বুধবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২০

ভয়, আবারও সে - গল্প

চারিদিকে করোনা নামক মহামারী। মহামারীর ছোঁয়া লেগেছে আমাদের বাড়িতেও - করোনা আঘাত হেনেছে। করোনাক্রান্ত আমি  আইসোলেটেড তিন তলায় এক রুমে; স্ত্রী চার তলায় আরেক রুমে। আমরা একান্নবর্তী পরিবার, আমাদের বাড়িটা চারতলা বাড়ি; পুরোটা জুড়েই আমরা থাকি। নিচতলা কমন, দোতলায় ছোট ভাই তার ফ্যামিলি নিয়ে, আমি তিনতলায় আমার ফ্যামিলি নিয়ে; চারতলাটা ছোট বোনের। সে শ্বশুর বাড়ি থেকে এ বাসায় আসলে থাকে, নতুবা আমরা দু ভাই মাঝে মাঝে আমাদের প্রয়োজনে ব্যবহার করি। চারতলায় ছোট বোনের জন্য করে দেওয়ার পরও এক পাশটায় বেশ খানিকটা খোলা ছাদ ছিলো। বাসার কাজের লোকদের থাকার জন্য এবং একটা বড় রান্নাঘরের প্রয়োজনীয়তায় ঐ খোলা অংশটায় আপাতত একটা টেম্পোরারি রান্নাঘর ও কাজের লোকদের থাকার জন্য ঘর করে নিয়েছি, উপরে টিনের চাল দিয়ে। যেহেতু বাসায় করোনাক্রান্ত দুইজন রুগী  (আমি ও আমার স্ত্রী) সুতরাং সে চারতলায় আমার বোনের বেডরুমে আইসোলেশনে আর আমি তিনতলায় আমার বেড রুমে; বাচ্চারা যার যার রুমে। তিন আর চারতলা জুড়ে আমরা সবাই আইসোলেশনে। যেহেতু আমার স্ত্রী চারতলায় তাই তার সাহায্যকারীরা (কাজের লোকেরা) তাই আপাতত: তার বেডরুমের পাশেই ড্রইং রুমে বিছানা করে থাকছে। 


একদিন অনেক রাত। আমি গভীর ঘুমে ছিলাম। ঘুমের মধ্যেই যেন ধুম ধুম ধুম ধুম শব্দ পাচ্ছি, ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়েছে, রেশ কাটছে না। এর মধ্যে ফোনের শব্দ। ঘুমের ঘোরেই ফোনের স্ক্রিনে দেখি আমার স্ত্রীর চেহারা ভেসে উঠেছে। মোবাইল ঘড়িতে দেখি রাত আড়াইটা, কি ব্যাপার? এত রাতে? হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে বলে উঠলো, শব্দ পাচ্ছ না? আমি ততক্ষণে বিছানায় উঠে বসেছি; ধুম ধুম করে কে জানি হাঁটছে। হ্যাঁ, পাচ্ছি তো! সে বললো, ছাদে হাটার শব্দ পাচ্ছি, দেখতো এত রাতে ওখানে কে হাঁটে? হাঁটলে কি এত জোড়ে শব্দ হয়? মনে হলো কে যেন দৌড়াদৌড়ি করছে। আমি ঘুম থেকে উঠে সিঁড়ি ঘরে যেতেই মনে হলো নাহ! শব্দ তো ছাদ থেকে না! নিচ থেকে আসছে মনে হলো। আমি নিচতলার ড্রইং রুমে ঘুরে এলাম, উঁহু! এখানে তো কেউ নেই? আবার মনে হলো ওপর থেকে আসছে। কেমন যেন গা ছমছম করছিলো। পুরো বাড়ি ঘুমিয়ে, আমি একা; তবুও ধীর পায়ে ছাদের দিকে রওয়ানা দিলাম। সবগুলো লাইট জ্বালিয়ে ছাদে উঁকি দিলাম। তারপর ছাদে পা রাখলাম, পুরো ছাদ ঘুরে দেখলাম।  উঁহু! ওখানে কেউ নাই তো! তাহলে? আবার মনে হলো নিচে থেকে শব্দ আসছে। এবার সত্যিই কেমন জানি ভয় ভয় করছিলো। কেমন এক অশরীরী ভয়, ছাদের দরজা লাগিয়ে সিঁড়িতে পা রাখতেই যেন জমে গেলাম। কেমন এক অদ্ভুত ভয়ে হাত পা সব জমে গেলো, আমি ছুটে নামতে চাইলাম; কিন্তু যেন পা ফেলতে পারছিলাম না সিঁড়িতে, সরসর করে মাথার পেছনের সব চুল যেন দাঁড়িয়ে গেলো এক অশরীরী ভয়ে। কতক্ষণ জমে ছিলাম ওখানে মনে নেই, এক মিনিট, দুই মিনিট কিংবা পাঁচ মিনিট! হিসেব নেই। তারপর একসময় সম্বিত ফিরে পেতেই, ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামতে লাগলাম। হঠাৎ করেই মনে হলো, আচ্ছা! ভাতিজারা কেও কি ট্রেডমিলে হাঁটছে? ট্রেডমিলে হাঁটলে গভীর রাতে এমন বাড়ি কাঁপানো শব্দ হতে পারে। ভেবে এবারকার গন্তব্য ছোট ভাই এর দোতলায়। প্রথমে নিজের ঘরে গিয়ে আগে মুখে মাস্ক পড়ে নিলাম তারপর দোতলায় গিয়ে ওদের ঘরের দরজা নক করলাম। রাত প্রায় তিনটা, এত রাতে ডাকার ফলে ছোট ভাই এর বৌ মনে হয় বেশ ভয় পেয়েই বের হয়ে এলো; আমি উঁকি দিয়ে ওদের ড্রইং রুমে দেখলাম ট্রেডমিল খালি, ওখানে কেও নেই। এত রাতে দরজায় শব্দ শুনে এর মধ্যে ভাতিজা দুইটাও বের হয়ে এলো। ছোট ভাই ঘুমচ্ছিল, ওকেও ডেকে তোলা হলো। কি হয়েছে কি হয়েছে বলে সেও বের হয়ে এলো; ছোট ভাইকে বললাম কোন শব্দ শুনছিস? সে বললো না। ভাই বৌকে জিজ্ঞাসা করলাম তোমরা শুনছ? তারাও বললো না। এবার ওদের ডেকে সিঁড়ির কাছে নিয়ে গেলাম, এবার শুনছিস? সবাই বললো হ্যাঁ! শুনছি তো! কে যেন ধুম ধুম করে হাঁটছে, নাকি দৌড়চ্ছে? আমি বললাম, সব জায়গা খুঁজে দেখেছি; কোথাও কিছু পাই নি তাই ভাবলাম ভাতিজারা কেও কি দোতলায় ট্রেডমিলে হাঁটছে কি না? ভাতিজারা বললো না তো বাপ্পা, এত রাতে ট্রেডমিল করব কেন? আমাদের বাড়ির রাতের ঘটনা ও 'সে' এর কথা ইতিমধ্যে সবারই জানা হয়ে গেছে, ফলশ্রুতিতে এবার ছোটভাই এর বৌ এর চোখেমুখে ভয় দেখলাম, সে দোয়া দরূদ পড়া শুরু করেছে। এবার আমি ও ছোট ভাই দুজনে মিলে আবার পুরো বাড়ির বাতি জ্বালিয়ে নিচ তলা থেকে চেক করা শুরু করলাম। একে একে নিচতলা, দোতলা, তিনতলা, চারতলা চেক করে এবার ছাদের দিকে রওয়ানা হলাম। ধুমধুম শব্দ এখনো হচ্ছিলো, তবে যেন আগের থেকে অনেক স্তিমিত হয়ে এসেছে। যেহেতু দু ভাই মিলে একসাথে গেলাম এবার আর ভয়টয়ের তোয়াক্কা করলাম না। ছাদে গিয়ে প্রতিটি কোনা দেখলাম, ছাদের পানির ট্যাংকির চারিপাশে ঘুরে দেখলাম, ছাদ থেকে উঁকি মেরে নিচে দেখলাম, উঁহু! কোথাও কিছু নেই। শব্দটা কিন্তু রয়েই গেলো। এবার মনে হচ্ছে নিচ তলার কোথাও থেকে আসছে। আমরা আবার ছাদের দরজা লাগিয়ে নিচে নেমে আসলাম। আমাদের নামার সাথে সাথে শব্দ স্তিমিত হতে লাগলো। এবার দোতলার সিঁড়ি ল্যান্ডিং এ দাঁড়াতেই শব্দ পুরোপুরি থেমে গেলো। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম; আর কোন শব্দ পেলাম না। প্রায় চারটা বাজতে চললো। ভাই চলে গেলো তার রুমে আমি  তিনতলায় আমার রুমে। এখন আর ঘুমানোর কোন মানে হয় না, তাহাজ্জুদে দাঁড়িয়ে গেলাম, একবারে ফজর পড়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। 


বেশ কিছুদিন কেটে গেলো, আমরা আলহামদুলিল্লাহ্‌ দুজনাই সুস্থ হয়ে আবার আগের জীবনে ফিরে গেলাম। এর মধ্যে একদিন বড় ভাতিজা একদিন দৌড়ে এসে বললো, বাপ্পা বাসায় কি হচ্ছে? আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কেন রে বাবা? কি হয়েছে? বললো, আমি নাস্তা খাব বলে ডিম ভেজে টেবিলে রেখে রুটি ভেজে এনে দেখি ডিম নেই। আমি বললাম হয়তো তোর ছোট ভাই দুষ্টুমি করে খেয়ে নিয়েছে। সে বললো - বাসায় তো কেউ নাই, মা'ও নাই ভাই'ও নাই; আমি একা তাই তো নাস্তা বানাচ্ছিলাম। আমি বুঝলাম সবই। বললাম তুই'ই বোধহয় মনের ভুলে ডিম ভেজে খেয়ে নিয়েছিস। ভাতিজা বললো - কি যে বলো না! আমি কি পাগল হয়ে গেছি? আমি বুঝলাম সব, বললাম মা নেই তো তোর একা একা ডিম ভাজার কি দরকার পড়েছিলো? তুই তিনতলায় এসে নাস্তা করলেই তো পারতি! ভাতিজাও বুঝলো, বললো - 'সে'! তাই না? আমি তাকে ভোলানোর জন্য বললাম, আরে নাহ! মাথা থেকে ওগুলো সরিয়ে ফেল; আলতু ফালতু বিষয় নিয়ে চিন্তা করিস না। আয় নাস্তা খাই একসাথে। 


কয়েকদিন পর। হঠাৎ করেই কাজের মেয়েগুলো হুড়মুড় করে নেমে এলো নীচে, আমার স্ত্রীকে বললো আজ রাতে চারতলায় গিয়ে থাকতে। কেন জিজ্ঞাসা করতেই বললো তাদের অনেক ভয় করছে, চারতলার টিনের চালে কে যেন ক্রমাগত হাটাহাটি করছে। আমি বুঝে গেলাম কিছু একটা নিয়ে 'সে' অসন্তুষ্ট হয়েছে। স্ত্রীকে বললাম, যাও আজ ওদের নিয়ে চারতলায় থাকো গিয়ে। দ্বিতীয় ও তৃতীয়দিনও তাদের ভয় কাটলো না - কিছু একটা দেখে বেশিই ভয় পেয়েছে মনে হলো। আমি এ ভয়ের স্বরূপ জানি, সুতরাং তাদের ভয় কাটার সময় দিলাম। 


এরমধ্যে বেশ কয়েকদিন কেটে গেলো। আমাদের বাসায় মধ্য বয়স্ক এক কাজের মহিলা আছে। এ আমাদের বাসায় আজ প্রায় বিশ বছর হয়ে গেছে। আমাদের বাসা থেকেই বিয়েশাদী হয়েছে, দুটো বাচ্চাও হয়েছে। খুবই নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত। স্বামী নিয়ে থাকে আমাদের বাসার খুব কাছেই। সকালে আসে, সারাদিন কাজকর্ম করে রাতে খাওয়া দাওয়া করে বাসায় যায়। কখনো প্রয়োজনে তার বাচ্চাগুলোকে নিয়ে আমাদের এখানেই রাতে থেকে যায়। করোনার এ দুর্দিনে সে তার বাচ্চা নিয়ে আপাতত আমাদের বাসাতেই আছে। ভয়ডরহীন ডাকাবুকো মহিলা। সেদিন হঠাৎ করেই রাত প্রায় এগারোটার দিকে দৌড়ে তিনতলায় নেমে এলো, ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে আছে। এসে বললো এ বাসায় থাকা যাবে না, বাসায় কোন একটা সমস্যা আছে। জিজ্ঞাস করলাম কি হয়েছে? বললো চারতলার ড্রইংরুম গুছিয়ে সে সিঁড়িঘর দিয়ে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিলো; হঠাৎ দেখে কালো মত মানুষের অবয়বে কি যেন ধোঁয়ার মত তার সামনে দিয়ে ঝড়ের বেগে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেলো, তারপর শুরু হলো রান্নাঘরের টিনের ছাদে দাপাদাপি। সে ভয়ে দৌড়ে নিচে নেমে এসেছে। 


আমি ঠিক বুঝে পাচ্ছি না, হঠাৎ করেই তার অসন্তুষ্টির কারণ কি? একটা কারণ কি হতে পারে যে আমরা এ বাসা ছেড়ে নতুন বাসায় উঠে যাওয়ার প্ল্যান করছি!  কিংবা অন্য কোন গূঢ় কারণ এর মাঝে নিহিত আছে! আমি নিশ্চিত সে কোন ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে এমন করছে না। কিছু একটা তো আছেই! সেটা যে কি ঠিক বুঝে উঠছি না। সময় বলে দেবে। 


(বিঃদ্রঃ এটা একটা অতিপ্রাকৃত সত্য ঘটনা। কেউ এটাকে একক গল্প মনে করেও পড়তে পারে। যারা আমার ভয় এর আগের পার্টগুলো পড়েছে তাদের জন্য এটা চতুর্থ পার্ট। প্রতিটা পর্বই আলাদা লিখতে চেষ্টা করলাম যাতে আগেরটা না পড়লেও কোন অসুবিধা না হয়।) 

        

২৬ নভেম্বর, ২০২০ 


#অতিপ্রাকৃত গল্প 


ভয়, আবারও সে 

 - যাযাবর জীবন 


ছবিঃ নেট থেকে সংগৃহীত। 



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন