কে, কে, কে?
- মোঃ আহসানুল হক
খুঁজছি, আতিপাতি করে খুঁজছি, গত সাত দিন ধরে ড্রয়ার উল্টেপাল্টে সবকিছু নামিয়ে নামিয়ে খুঁজছি।
প্রত্যেকের জীবনেই এমনটা নিশ্চয়ই অনেক বার করে হয়। কোন একটা বস্তু কোথাও রাখলেন পরে আর তা খুঁজে পাওয়া যায় না। পরে কোন না কোন সময় সে বস্তুটা বাসার কোথাও না কোথাও ঠিক খুঁজে পাওয়া যায়। আবার অনেক সময় যায়ও না।
এইতো গত সপ্তাহের কথা, মায়ের ডায়াবেটিসের ওষুধ কিনে এনেছিলাম। দশ পাতার বক্সে চার পাতা কম থাকায় দোকান থেকে পুরো বক্সটাই নিয়ে নিয়েছিলাম। আর সে ঔষধের বাক্সে আমার জন্য চার পাতা আর্থ্রাইটিসের ওষুধ ঢুকিয়ে রেখেছিলাম।
যেহেতু দিল্লির ডাক্তার তাই ইন্ডিয়ান ঔষধ দিয়েছে আর স্পেশালি এই ঔষধটা বাংলাদেশে হয় না। এটা ইন্ডিয়া থেকে আসে তাই চাইলেই চট করে যে কোন দোকানে এটা পাওয়া যায় না। গুলশানে একটা দুইটা ওষুধের দোকানে পাওয়া যায়। আমার মত আরও কিছু রোগীর জন্য ওরা এনে রাখে। ওষুধটা কিনে আনার পর আমার খুব মনে আছে বাক্সটা আমি ওপরের অর্থাৎ আমার ঔষধের ড্রয়ারে রেখেছিলাম। আগের ঔষধের পাতায় তখনও দুটা ট্যাবলেট ছিল বলে নতুন পাতা আর দুদিন বের করা হয়নি। ঐ দুটি ট্যাবলেট ফুঁড়োতেই আমার নতুন কে না স্টক থেকে ওষুধ আনতে গেলাম। কিন্তু সেদিন আর ওষুধের বাক্সটাই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। একটা দুটো করে সবগুলো ড্রয়ার উল্টাপাল্টা করে ফেলে কোনা-কাঞ্চি আঁতিপাঁতি খুঁজেও ঔষধের বাক্স পেলাম না। ঔষধের পুরো বক্সটাই হওয়া। মহল্লার দোকান থেকে আম্মার ডায়াবেটিসের ঔষধ তো কিনে আনা গেল, তবে আমার ঔষধটার জন্য আর গুলশান যাওয়া হয়নি। যাব, যাচ্ছি করে দিনের বেলায় অলসতাতে যাওয়া হয়নি, রাতের বেলা তারাবীহ পড়ে ফিরতে ফিরতে সাড়ে দশটা। এত রাতে আর গুলশান যেতে ইচ্ছে করে না। ফলে এক সপ্তাহ ধরে ঔষধটা না খাওয়াতে পায়ের ব্যথা প্রচণ্ড বেড়ে গেল। ওদিকে বউ ক্রমান্বয়ে ঘ্যানঘ্যান করছে - আমি অলস, কুড়ের বাদশা ইত্যাদি, ইত্যাদি বলে। সেও কয়েকবার যত সম্ভাব্য জায়গায় ঔষধ থাকতে পারে তা আতিপাতি করে খুঁজল, কোথাও ঔষধ না পেয়ে বলল - তোমার যা ভোলা মন! কনফার্ম তুমি ঔষধগুলো কিনে দোকানেই রেখে এসেছ। যাই হোক বকাঝকা করলেও মহিলার মন ভালো, মনে হয় আমার প্রতি একটু আধটু মায়াদয়া এখনো অবশিষ্ট আছে, পরদিন নিজেই অফিস থেকে ফেরার পথে গুলশান থেকে আমার ঔষধ কিনে আনল।
আজকাল কিছু কিছু ঘটনা বড্ড এলোমেলো। ঘটনার ঘনঘটায় মাঝেমধ্যে এলোমেলো হয়ে যাই আমি নিজেই। একটি ঘটনা সামলে উঠতে না উঠতেই আরেকটির জন্ম, আমি হত বিহ্বল হয়ে যাই প্রায়শই। আজ রাতে ডিনারের পর প্রেশারের ঔষধ শেষ হয়ে যাওয়ার ফলে নতুন পাতার জন্য ঔষধের ড্রয়ার খুলেই আমি হতবাক, আম্মার ডায়াবেটিসের ওষুধের বাক্সটা ড্রয়ারের একদম উপরে। প্রথমে আমি ভাবলাম বউ বোধহয় আমার ঔষধের সাথে আম্মার জন্যও নতুন বক্স কিনে এনেছে। আমি এ ঘর থেকেই চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলাম - মায়ের জন্য কি ডায়াবেটিসের নতুন বক্স কিনেছ? সে ডাইনিং থেকেই উত্তর দিলো, হ্যাঁ - দেখো আমার ঔষধের ড্রয়ার খুললে ওপরেই পাবে। দ্বিতীয় ড্রয়ারটা বৌ এর ঔষধের ড্রয়ার। ড্রয়ার খুলেই দেখি ওপরে আরেকটি বক্স। দ্বিতীয় ড্রয়ার বন্ধ করে প্রথম ড্রয়ার খুললাম - ওখানেও একই ঔষধের আরেকটি বক্স। আমি কনফিউজড হয়ে ওপরের ড্রয়ারের বাক্স খুলেই চমকে উঠলাম। এ তো আমার কেনা সেই বক্স, দুপাতা আম্মার ওষুধ বাকি চারপাতা আমার। আমি বাক্সটা বের করে খাবার টেবিলে এনে সবার সামনে বসলাম। বউ প্রশ্নবোধক দৃষ্টিহীনতেই আমি বাক্সটা তাকে দেখালাম। সে বললো - পুরো বক্স এনেছ কেন? মা'কে এক পাতা করে ঔষধ দেই নাইলে উনি ডাবল, ট্রিপল করে ঔষধ খেয়ে ফেলে।
আমি বললাম সেটা তো জানি!
বৌ জিজ্ঞেস করলো - তবে?
আমি বাক্সটা খুলে তাকে দেখালাম।
সে জিজ্ঞেস করল কোথায় পেয়েছ?
আমি বললাম আমার ঔষধের ড্রয়ারে। ড্রয়ার খুলতেই একদম সমস্ত ওষুধের উপরে।
সে একটু বিস্মিত হয়ে বলল ওখানে তো তুমিও খুঁজেছ আমিও খুঁজেছি; এটা ওখানে আসলো কিভাবে?
এটা যে ওখানে কিভাবে আসলো তা আমি জানিনা।
তবে কি, - সে?
কথাটা বলতেই আমার ছেলে মেয়ে একযোগে আমার দিকে তাকাল।
এখন তারাও জানে আমার সাথে প্রায়শই এগুলো হয়।
কোন একটা জিনিস আঁতিপাঁতি করে খুঁজে পাচ্ছিনা, হঠাৎ করে সাত দিন, পনর দিন বা এক মাস পরে খুব হুট-হাট করেই যেখানে রেখেছিলাম সেখানে কিংবা তার আশেপাশেই পাওয়া যায়।
এইতো এই শুক্রবারের কথা।
জুম্মার নামাজ পড়তে গিয়েছি। বাড়ির একদম পাশেই মসজিদ।
ওই যে কথায় বলে না মক্কার লোক হজ্জ পায় না! আমার হয়েছে সেই দশা। কোন না কোন কারণে দৌড়াতে দৌড়াতে একবারে নামাজ দাঁড়িয়ে গেলে শেষ মুহূর্তে গিয়ে হাজির হই।
এই জুম্মার দিনও একই অবস্থা। আমি মসজিদের গেটে ঢুকতে ঢুকতে শুনি মোয়াজ্জেম সাহেব একামত দেওয়া শুরু করে দিয়েছে।
কোনমতে স্যান্ডেলটা গেট থেকে উঠিয়ে গেটের একদম পাশে এক জায়গায় রেখে আমি দৌড়ে গিয়ে নামাজে দাঁড়ালাম। জুম্মার পরে সুন্নত পড়ে বের হওয়ার সময়ই বিপত্তি।
আমার সুন্নত পড়তে সাধারণত একটু দেরি হয়, ততক্ষণে মসজিদের প্রায় বেশিরভাগ লোক বের হয়ে গিয়েছে। আমি সুন্নত পড়ে ধীরেসুস্থে বের হতে গিয়ে দেখি আমার স্যান্ডেল নেই। মাত্র ১২০ টাকা দামের প্লাস্টিকের স্যান্ডেল। প্রথমেই মাথায় আসলো কেউ চুরি করে নিয়ে গেছে। আবার ভাবলাম এই প্লাস্টিকের স্যান্ডেলও কেউ কেউ চুরি করে?
১২০ টাকার প্লাস্টিকের স্যান্ডেল হলেও এটি আমাকে খুঁজে খুঁজে কিনতে হয়। পায়ের ব্যথার জন্য গত প্রায় আট বছর যাবত আমি এই একই স্যান্ডেল পড়ে আসছি। চামড়ার স্যান্ডেল বা অন্য কোন স্যান্ডেল পায়ে দিলেই পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা করে, তাই অন্য স্যান্ডেল আমার সয় না। যেখানে স্যান্ডেল রেখেছিলাম সেখানে খুঁজলাম, গেটের বাইরেও ভালো করে খুঁজে আসলাম; কোথাও স্যান্ডেল নেই।
এবার মন খারাপ করে মসজিদের দিকে তাকালাম, অল্প কজন মুসল্লি রয়েছে। আমি খালি পায়েই বের হয়ে যাব নিয়ত করে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখি যেখানে স্যান্ডেলটি রেখেছিলাম সেখানেই স্যান্ডেলটি পড়ে আছে।
এটা কোন ভৌতিক ঘটনা না, আমার সাথে যেন এরকম কিছু না কিছু ঘটবেই এটা মনে হয় তৈরি করাই আছে।
আজকাল সে বড্ড জ্বালাতন করছে।
যতই নতুন বাড়ির কাজ এগুচ্ছে ততই তার জ্বালাতন বাড়ছে, এটা আমার থেকে ভালো কে আর বুঝবে?
আমি বিরক্ত হয়ে মৃদু ধমকের সুরে বলি, মসজিদেও এগুলা করতে আছে?
কেউ শুনল কি?
- ওপাশ থেকে উত্তর দিল না কেউ
আমার মাঝে মাঝে খুব জানতে ইচ্ছে করে কে সে?
আবার ভাবি আমি কি জানি? আমিই বা কে!
দুপুরের কাঠফাটা রৌদ্দুরে চিড়বিড় করছে চারিদিক, রাস্তার পিচ প্রায় গলে গলে উঠছে। নীলাকাশে উড়ে উড়ে ঐ দূরে একটি দুটি কাক ডাকছে।
আমার কেন জানি হঠাৎই মন খারাপ হয়ে গেলো।
মনে মনে এক পাগলের কবিতা আউরোতে আউরোতে বাড়ির পথ ধরলাম -
কি চেয়েছিলাম আর কিই বা পেলাম!
হিসেব কষেছে কে?
ইচ্ছেগুলো, ইচ্ছের ভেতর যায় লুকিয়ে,
কাঠফাটা রৌদ্দুরে পুড়ছে প্রেমিকের স্বপ্ন
লু হাওয়ায় ওড়ে না প্রেমিকার দীঘল চুল
আকাশে নীলের মাঝে জ্বলছে রুপালী সূর্য
জ্বলছে শরীর, পুড়ছে মন, ভাংছে সব ভুল;
কিছু কিছু ভুল অন্ধকার আর বোধগুলোতে জ্বলছে আলো
কাকের ডানায় রোদের ঝিকিমিকি রঙ
দূর থেকে কোকিলের গান, কি ভীষণ লাগে যে ভালো।
#সত্য_ঘটনা_অবলম্বনে (গল্পরূপ)
কে, কে, কে?
- মোঃ আহসানুল হক
১৬ এপ্রিল, ২০২৩
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন