কাপড় চোপড়
- মোঃ আহসানুল হক
এর আগের দিন লিখেছিলাম খাওয়ার ব্যাপারে। এবার আসি পড়ায়, আরে না লেখাপড়ায় না; কাপড়চোপড় পড়ায়।
আমার গিন্নি কাপড়চোপড়ে বড্ড ফিটফাট, স্বভাবতই উনি চাইবেন আমিও যাতে উনার মতই ফিটফাট হয়ে চলাফেরা করি। ফিটফাট যে কি করে থাকতে হয় তা কখনো আমার বোধবুদ্ধিতেই আসে নাই। কি শীতে কি গরমে বাড়ির বাইরে কোথাও যেতে হলে আমার ওপরের অংশে একটুকরা গামছা আর নীচের অংশে ঢোলাঢালা পাতলা একটা পায়জামা কাম প্যান্ট যাতে অনেকগুলো পকেট, আমার বউ এই প্যান্টের নাম দিয়েছে - 'গোপালভার প্যান্ট'। তবে গরমটা আমার আর দশ জনের থেকে একটু বেশিই - আরে বাবা! আমার স্বাস্থ্য টার দিকে আপনার একটু তাকাবেন তো! মানুষের চামড়ার খোলে একটা আস্ত মহিষ ঢুকিয়ে দিলে কি অবস্থা হতে পারে আপনারা চিন্তাই করতে পারবেন না, আমার মত ভুক্তভোগী ছাড়া। আর যদি তা সীলমাছের মত চর্বিযুক্ত মহিষ হয় তবে তো কথাই নেই। আমি শুধু বুঝি আমার গরম লাগে - উথাল পাথাল গরম। মানুষ হওয়ার সবচেয়ে বড় যন্ত্রণা হলো বাড়ির বাইরে গেলে কাপড় নামক গায়ে কিছু একটা চাপিয়ে যেতে হয়, আমার মাঝে মধ্যে বনের পশুপাখিকে বড্ড হিংসে হয়; ওরা কি সুন্দর খালি গায়ে প্রকৃতি প্রদত্ত বাতাস লাগিয়ে ঘুরে বেড়ায়! আচ্ছা, চিন্তা করুন তো একটা মহিষ শার্ট পড়ে বনে হাঁটছে কিংবা একটা বানর লুঙ্গি পড়ে গাছের ওপর লাফাচ্ছে অথবা একটা গণ্ডার প্যান্ট পড়ে ঘোঁত ঘোঁত করছে, একটা পাখি'কে ডানার ওপর গেঞ্জি পড়িয়ে দিলে সে উড়তে পারবে? মানুষ'কেই কেন ঐসব বাহুল্য গায়ে চাপিয়ে রাখতে হয় তা কে জানে? বাইরে তাও ভদ্রতা করে গায়ে গামছার মত কিছু একটা চাপাই, ঘরে ঢুকতে ঢুকতে আমার গায়ের গামছাটা ঢিলা দিয়ে খুলে ফেলে দেই, কোনমতে কোমরে একটা লুঙ্গি জড়িয়ে প্যান্টটাকে মেঝেতে ফেলে রেখেই ঠাণ্ডা মেঝেতে চার হাত পা ছড়িয়ে ফ্যানের তলায় চিত হয়ে পেট ভাসিয়ে শুয়ে থাকি। আহ! খালি গায়ে মেঝেতে শুয়ে থাকার চেয়ে আরামদায়ক আর কিছু হতে পারে? উপায় থাকলে লুঙ্গিটা না পড়তে পারলেই ভালো হতো - কি আর করব, বাসায় বাচ্চা কাচ্চা আছে।
আমার এহেন পশু-কলাপে আমার গিন্নির চরম আপত্তি। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর কথা বলে বুঝিয়ে বুঝিয়ে ক্লান্ত হয়ে পরবর্তীতে মৃদু ভর্ৎসনা করা থেকে শুরু করে অকথ্য বকাবকির পরে আমাকে মানুষ করতে না পেরে এইতো বছর পাঁচেক ধরে ক্লান্ত হয়ে হয়ে ক্ষান্ত দিয়েছেন। তবে সে বাসার অংশটুকুতেই, বাইরে কোথাও যেতে গেলে আমি আমার ইচ্ছেয় কাপড় চোপড় পড়লেই উনি রুদ্রমূর্তি ধারণ করেন। উনার সাথে নিকট আত্মীয় স্বজন কিংবা কোন বন্ধু বান্ধবের (দুর্ভাগ্য বশত আমাদের বেশিরভাগই কমন বন্ধু) বাসায় যেতে গেলে তাও আমার মন খুশি মত গামছা টাইপের ক্যাজুয়াল কিছু একটা পড়তে পারি, কিন্তু কোন অনুষ্ঠানে যেমন বিয়ে শাদী অথবা অন্যান্য পার্টি সেন্টারের দাওয়াতে যেতে গেলেই বিপত্তি বাঁধে। উনি চান আমি আমাকে ওনার মত কাপড়চোপড়ে ফিটফাট করিয়ে আমাকে দাওয়াতে নিয়ে যেতে। সেখানেই বাঁধে বিপত্তি আর বেশিরভাগ দাওয়াতের এই বিপত্তি থেকে শুরু হয় কথা কাটাকাটি তার থেকে গলায় উচ্চস্বর, কিছুক্ষণের মধ্যে আমার রণে ভঙ্গ দেয়া এবং আমার রণাঙ্গন থেকে পলায়ন; ফলশ্রুতিতে ওনার একাই দাওয়াত এটেন্ট করা।
একদিন হয়েছে কি! আমাদের কোন এক আত্মীয়ের (প্লাস আমার মেয়ের বান্ধবী) বিয়েতে আমাদের দাওয়াত। তো আমার মেয়ে আমাকে শাসিয়ে গেলো যে আজ যেন কোন ভাবেই আমি তার মায়ের কথার অবাধ্য না হই, যেন ভালোমানুষের মত মা যেটা বলেন সেটাই পরিধান করে দাওয়াতে হাজিরা দেই। আমি ভালোমানুষের মত সন্ধ্যায় রেডি হতে গেলাম। সে কিছু বলার আগেই আমি আমার চিরাচরিত নতুন বানানো একটা গামছার ফতুয়ার সাথে আমার গোপালভার প্যান্ট পড়ে রেডি হয়ে ড্রইং রুমে বসে রইলাম। উনি মেয়ের বেডরুমে (মেকআপ করতে হলে উনি মেয়ের রুম ব্যবহার করেন) রেডি হচ্ছেন। একটু পর মেকআপ এর মাঝে কি একটা কাজে বের হয়ে আমাকে দেখে বললেন রেডি হয়ে নেও। আমি বললাম, নতুন ফতুয়া পড়ে রেডি হয়েছি তো! উনি চোখ গরম করে বললেন, ভালো একটা পাঞ্জাবি পড়। আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফতুয়া পাল্টে নতুন বানানো গামছার একটা পাঞ্জাবি পড়ে রেডি হয়ে বেডরুমে বসে টিভি দেখতে লাগলাম।
একটু পর উনি শাড়ি পড়ে মেকআপ সেরে আমাদের বেডরুমে ঢুকলেন। ঢুকেই চোখ গরম করে বললেন আবার গামছা পড়েছ? আমি বললাম, তুমি না পাঞ্জাবি পড়তে বললো? আমি তোমার কথা শুনে পাঞ্জাবিই তো পড়লাম। উনি গলা উঁচিয়ে বললেন গামছা পড়তে বলি নাই, তাড়াতাড়ি কাপড় পাল্টাও। আমি করুণ স্বরে বললাম, গামছা ছাড়া আমার আর কোন পাঞ্জাবি নাই। উনি ধমকে উঠে বললেন এইবার ঈদে আড়ং থেকে যে নতুন পাঞ্জাবিটা কিনে দিয়েছি ঐটা পড়। আমি মুখ কাঁচুমাচু করে বললাম, ঐটা তো ঈদের দিন পড়েছি। উনি আরেকধাপ গলা চড়িয়ে বললেন, ঈদে পড়েছ বলে কি পুরানো হয়ে গেছে? যাও ঐটা পড়ে নাও। আমি আরও মিউমিউ করে বললাম ঐটা একজনকে গিফট করে দিয়েছি। এবার চিৎকার করে উঠলেন - নতুন পাঞ্জাবি গিফট করে দিয়েছ মানে? আমি গলা আরেকধাপ নামিয়ে বললাম, এই, ইয়ে, মানে...... ঈদের দিন পড়েছি তো! একবার পড়া হলেই তো হলো, তাছাড়া আমি ঐসব দামি পাঞ্জাবি পড়ি না, এক বন্ধুর পছন্দ হয়েছিলো তাই ওটা তাকে দিয়ে দিয়েছি। কতক্ষণ চোখ দিয়ে ড্রাগন এর মত আগুন বের করলেন, তারপর বললেন অন্য ভালো কিছু একটা পড়।
তারপর একের পর এক আমি মডেলিং করেই যাচ্ছি, উনি ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে মেকআপ ফাইনাল করছেন আর আমি আলমারি খুলে একটির পর একটি কাপড় পড়ে তার সামনে দিয়ে ঘুরে আসছি, চোখ ইশারা করে পছন্দ হচ্ছে না বলছেন আর আমি নতুন আরেকটি পড়ে তাকে দেখাচ্ছি (যদিও আমার মেজাজ তখন তালগাছ বাওয়া শুরু করেছে তবে নিচ থেকে আইক্কাওয়ালা বাঁশ দিয়ে টেনে রেখেছি, যেহেতু মেয়ে শাসিয়ে গিয়েছে আজ ঝামেলা করা যাবে না।)
আমার যেমন খুশি তেমন সাজো চলতে লাগলো, উনার কোনটাই পছন্দ হচ্ছে না। উনি আজ বেশ সুন্দর করে সেজেছেন, সাদা ফুলহাতা ব্লাউজ দিয়ে আমার পছন্দের লাল টকটকে সিল্কের একটা শাড়ি পড়েছেন। খোপায় আবার জুঁই ফুলের মালাও গেঁথে মুখে ময়দার পরতে ফাইনাল টাচ দিচ্ছিলেন। আমি ওনার সাথে ম্যাচিং করার জন্য এবার ছেলের একটা লাল গেঞ্জি পড়ে ওনার সামনে আসি উনি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন উঁহু, তোমার বয়সে এটা মানাচ্ছে না। আমি এবার গলা চড়িয়ে বললাম তাইলে কি পরবো তুমিই বলো। সে ঝাঁজের স্বরে বলল, দেখছ না আমি কি সুন্দর ম্যাচিং করে শাড়ি ব্লাউজ পড়েছি! তুমি আমার সাথে মিলিয়ে কিছু পড়তে পারছ না? এইটাও আমাকে বলে দিতে হবে?
এবার সত্যিই আমার রাগ উঠে গেলো, আমি রাগের চোটে সাদা ফুলহাতা গেঞ্জির উপর লাল রঙের তার একটা শাড়ি পেঁচিয়ে ঘরে আসলাম, এসে বললাম আমার সাদা ব্লাউজ নেই তাই গেঞ্জি পড়েছি আর তোমার শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে তোমার ড্রয়ার থেকে তোমারই লাল আরেকটা জর্জেট পড়েছি, এবার দেখো একদম খাপের খাপ মিলে গেছে। সে আমার দিকে কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে তাকিয়েছিল, তারপর হাতে থাকা চুলের ব্রাশটা ছুড়ে মারলো; ঠকাস করে মাথায় লেগে রক্তারক্তি কান্ড। আমি দৌড়ে পালাতে গিয়ে শাড়িতে পেঁচিয়ে পড়ে গেলাম। ধ্যাত! শাড়ি আবার মানুষে পড়ে? লম্বা এ কাপড়টা এত প্যাঁচ প্যাঁচিয়ে এরা চলে কিভাবে?
মেয়ের কথা আর রাখা হলো না, আমার সেদিনকারও বেড়াতে যাওয়া মাথায় উঠলো। এটা নতুন কিছু নয়, আমাদের সংসদে প্রায়শয়ই এরকম হয়। সে রাগ করে একা একাই অনুষ্ঠানে চলে গেল, আর আমি খালি গায়ে লুঙ্গি পড়ে চিত হয়ে ফ্যান ছেড়ে ভুড়ি ভাসিয়ে মনের আনন্দে টিভির চ্যানেল ঘুরাতে থাকি।
#রম্য
কাপড় চোপড়
- মোঃ আহসানুল হক
০৮ মে, ২০২৩
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন