-বান্ধব?
আত্মীয়-স্বজন?
এরা তো অনেক দূরে  
একবার সমস্যায় পড়েই দেখ না!
কে কার তরে?
টাকা চাওয়ার বেলায় এরা হরিহর আত্মা
দেওয়ার বেলায় তুই কে রে?
তারপর সম্পর্কের বলাৎকার
কি চমৎকার! কি চমৎকার!
আমি সাধারণের কথা বলছি
আমি ঘর ঘরের কথা বলছি,
ব্যতিক্রম তো কিছু থাকবেই!

সম্পর্কগুলো খুব অদ্ভুত, তাই না?
স্বার্থ দিয়ে মোড়া
অনুভূতি গিয়ে ঘেরা,
তবুও আমরা সামাজিক জীব
কারণে আর অকারণে সম্পর্কে জড়াই হরহামেশা
তাই না?
আমি তোমার কথা বলছি  
আমি আমার কথা বলছি
আমি সম্পর্কের কথা বলছি
আমি সম্পর্কের স্বরূপ বলছি
আমি সম্পর্কের নানারূপ বলছি;   
আমি সাধারণের কথা বলছি
আমি ঘর ঘরের কথা বলছি,
ব্যতিক্রম তো কিছু থাকবেই!

১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০

#কবিতা
সম্পর্কের নানারূপ
 - যাযাবর জীবন


ছবিঃ নেট থেকে সংগৃহীত।




মানুষ লিখার চেষ্টা

অনেকে গল্প লিখে   
অনেকে লিখে কবিতা
আমি মানুষ দেখি
লিখার চেষ্টা করি মানুষের কিছু কথা;

মানুষের সব কথা কি আরা লিখা যায়?
জটিল কুটিল একের পর এক ঘোরপ্যাঁচে আবর্তিত হই  
ঘোরপ্যাঁচ মানুষের অনুভবে
ঘোরপ্যাঁচ অনুভূতিতে
চিন্তায়, চেতনায়, চলায়, ফেরায়
সম্পর্কের মাঝে তো কুটিল কুটিল সব প্যাঁচ
মানুষ লিখতে গিয়ে আমি প্যাঁচের মাঝে আটকে যাই
দমবন্ধ হয়ে হাঁসফাঁস করতে থাকি
তারপর একসময় বিরক্ত হয়ে লিখা ছেড়ে উঠে যাই;

মানুষ লিখার চেয়ে কঠিন বোধহয় আর কিছু নাই
এরা ভাবে এক করে আরেক
মুখে এক মনে এক
চলে উত্তরে দেখে দক্ষিণে
আর জটিল কুটিল সব সম্পর্ক গড়ে জনে জনে;

এরা প্রেম করে একজনের সাথে ভালোবাসে আরেকজনকে
বিয়ে করে সম্পূর্ণ নতুন একজনকে
এরা কবুল বলে মানুষকে
বিয়ে করে টাকাকে
বিয়ে করে সম্পদকে
পণ্য করে নারীকে
সংসার করে একজনের সাথে
রাত কাঁটায় আরেকজনের সাথে
ঘরে নিজকীয়া বাইরে পরকীয়া
গাছেরটাও খেতে চায় তলারটাও কুড়ায়
সংসার পাকায় জটিল চুলায়,
আমার কি সাধ্য আছে মানুষ লিখার?
 
তবুও মাঝে মাঝে যখন মানুষের নানা রূপ দেখি
চেষ্টা করি কিছু লিখার
চেষ্টা করি আঁকার
চামড়া আঁকতে গিয়ে শরীর আঁকি
হৃদয় আঁকতে গিয়ে আঁকি রক্ত
মন আঁকতে গিয়ে অন্ধকার আঁকি
আর মানুষ আঁকতে আঁকতে এঁকে ফেলি দানব
কি করব বলো!
আমি মানুষ লিখতে চাই
মানুষের কথা লিখতে চাই
অথচ চারিপাশের মনুষ্যত্বহীন মানুষগুলো দেখে বোবা বনে যাই;

তোমরা ভুল বুঝো না আমায়
এর মাঝেও ভালো মানুষ আছে
অনেক অনেকই আছে
আমি প্রতিনিয়ত তাঁদের খুঁজে বেড়াই
সূর্যের টর্চ জ্বেলে, জ্যোৎস্নার আলো জ্বেলে
কখনো অন্ধকার আকাশে উড়িয়ে ফানুস   
সৃষ্টিকুলের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি তো মানুষ;

একদিন তাঁদের কথাও লিখব, নিশ্চয়ই লিখব;
তাঁদের ভালো ভালো সব কথাগুলো
তাঁদের সুন্দর সুন্দর সব গল্পগুলো
আজ না হয় কিছু অন্ধকার মানুষের গল্পটুকুই থাকলো!

   

#কবিতা
মানুষ লিখার চেষ্টা
 - যাযাবর জীবন


ছবিঃ নেট থেকে সংগৃহীত, এডিট করা।




 

দ্বিতীয় সুযোগ

এই যে দিনরাত্রি টাকা টাকা টাকা করি!
টাকা কার?
টাকার মালিক কে?
আমি?
সাদা কাফনে  ঐ তো আমি আছি পড়ে  
আর আমার টাকাগুলো আছে সব ব্যাঙ্ক ভরে  
টাকার মালিক যদি আমিই হই!
তাহলে দিয়ে দাও সব কেঁচে কুঁচে আমার সাথে
ঘুমিয়ে থাকি মাটির ঘরে
টাকা চাপা পড়ে;

টাকা কি আলো দেবে ওখানে? ঐ অন্ধকার ঘরে!  
প্রশ্নকর্তার জবাব কেনা যাবে? মুঠো ভরা টাকা দিয়ে!
ইল্লিইনে যাওয়া যাবে টাকার বিনিময়ে?  
শান্তির ঘুম কেনা যাবে, ইলমে বারজাকে?  

এত সহজ?
এই যে টাকা টাকা শুরু করেছিলাম যৌবনের শুরু থেকে!  
বুঝতেই পারলাম না কখন যে চলে এলাম মাটির ঘরে
টাকা টাকা টাকা টাকা করতে করতে,  
কটা দিন কাটিয়েছি স্বস্তি ভরে?
কটা দিন শান্তির ঘুম ঘুমিয়েছি টাকার চিন্তা বাদ দিয়ে?
এখানে যে একদিন আসতেই হবে! একবারও মনে করেছিলাম আগে?
ওখানে কি না হতো টাকার বিনিময়ে?
এখানে কি হবে টাকা দিয়ে?

আহহ্! একটাবার যদি ফিরে যাওয়া যেত মাটির ওপর!   
মাত্র একটাবার!
শুধরে নিতাম সমস্ত ভুলগুলো,
বদলে নিয়ে আসতাম আমলনামাগুলো;

তাই কি?
নাকি আবারও টাকার গোলামী করতাম সব ভুলে গিয়ে!
কে জানে?
হয়তো,
হয়তো না;
মৃত্যু জীবন'কে দ্বিতীয় সুযোগ দেয় না।


০৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০

#কবিতা
দ্বিতীয় সুযোগ
 - যাযাবর জীবন








কবিতা লেখার চেষ্টা

ছিলো এক ছন্নছাড়া জীবন
ভালোই ছিলো যেখানে যেমন
যখনই চার চোখের মিলন
তখনই উড়ু উড়ু মন

প্রেমের কিছু তাপ
মনের কিছু ভাপ
কাছে আসার চেষ্টা
কিছু শরীরের তেষ্টা

সারাক্ষণ উড়ুক্কু মন
কাছে আসতে চায় দুজন
শরীর শরীর কাছাকাছি হলে
ভালোবাসা কথা বলে

মন ছুঁয়ে ছুঁয়ে প্রেম
শরীর ছুঁয়ে ছুঁয়ে খেলা
উচাটন দুটি হৃদয়
যখন তখন সারাবেলা

খেলতে খেলতে রাগ
খেলতে খেলতে অনুরাগ
খেলতে খেলতে বিচ্ছেদ
খেলতে খেলতেই সম্পর্কচ্ছেদ

খেলা শেষে যত রাগ
খেলা শেষে অনুতাপ
খেলা শেষে ক্ষরণ
ভালোবাসার মরণ

দুজনার দুটি পথ
বিষণ্ণ মনোরথ
অথচ মনের আড়
পারে না করতে পাড়

এখানে যখন ঝুম বৃষ্টি
ওখানে ভিজছে সে একা
ওখানে মনখারাপের জ্যোৎস্না
এখানে বিষণ্ণ সে একা

ভালোবাসার পুরনো স্মৃতি
অনুরাগ অনুভূতি
মনে যখনই স্মৃতির দাগ   
কাগজে কালির আঁক

বিচ্ছেদের বিষম ফাঁদে
ক্ষরণে দুজনই কাঁদে
মনে হারানো ভালোবাসার তেষ্টা
খাতায় কবিতা লেখার চেষ্টা।

০৩ সেপ্টেম্বর, ২০২০

#কবিতা
কবিতা লেখার চেষ্টা
 - যাযাবর জীবন



ছবিঃ নেট থেকে সংগৃহীত, এডিট করা।



সম্পর্কের খেলা

আজকাল চারিদিকের দৃশ্য বদল হর হামেশায়
রাত আর দিন কাটে রঙ বদলের খেলায়
ইদানীং অন্ধকারেও রংবেরং এর আলো দেখি
দুপুর সূর্যে মানুষের ভেতরকার কালো দেখি
আর রঙের বদলের সাথে সাথে
মানুষের বদলে যাওয়া দেখি;

এই যে রঙের বদল সাথে সাথে মানুষের
প্রকৃতিও কি বদলায় না? প্রকৃতিও বদলায়;   
আলো বদলে গিয়ে অন্ধকার
দিন বদলে হয় রাত
বরফ বয়ে বয়ে হয় নদী
দিনের আকাশে সূর্য, রাতে চাঁদ;

সম্পর্কে রঙের খেলা সবচেয়ে বেশী কখন দেখা যায় জানো?
যখন স্বার্থ চিৎকার করে গান গায়
যখন অর্থ অনর্থের কারণ ঘটায়
যখন রক্ত সম্পর্ক কাটে
যখন জীবন বিফল মনোরথে
আর অনুভূতিগুলো অনুভূতিহীনতায় কাটে;

প্রকৃতির বদল মেনে নেয়া যায়
মানুষের বদলটা মেনে নেয়া বড্ড দায়,  
বিশেষ করে খুব কাছের মানুষগুলোর
তবুও মানুষ বদলায়, হরহামেশায়;
চেনা চেনা মুখগুলো খুব অচেনা হয়ে গিয়ে
সম্পর্কের খেলায় সম্পর্কহীন হয়ে হয়ে।

 
৩১ আগস্ট, ২০২০

#কবিতা
সম্পর্কের খেলা
 - যাযাবর জীবন


ছবিঃ নেট থেকে সংগৃহীত, এডিট করা।



জোড়ায় জোড়ায়

আমার বারান্দায়
অনেকগুলো চড়ুই পাখি
অনেকগুলো কিচিমিচি,
কি করছে ওরা?

ঝগড়া করছে না ভালোবাসছে?
প্রেমের কথা বলছে? নাকি অন্যকিছু?
ক্ষণে ক্ষণে ঠোঁটে ঠোঁটে কি যেন বলছে?
চুমু খাচ্ছে না তো!

হয়তো, হয়তো না
হয়তো সুখের কথা বলছে
হয়তো দুঃখের কথা বলছে
হয়তো ক্ষুধার কথা
হয়তো পিপাসার কথা
হয়তো বর্তমানের সমস্যা
হয়তো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
কিছু না কিছু তো বলছেই;

আমার মাঝে মাঝে খুব জানতে ইচ্ছে করে
এত সুখ কোথা থেকে আসে ওদের মাঝে
যখনই দেখি জোড়ায় জোড়ায় দুজনে দুজনে
জোড়া ভাংতে দেখি নি কখনো পাখিতে;

আচ্ছা! মানুষেরও তো জোড়া আছে
তবু কেন এত বিভক্তি জোড়ার মাঝে?
এত ঝগড়া  
এত অতৃপ্তি
এত অবিশ্বাস
এত ভেঙে যাওয়া
শুধুই মানুষের মাঝে!
মানুষ থেকে বেশী আর কোন প্রজাতি জোড়া ভাঙে?



৩০ আগস্ট, ২০২০

#কবিতা
জোড়ায় জোড়ায়
 - যাযাবর জীবন  


ছবিঃ নেট থেকে সংগৃহীত।