খুব ছোট বেলার কথা। হালিম (আসল নামটা উহ্য রাখলাম) আমার বন্ধু। এক সাথে এক ক্লাসে পড়ি। সে সময়কার ছেলেবেলা এখনকার মত ঘরের গণ্ডিতে বন্দী না। একদম উদ্দাম উচ্ছল সরল। সকালে স্কুলে যেতাম, দুপুরে কোনমতে বইখাতা ঘরে রেখেই দুটো খেয়ে দলবেঁধে ছুটতাম খেলার মাঠে। আমাদের মাঝে কে ধনী কে গরীব কার বাবার সামাজিক অবস্থান কি আর বাবা কি করে এগুলো নিয়ে কখনো মাথা ঘামাই নি কখনোই, আসলে ঐ বয়সে এগুলো মাথায় আসেই নি! ঘামাবো কি করে? তখন শুধু স্কুল আর খেলা, ব্যাস! এটুকুই জীবন। তখনকার সবচেয়ে অসহনীয় অংশটুকু ছিলো সন্ধ্যের পর পড়তে বসা। বসতে হতো মায়ের সামনে; কোন দিন পড়তে বসতে ইচ্ছে না করলে বাবার চোখ গরম আর মায়ের হাতের মার; আমাদের সময় কমবেশি এটাই কমন ছিলো।
তো যে কথা বলছিলাম, হালিম। হ্যাঁ হালিম ছিলো সেই ক্লাস ওয়ান থেকে আমার সহপাঠী, আমার বন্ধু। আমরা একসাথে স্কুলে যেতাম, একসাথে টিফিন ভাগ করে খেতাম, একসাথে বিকেলে খেলতে যেতাম। ওহ একটা কথা বলা হয় নি, আমরা ক্লাস ওয়ান থেকে পড়তাম গার্লস স্কুলে। তখন আমাদের মহল্লার গার্লস স্কুলে ছেলেরা পড়তে পারতো ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত, তারপর স্কুল বদল করতে হতো। যেহেতু বাড়ির পাশে স্কুল, আর তখনকার দিনে এত স্কুল কলেজের কোন বাছবিচার ছিলো না আর বয়েস বা গার্লস নিয়ে আমাদের মাঝে কোন মাথাব্যথা ছিলো না তাই গার্লস স্কুলেই আমরা মহল্লার সমবয়সী সব ছেলেমেয়ে মিলেমিশে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে ছিলাম। যখন ক্লাস ফাইভ এর পরীক্ষা দেওয়ার পর আমাদের স্কুল বদলের সময় এলো আমরা সবাই খুব মনমরা ছিলাম। আমার বেশ মনে আছে, স্কুলের শেষ দিনে ক্লাসের মেয়েরা ছলছল চোখে আমাদের বিদায় জানিয়েছিলো, মায়ের মাইর ছাড়াও যে অন্য কোন অনুভূতি জনিত কারণে চোখে পানি আসতে পারে ওটা যেন সেই প্রথম বুঝতে পেরেছিলাম। অনুভূতিটা যে কি তা আসলে তখনো বোঝার বয়স হয় নি।
আমরা প্রায় বিশ জন মত ছাত্র ছিলাম ঐ স্কুলে, বাকি ত্রিশ মত মেয়ে; মেয়েরা তো রয়ে গেলো সেই স্কুলেই। আর আমাদের স্কুল বদলের পালা। এর মধ্যে আমি যে স্কুলে ভর্তি হলাম সেটাও তখনকার নামকরা কো-এডুকেশন স্কুল। সেখানেও ছেলে মেয়ে একসাথে। আমার পুরনো স্কুলের বন্ধুদের মধ্যে একমাত্র হালিমই আমার সাথে ঐ স্কুলে চান্স পেলো (স্কুলের নামগুলো উহ্য রাখলাম)। হালিমকে পেয়ে আমি বেশ খুশি, যাক! অন্তত একজন পুরনো বন্ধু তো জুটলো! এই স্কুলে এসে প্রথম সামাজিক অবস্থানের বিভেদের মধ্যে পড়ে গেলাম, ধনী-গরীব, বাবার আর্থিক অবস্থান এগুলো যে বন্ধুত্বের বিষয় হতে পারে তা কিছুদিন যেতেই হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করলাম। আমার খুব মনে আছে প্রথম দুই বছর নতুন স্কুলে মানিয়ে নিতে আমার বেশ কষ্ট হয়েছিলো, কষ্ট হয়েছিলো হালিমেরও, কষ্ট হয়েছিলো আমার মত আরো কয়েকজনের যাদের বাবার আর্থিক অবস্থান আমাদের সমপর্যায়ের। আমরা বাসে করে স্কুলে যেতাম, স্কুল বাস না কিন্তু! তখনকার দিনের ৬ নাম্বার লাইনের বাস। সেই ভোর বেলায় বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম, আবার দুপুরে স্কুল শেষে ৬ নাম্বার বাসেই বাসায় ফিরতাম। বাসে যেতে যেতেই আমার মত সামাজিক অবস্থানের আরো কয়েকজন বন্ধু বান্ধবের সাথে পরিচয়, কেও আমার দু এক ক্লাস ওপরে কেও দু এক ক্লাস নীচে আর কয়েকজন আমারই ক্লাসের। প্রথম বছর মানে ক্লাস সিক্স খুবই কষ্টে কাটালেও পরের বছর মানে ক্লাস সেভেন থেকে যেন অনেকটা সহনীয় (আমি বলবো অভ্যাসে পরিণত) হয়ে গিয়েছিলো। আর ওপর মহলের বন্ধু বান্ধবীরা এক একজন আসতো এক এক নামী দামী ব্র্যান্ডের গাড়িতে চেপে। আমি অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকতাম, যেন অন্য গ্রহের কোন রাজপুত্র কিংবা রাজকন্যা, ভুলে আমার ক্লাসের সহপাঠী হয়ে এসেছে।
ক্লাস এইটে ওঠার পর ওপর মহলের ঐ রাজপুত্র রাজকন্যাদের সাথে তখন বেশ ভালো সখ্যতা হয়ে গিয়েছে, দুই চারজন বন্ধু হিসাবেও যেন আমাদের সাথে মেশা শুরু করেছে, মন থেকে আস্তে আস্তে কালিমা দূর হয়ে যাচ্ছিলো। হালিম তখনো যথারীতি আমার ছায়াসংগী হয়ে। ক্লাস এইট থেকেই শরীরে পিউবারটিক্যাল চেঞ্জ আসা শুরু করেছে, তখনকার দিনে এগুলো খুব গোপন বিষয় ছিলো, কারো সাথে ডিসকাস করার উপায় ছিলো না; বন্ধুদের মধ্যেও এই বিষয়টা নিয়ে যেন সবাই বেশ বিব্রত ছিলো। সেই সময়, হ্যাঁ সেই সময়ই হালিম যেন কেমন অন্যরকম ব্যবহার করা শুরু করে দিলো। সে যেন খুব হঠাৎ করেই একদম অপরিচিত হয়ে উঠতে শুরু করলো। প্রথম প্রথম ক্লাস মিস দেওয়া শুরু করলো, তারপর বেশ বিরতি; ব্যবহারে ব্যাপক পরিবর্তন অল্প কিছুদিনের মাঝেই। তার মাঝে যেন কেমন একটা মেয়েলি ধাঁচের আচরণ লক্ষ্য করছিলাম। ছেলে আর মেয়ের পার্থক্য ক্লাস এইটের ছাত্রছাত্রীদের বোঝাতে হয় না, ওটা প্রকৃতিই বুঝিয়ে দেয়। হালিমের গায়ে পড়া, গায়ে ঢলা মেয়েলি আচরণে আমরা খুব বিরক্ত, বিব্রত; বিশেষ করে আমি। ওকে প্রায়ই বকাঝকা করি। তোর কি হয়েছে? এমন করিস কেন? বাকি বন্ধুরা মজা করে ওকে প্রায়শই হালিমা বলে ডাকতো। একদিন হঠাত করেই সে স্কুলে আসা বন্ধ করে দিলো।
বেশ কিছুদিন স্কুলে না আসাতে একদিন তার বাসায় গেলাম খবর নিতে, চাচা চাচী আমার সাথে হালিমের দেখা করতে দিলো না। বললো হালিম অসুস্থ পরে আসো। মনে আছে সেদিন খুব মন খারাপ করে চলে এসেছিলাম। তারপর আবার প্রায় মাস খানেক পর হালিমদের বাসায় গেলাম। এবারো তার সাথে দেখা হলো না, চাচি জিজ্ঞাসা করলেন কি দরকার তাকে? আমি বললাম সে স্কুলে যাচ্ছে না অনেকদিন, কোথায় সে? কেমন আছে? চাচি বললেন সে আর আমাদের স্কুলে যাবে না, সে নাকি চিটাগাং তার খালার বাসায় চলে গিয়েছে, ঐখানে কোন এক স্কুলে ভর্তি হয়েছে। আমি বললাম চাচি ফোন নাম্বার আছে? কিংবা ঠিকানা দেন, আমি চিঠি লিখব তাকে। চাচি ফোন নাই, ঠিকানা দেয়া যাবে না বলে প্রায় খারাপ ব্যবহার করেই সেদিন বিদায় দিয়েছিলেন মনে আছে। আমি খুব দুঃখ পেয়ে সেদিন চলে এসেছিলাম। যত না চাচির ব্যবহারে দুঃখ পেয়েছি তার থেকে বেশি কষ্ট পেয়েছি হালিমের ব্যবহারে, আমার বাল্য সাথী যাবার আগে আমাকে একবার বলে গেলো না?
সময় কারো জন্য বসে থাকে না। প্রায় বছর কেটে গেছে, ক্লাস নাইনের পরীক্ষার পর হঠাৎই একদিন রাস্তায় দেখা হয়ে গেলো হালিমের সাথে। কোন মেয়ে যেন পেছন থেকে ডাকছে, এ্যই আহসান! এ্যই আহসান। আমি চমকে পেছনে তাকালাম। দূর থেকে দেখি ববকাট চুলে অপরিচিত এক মেয়ে পেছন থেকে ডাকছে, আমি চিনতে না পেরে দাঁড়ালাম; কাছে আসার পর ভালো করে লক্ষ্য করে দেখি হালিম, আমি অসম্ভব চমকে উঠে জিজ্ঞাস করলাম কিরে হালিম! তোর কি অবস্থা? তুই এমন মেয়েদের বেশ ধরছিস কেন? সে মেয়েদের মত হাত পা ঘুরিয়ে বললো, সে অনেক কথা; আগে বল আমাকে কেমন লাগছে?
আমি বললাম তোরে কেমন লাগবে? একদম মেয়েদের মত লাগছে; তুই মেয়ে সাজছিস কেন তাই আগে বল?
সে বললো তুই বুঝবি না। আমি আসলেও বুঝি নি, আমাদের সময় বৃহণ্ণলা খুব কমন ফ্যাক্টর ছিলো না। রাস্তাঘাটে হিজড়া দেখা যেত খুব অল্প, তবে তাদের কেন হিজড়া বলে কিংবা ছেলে, মেয়ে আর হিজড়ার পার্থক্য বোঝার মত এত জ্ঞানগরিমা ঐ বয়সে আসলে আমাদের মাথায়ই ছিলো না। আচ্ছা আজ যাই রে, তোর সাথে অন্য একদিন দেখা করব, কিন্তু খবরদার তুই আমাদের বাসায় আসবি না, বলে সে সেদিনের মত চলে গেলো।
এরপর হালিমের সাথে দেখা আবার প্রায় তিন বছর পরে, তাও খুব হঠাৎ করেই। তখন আমি ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি। বৄহণ্ণলা কি ততদিনে আমার জানা হয়ে গেছে। হালিম ততদিনে শারীরিক ও মানসিক ভাবে প্রায় পুরোপুরি বৄহণ্ণলায় পরিণত হয়ে গেছে। আমার বাল্যবন্ধু, তাকে এ অবস্থায় দেখে আমার চোখে পানি চলে এসেছে। হালিম আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো, চল কোথাও বসি। আমার সাথে বসতে তোর লজ্জা করবে না তো! আমি বললাম তুই যেই হোস না কেন তুই আমার বন্ধু, আর বন্ধুর সাথে কোথাও বসতে লজ্জা করবে কেন? চল কোন রেস্টুরেন্টে বসি। সে বললো, না রে! রেস্টুরেন্টে না, ওখানে লোকজন আমার দিকে খুব খারাপ নজরে তাকায়। চল মাঠের দিকে যাই। প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, ওখানে বসে তোর সাথে একটু কথা বলি। জানিস! আমার না কথা বলার কেও নাই। বলে আমাকে নিয়ে আমাদের পুরনো খেলার মাঠে গিয়ে বসলো।
এরপর সে যা বললো তা শোনার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। একজন ছেলে থেকে বৃহণ্ণলা হওয়ার করুণ ইতিহাস।
এটা তার হালিমের মুখ থেকেই না হয় শুনি!
- আমি ক্লাস সেভেন থেকেই শরীরে কেমন যেন অস্বস্তি অনুভব করতাম, কেমন যেন অন্যরকম একটা অস্বস্তি। হঠাত হঠাত মনে হতো আমি যেন ছেলে না, আমি যেন মেয়ে হয়ে গেছি। ভালো করে শরীরে, গোপন অঙ্গে হাত বুলিয়ে দেখতাম নাহ! আমি তো ছেলেই আছি, তবুও মনের মধ্যে অস্বস্তি। দিন দিন এটা বাড়তে লাগলো, ছেলেদের সঙ্গ মনে কেমন যেন অন্যরকম অনুভূতির জন্ম দিতো। আমি ধীরে ধীরে তোদের দিকে ঝুঁকে পড়ি, তোদের গায়ে হাত দিতাম, খুব ইচ্ছে করতো তোরাও আমার গায়ে হাত দে, একটা ছেলে যেমন একটা মেয়ের গায়ে হাত দেয় ঠিক তেমনি। কিন্তু তুই বা ক্লাসের অন্যান্য ছেলেরা তা তো করতিই না বরং আমায় দূর দূর করতি, বকাঝকা করতি। তোর মনে আছে! একদিন তোর গায়ে অনেকক্ষণ হাত বুলিয়েছিলেম বলে তুই আমাকে কি বকাই না দিয়েছিলি! পারলে যেন সেদিন মারতি আমায়। অথচ আমি খুব চাচ্ছিলাম কেও তো আমাকে মেয়েদের মত ছুঁয়ে দেখুক! কেও তো আমার গায়ে হাত বুলাক। ধীরে ধীরে এ সমস্যাটা প্রকট হয়ে উঠতে শুরু করে।
তোর মনে আছে? ক্লাস এইট থেকে আমি স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেই, তুই খবর নিতে আমার বাসায় গিয়েছিলি। আমি কিন্তু তখন বাসায়ই ছিলাম, বন্দী। ক্লাস এইটের ওঠার পর থেকেই আমি মহল্লার ছেলেদের সাথেও একই ব্যবহার শুরু করি, ওরাও তোদের মত দূর দূর করতো, তারপর শুরু হলো মার; সে কি মার! আমি মার খেতাম আবার তাঁদের ধরতাম, আবার মার খেতাম। বাসায় বিচার আসা শুরু হলো, মাঝে মধ্যে মার খেয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় বাসায় ফিরতাম; ফিরেই আবার মার খেতাম বাবার কাছে, মার খেতাম বড় ভাইদের কাছে। আমার একমাত্র ভরসার জায়গা ছিলো মা।
ততদিনে আমার বুকের আকারে পরিবর্তন চলে এসেছে, মেয়েদের মত না হলেও কিঞ্চিৎ ভারী ভারী অনুভব হতো, বাসা থেকে বের হতে দিতো না তাই বাসায় মেয়ে সেজে বসে থাকতাম, মেয়ে সেজে আয়নায় নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতাম; কেমন যেন এক অন্যরকম আবেশ! অন্য এক অনুভূতি গ্রাস করতো আমাকে, আমি চলে যেতাম স্বপ্ন জগতে; তোদের সবাইকে নিয়ে ফ্যান্টাসি করতাম মনে মনে। তারপর বাবা-মা একসময় আমাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যায়, ডাক্তার অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষার পর আমাকে বৄহণ্ণলা ঘোষণা করেন। এর তেমন কোন চিকিৎসা তাদের জানা ছিলো না, তখন মাত্র অপারেশন এর সম্ভাবনার কথা আলোচনা হচ্ছিলো, তাও পাশ্চাত্য দেশে, ওগুলো আমাদের স্বপ্নের বাইরে। হরমোনাল কিছু ঔষধ পত্র আর আমার পিঠে বৄহণ্ণলা ছাপ নিয়ে বের হয়ে আসি ডাক্তারের চেম্বার থেকে।
তারপর থেকে বাসায় আমার অবস্থান হলো কুকুরেরও অধম, বাবা ভাই বোন কেও দেখতে পারে না, আমাকে দেখলেই ছিঃ ছিঃ করে, দূর দূর করে; আমার থালা বাসন, এমনকি খাওয়ার জায়গা, শোয়ার জায়গা সব আলাদা করা হলো, যেন আমি এক অচ্ছুৎ; শুধুমাত্র মা ছিলো আমার ভরসা, তাই দুটো খেতে পারতাম। প্রায় বছর খানেক ঘর বন্দী থেকে একদিন মা'কে বললাম আর কতদিন আমাকে আটকে রাখবে, হয় বিষ খাইয়ে মেরে ফেলো অথবা আমাকে বাইরে যেতে দাও। ঘরের ভেতর বন্দী অবস্থায় তো আর সারাজীবন থাকতে পারব না। মা বুঝলো, তারপর থেকে শুরু হলো আমার বাইরের জীবন।
পুরনো বন্ধুবান্ধব কারো সাথে যোগাযোগ করি নি, তাও হঠাত হঠাত রাস্তায় দেখা হয়ে যেত; তারা হয় চিনতে পারতো না কিংবা চিনতে পেরে দূর দূর করতো। একদিন তোর সাথেও তো দেখা হয়েছিলো, তোর মনে আছে? আমি বুঝতে পেরেছিলাম তোদের সমাজ আর আমায় মেনে নেবে না, তাই আমি খুঁজতে লাগলাম আমার মত আর কারা কারা আছে? ধীরে ধীরে একজন দুজন করে পরিচয় হতে লাগলো তাদের সাথে; বিশ্বাস কর তারা কিন্তু একবারও আমার সাথে খারাপ আচরণ করে নি, বরং আমাকে টেনে নিয়েছিলো খুব আদরে। আমি তাদের গ্রুপে যাওয়ার পর জানতে পারি এক একজনের এক এক বয়সে আমার মত শারীরিক ট্রান্সফরমেশন হয়েছিলো, কারো কম বয়সে কারো বেশী বয়সে, কারো কারো বা জন্ম থেকেই। আমি ভিড়ে গেলাম হিজরাদের দলে, তাদের সাথে দল বেঁধে থাকতাম, দল বেঁধে চলতাম। বছর খানেক চলার পর বুঝতে পারলাম এরা পড়ালেখা করে নি, আর বেশিরভাগেই এসেছে খুব নিচু ঘর থেকে। হাজার হোক আমার মধ্যে শিক্ষা ছিলো, তোদের সাথে ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছিলাম ভালো স্কুলে; আমাকে পড়াশুনা টানতে লাগলো; আমি আবার পড়ালেখায় মনোযোগ দিলাম। তোদের এক বছর পর আমিও চিটাগাং এর এক কলেজ থেকে মেট্রিক দিলাম; এখনো পড়ালেখা করছি।
খুব কষ্ট লাগলো শুনে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, বাসায় যাস না? সে বললো না রে; খুব কম। মাঝে মধ্যে মাকে যখন খুব দেখতে ইচ্ছে করে তখন পাশের বাসায় ফোন করে মা'কে ডাকি; কিছুক্ষণ কথা বলি। আর মাঝে মাঝে যখন অস্থির হয়ে যাই তখন মা'কে বাইরে কোথাও আসতে বলি, মায়ের সাথে কিছু সময় কাটাই; তারপর কাঁদতে কাঁদতে মা চলে যায়, আমিও কাঁদতে কাঁদতে আমার ঠিকানায়। তার কথায় আমারও চোখ ভিজে উঠলো, সন্ধ্যার গোধূলিতে মন খারাপ করে দুই বন্ধু বসে রইলাম পাশাপাশি; আমি তার হাতে হাত রাখতেই সে চমকে তাকালো। বললো আমাকে ছুঁয়ে দিলি? তোর ঘিন্না করলো না? আমি বললাম না রে, বন্ধুর হাতে বন্ধু যদি হাতই না রাখতে পারলো তাইলে আর বন্ধুত্ব কিসের? সে কান্না জড়িত কণ্ঠে বললো, জানিস! আমার ভাই বোনরাও কিন্তু আমায় ছুঁয়ে দেখে না, কতদিন ভাইবোনদের একটু জড়িয়ে ধরি না!
সেই শেষবার, তারপর আমার আর হালিমের সাথে কোন যোগাযোগ হয় নি; ও যেন একদম ভ্যানিস হয়ে গিয়েছে। আমরা বন্ধুবান্ধবরা একসাথে মিলিত হলে মাঝে মধ্যেই হালিমের কথা উঠে আসতো। এক একজন এক এক কথা বলতো, যার সাথে দূর দূর দিয়ে হালিমের জীবনের সাথে কোন মিল নেই। কেও কেও তার ট্রান্সজেন্ডার হওয়ার বিদ্রূপ করতো, আমার কেন জানি খুব খারাপ লাগতো। হাজার হোক আমার বাল্য সাথী, ওর জন্য কেমন একটা মায়ায় জড়ানো একটা অনুভূতি আমার রয়েই গিয়েছিলো।
এখনো হিজড়াদের কোন দল দেখলে ওদের মাঝে হালিম'কে খুঁজি, আশায় থাকি, কখনো ওকে দেখতে পাবো; আশায় থাকি পেছন থেকে হয়তো কোন একদিন মেয়েলি একটা কণ্ঠ ডেকে উঠবে - এ্যই আহসান! এ্যই!
২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০
#গল্প
এক বৃহণ্ণলার গল্প
- যাযাবর জীবন
ছবিঃ নেট থেকে সংগৃহীত, এডিট করা।
বুধবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২০
এক বৃহণ্ণলার গল্প - গল্প
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন