আইজ তিনদিন ধইরা ধলু ব্যাপারির মিজাজ আসমানে উইঠঠা আছে। মিজাজ খারাপ হইলে ধলুর মুখে খালি থুথু আহে, একটু পর পিচিক পিচিক কইরা থুথু ফালাইতাছে; তারপরও মিনিটে মিনিটে মুখ ভইরা যেন এক পুস্কুনি থুথু আইয়া জমে।
পুস্কুনির পাড় ধলু ব্যাপারির সবচেয়ে পছন্দের জায়গা। পুস্কুনির দক্ষিণ পাড়ে একটা ছোট্ট একচালা বেড়ার ঘর বানায় লইছে। যত্তসব আকাম কুকাম ধলুর এই চালাঘরে। সন্ধ্যাডা হইতে দেরি, চ্যালা আক্কাসের বাংলা মদের বোতল খুইল্লা দিতে দেরি হয় না, লগে পিয়াইজ মরিচ দিয়া বাদাম, নাইলে চানাচুর মাখা রেডিই থাকে। ধলু ব্যাপারি সারাদিন গুদামের কাম শেষে সন্ধ্যা বেলায় আইয়া এই চালাঘরে ঢুকে। নেশা রঙিন হইয়া উঠলে শরীলডা মাইয়া মাইন্সের লাইজ্ঞা কানতে থাহে। আক্কাইস্যা মাঝে মইধ্যে গঞ্জ থাইক্কা মাগী ভাড়া কইরা লইয়া আহে, তারপর নেশা জইমা উঠলে সারারাইত মচ্ছব। ধলু বেশিরভাগ রাইত এইহানেই কাটায় দেয়, মাঝে মইধ্যে মাগীর আমদানি না হইলে নেশায় বুঁদ হইয়া ঘরে ফিরা বৌ এর উপ্রে ঝাপায় পড়ে। আইজ তিনদিন ধইরা তার নেশার বারটা বাজছে, সব ওলোটপালট হইয়া গেছে। যত নষ্টের গোড়া ঐ কামলা সামসুর হারামি বৌডা।
সামসুর যুয়ান সুন্দরী বৌ এর দিকে ধলুর কুনজর পড়ছে অনেকদিন ধইরাই, এতদিন চেষ্টা কইরাও বাগে আনতে পারে নাই। গত সপ্তাহে সামসুরে অনেক ফুসলাইয়া টেকার লোভ দেহাইয়া এক সপ্তাহের লাইজ্ঞা চরের ক্ষেতে কামলাগো সর্দার বানায় পাঠাইতে পারছে। চর গ্রামের থাইক্কা নৌকায় আধা দিনের রাস্তা, তাই ঐহানে কামলারা একবারে সাত দিন কইরা বদলি ডিউটি করে। এর আগে সামসুরে কামলা হিসাবে চরে পাঠাইতেই পারে নাই, তাই সর্দার হওনের প্রস্তাব দিতেই সামসু আর লোভ সামলাইতে পারে নাই। সর্দারের মজুরি কামলা থাইক্কা আড়াইগুন বেশি, আর চরে সব ক্ষেমতাও সর্দারগো হাতে; এইবার সামসু টোপ গিলছে।
সামছু যাইতেই ঐ রাইতে আক্কাসরে পোলাপাইন সহ পাঠাইয়া সামসুর বৌরে হাতপা বাইন্ধা তুইলা লইয়া আইছে। তারপর তিন রাইত ধইরা চলছে মচ্ছব। চিন্তা করছিলো সামসুর বৌরে প্রথম রাইতেই বাগে আনতে পারব, কিন্তু হারামি বেডি এত্ত বদ তিনরাইতেও বাগে আহে নাই। প্রত্যেক রাইতেই জোড় খাটাইতে হইছে। জোড় খাটাইয়া প্রত্যেকদিন কি আর মজা পাওন যায়? হারামি বেটি চতুর্থ রাইতে সুযোগ পাইয়া পায়ের গোড়ালি কামড়াইয়া ধরছিলো, এই যে ধরছে আর ছাড়াছাড়ির নাম নাই। ধলুর পায়ের গোড়ালির মাংস কাইট্টা দাঁত বইয়া গেছিলো, রক্তে তোষক বিছানা সব সয়লাব। চিল্লাইয়া আক্কাসরে ডাইকা হেরে দিয়া পা ছুডাইছিলো। একে লালপানির নেশা তারপর মাগীর তামশা, রাগের চোটে ধলুর মাথা পুরাই আউলায় গেছিলো, বারান্দা থাইক্কা দাওডা আইন্না মাগীরে ধামাধাম কোপাইতে লাগলো, রক্তে পুরা ঘর ভাইসা গেলো। শেষে আক্কাইসা আইসা থামাইয়া দাও কাইড়া লইলো। আক্কাসে ভালো কইরা দেইহা কইলো হুজুর মাগী তো মইরা গেছে! এহন কি হইবো!
ধলুর যেন হুশ ফিরলো, অনেক্ষণ চিন্তা কইরা কইলো, এক কাম কর, লাশটা বস্তায় ভইরা বিশ পঁচিশটা ইটা বাইন্ধা পুস্কুনিত ফালায় দে। মাছে খাইয়া ফালাইব নে। হেই থাইক্কা আইজ তিন দিন হইয়া গেলো ধলু মিয়ার ঘুম হারাম হইয়া গেছে। চোখ লাগলেই হারামি মাগীডা চোখের সামনে চইলা আহে, ধলু ধরফরাইয়া ঘুম থাইক্কা উইঠঠা বসে। একে তো দুশ্চিন্তা যে সামসুর আওয়ার সময় হইয়া গেছে আরেকদিকে অর্ঘুমে চোখ মুখ সব বইয়া গেছে। সারাক্ষণ মুহের ভিতর থুথু জমতে থাকে আর ধলু পিচিক পিচিক কইরা থুথু ফালায়।
আইজ বিকাল বেলায়ই ধলু ব্যাপারি তার চালা ঘরে ঢুইকা বোতল লইয়া বইছে। আক্কাসরে পাঠাইছে গঞ্জের বাজারে। সন্ধ্যা হইব হইব ভাব, এর মইধ্যেই ধলু মিয়ার আধা বোতল সাবার। পুস্কুনি পাড়ে কেও নাই, হঠাত কইরাই শুনে কে যেন কানতেছে; ধলু মিয়া এদিক চায় ওদিক চায়, কাওরে দেহে না। চালাঘর থাইক্কা বাইর হইয়া পুস্কুনি পাড়ে আইসা খুঁজতাছে কে কান্দে? হঠাত কইরা পুস্কুনির দিকে চাইয়াই ধলু মিয়ার কইলজায় কামুড় দিয়া উঠলো। দেহে সামসুর হারামি বৌডা পানির থাইক্কা গলা বাইর কইরা তার দিকে চাইয়া রাইছে আর খুনখুন কইরা কানতাছে। ধলুর যেন জ্ঞান বুদ্ধি লোপ পাইলো, চিৎকার কইরা উঠলো – ঐ মাগী কান্দস কেরে?
সামসুর বৌ এর কান্দা বন্ধ হয় না, বরং বাড়তেই থাকে। খুনখুন কান্নাটা যেন ধলু মিয়ার মাথায় গিয়া বিনতাছে, সাথে সাথে কইত্থাইকা যানি এক অসম্ভব রকম ভয় শরীরে ভর করতে থাকে, ধলু মিয়ার হাত পা অবশ হইয়া আসতে থাকে।
ধলু মিয়া এইবার গলার স্বর নামাইয়া আস্তে আস্তে জিগাইলো, ঐ মাগী! তরে না মাইরা ছালার ভিতর ভইরা ডুবাইয়া দিসি? তুই উঠলি কেমনে?
সামসুর বৌ কথার জবাব দেয় না, খুনখুন কান্না বাড়তেই থাকে, সাথে সাথে বাড়তে থাকে ধলু মিয়ার ভয়।
ধলু মিয়া আবার জিগায় – ঐ মাগী! কি চাস তুই?
সামসুর বৌ এইবার কয় – মাটি চাই ব্যাপারি, মাটি চাই; পানিতে আর ভালো লাগতেছে না, আমারে পুস্কুনি থাইক্কা তুলো, গোসল দেও, জানাজা দেও, কব্বর দেও, মাটি দেও।
ধলু মিয়া এইবার ভয়ের চোটে সাদা হইয়া যাইতে লাগলো, কইলো ভাগ মাগী, ভাগ। দূর হ চোখের সামনে থাইক্কা! দূর হ মাগী, দূর হ।
সামসুর বৌ ঐদিকে ক্রমাগত কইতেই লাগলো – মাটি দেও, মাটি দেও, মাটি দেও, মাটি দেও, মাটি দেও………… যেনো সমস্ত পুস্কুনি জুইড়া পানিগুলোও একসাথে কইতে লাগলো মাটি দেও, মাটি দেও, মাটি দেও; আশেপাশের গাছগুলাও যেন সুর মিলাইলো – মাটি দেও, মাটি দেও, মাটি দেও।
এইবার ধলু ব্যাপারি ঘামতে লাগলো, ভয়ের চোটে দোয়া দুরূদ পড়তে চাইলো কিন্তু কিছুই মনে করতে পারলো না; আর চারিদিক থাইক্কা সবাই যেন কানের ভিতর ড্রাম বাজইতে লাগলো মাটি দেও, মাটি দেও, মাটি দেও …………।
ধলু ব্যাপারি নিজের অজান্তেই আস্তে আস্তে পুস্কুনির দিকে আগাইতে লাগলো, তারপর কে যেন তারে টাইন্না পুস্কুনির ভিতরে নিয়া যাইতে লাগলো। হাটু পানি, কোমর পানি, বুক পানি, তারপর অঠাই; ধলু ব্যাপারি ডুবতে লাগলো আর চারিদিক থাইক্কা রব উঠতে লাগলো মাটি দেও, মাটি দেও, মাটি দেও।
পরদিন সকালে ধলু ব্যাপারির লাশ ভাইসা উঠলো পুস্কুনির মইধ্যেখানে, পানির ভিতর মাথা দিয়া উপুর হইয়া ভাসতে আছে।
২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০
#গল্প
মাটি দেও
- যাযাবর জীবন
বুধবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২০
মাটি দেও - গল্প
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন