নতুন বাড়িতে কে?
- মোঃ আহসানুল হক
সাগরকে ধরে না শুলে ঘুম আসে না আনিশার। ওরা তৈরিই হয়েছে যেন দুজন দুজনার করে। অনেক ঝড়ঝঞ্ঝা পার হতে হয়েছে দুজনকেই ১৫ বছরের ভালোবাসার সম্পর্কটাকে বিয়েতে রূপ দিতে গিয়ে। বিয়ের পরেও ঝামেলা কম হয়নি দু পরিবারেরই পক্ষ থেকে। আনিশা আর সাগর বিয়ের কিছুদিন পরেই দুজনে মিলে আলাদা হয়ে গিয়েছিল পরিবার থেকে। এখন একটা বাসায় শুধু আনিশা ও সাগর আর তাদের ভালোবাসার সময়। বছর ঘোরার আগেই আনিশা মা হতে চলল। যেদিন প্রথম সাগর কে বলল, সাগর খুশিতে কেঁদে দিয়েছিল। অতি অনুভূতিপ্রবণরা খুশিতে কেঁদে দেয়। এ সংবাদ শোনার পর সাগর অফিস সময়টা বাদ দিয়ে বাকি সময়টা আনিশাকে আগলে রাখছে।
পেটের জন্য খাদ্যের প্রয়োজন আর খাদ্যের জন্য টাকার। আগে সংসারে তারা দুজন ছিলো এখন সংসারে আরেকটি নতুন সদস্য আসছে যাচ্ছে। তাই সাগর ছুটাছুটি করছে কি করে দুটো অতিরিক্ত টাকা আয় করা যায় তার অহ্নেষণে। তাই আজ সাগরে আসতে একটু রাত হয়েছে। আনিশার শরীরটা বেশি ভালো না থাকায় সে খেয়ে আগেই বিছানায় শুয়ে পড়েছে। সাগরকে ছাড়া ঘুম আসছিল না তাই মোবাইল নিয়ে এপাশ ওপাশ করছে। সাগর একা একাই ডিনার করে প্লেট গ্লাস সব গুছিয়ে তারপরে শুতে আসলো। এসেই আনিশাকে জড়িয়ে ধরল। ভালোবাসাবাসীর কিছু সময় পার করে সাগরের বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল আনিশা। সারাদিন কাজের পরে ক্লান্ত সাগরেরও দুচোখ ভেঙ্গে ঘুম জড়িয়ে আসলো।
হঠাৎ করেই আনিশার ঘুম ভেঙে গেল। ডাইনিং রুমে কার জানি হালকা পায়ের শব্দ। কেউ যেন খুব আস্তে আস্তে বা টিপে টিপে হাঁটছে। আনিশা প্রথমে অবাক হয়ে গেলেও পরক্ষণেই একটু ভয় পেয়ে গেল। আস্তে আস্তে সাগরকে ধাক্কা দিতে লাগলো। আনিশার ধাক্কায় সাগরের ঘুম ভেঙে গেল। সাগর কি হয়েছে জানতে চাইতেই আনিশা সাগরের মুখ চেপে ধরল। ফিসফিস করে বলল ও ঘরে কে যেন হাঁটছে। মোবাইল ঘড়িটায় সাগর দেখল রাত তিনটা বাজে। সাগর বললো, চোর না তো? সে বিছানা থেকে উঠতে যেতেই আনিশা তার হাত চেপে ধরল। বলল, যেও না ও ঘরে।
আনিশার গলায় কিছু একটা ছিল। হঠাৎ করেই সাগরের মেরুদণ্ড বেয়ে অন্যরকম একটা ভয়ের স্রোত নেমে গেল। ভয় পেয়েছে আনিশাও। ও ঘরের ডাইনিং টেবিল চেয়ার টানার শব্দ। কে যেন বসল চেয়ারে। ঠক ঠক করে পানি খাওয়ার শব্দ। নিস্তব্ধ রাতে প্রত্যেকটা শব্দই কানে বাজছে। আনিশা আর সাগর দুজন দুজনার দিকে তাকিয়ে আছে। সাগর ও ঘরে যেতে চাইছে তবুও কি এক অজানা ভয়ে বিছানা ছাড়তে পারছে না। আনিশা অনেক বাস্তববাদী মেয়ে হলেও হঠাত করেই কেমন এক অজানা ভয়ে শিটিয়ে আছে, দুজনই একদম স্তব্ধ হয়ে বিছানায় বসে রইলো।
চেয়ার থেকে কেউ যেন উঠে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ মৃদু পায়ে পায়চারি করার শব্দ। তারপর হেঁটে হেঁটে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল শব্দটা। রান্নাঘর থেকে ঝনঝন শব্দে কি যেন একটা পড়লো। নিস্তব্ধ রাতে মেঝেতে সেই পতনের শব্দ যেন কানে তালা লাগিয়ে দিল।
হঠাৎ করেই আনিশার মনে পড়লো তার বিড়াল তিনটার কথা। ওদের কোন সাড়া শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না কেন? বাইরের কেউ ঢুকলে তো ওদের মিউ মিউতে বাড়ি মাথায় করে ফেলার কথা এতক্ষণে। এরা তিনজন এত চুপ হয়ে গেল কিভাবে? আনিশাকে ও ঘরে যেতে হবে। সে বিছানা থেকে উঠতে গিয়ে আবার কেমন জানি তীব্র একটা অজানা ভয় তাকে গ্রাস করল। সাগরের মুঠোর ভেতর তার হাত একদম বরফ হয়ে যেতে লাগলো। একটা ভয় আচ্ছন্ন করে রেখেছে সাগরকেও। সেও কয়েকবার উঠি উঠি করেও বিছানা থেকে কোনভাবেই যেন উঠতে পারছে না।
এবার রান্নাঘরে ঝনঝন করে একটা কাচের বাসন পড়ার শব্দে রাতের নিস্তব্ধতা খানখান হয়ে গেল। আর তারপর পরই পাশের ঘর থেকে তিনটা বিড়াল একসাথে কেঁদে উঠলো। এ তো শুধু কান্না নয়, তারা প্রচণ্ড ভাবে চিৎকার চেঁচামেচি করতে লাগলো আর আনিশার শোবার ঘরের দরজায় এসে নখ দিয়ে দরজা আঁচড়াতে লাগলো। একই সময়ে বিল্ডিং এর নিচে মহল্লার ৫-৬ টি কুকুর তারস্বরে চিৎকার জুড়ে দিল। হঠাৎ করেই যেন রাতের নিস্তব্ধতা লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল। একদিকে দরজায় বিড়ালের খামচা খামচি আর একদিকে রাস্তায় কুকুরের চিৎকার। পাশাপাশি হঠাৎ করেই আনিশার ভয় কেমন জানি কমে যেতে লাগলো। ধাতস্থ হয়ে এসেছে সাগরও ততক্ষণে। হঠাৎ করেই যেন ভয়টা উধাও হয়ে গেছে। আবার যেন চারিদিকে স্বাভাবিক। আনিশা দরজা খুলে বের হতেই তিনটা বিড়াল একযোগে তার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ওদের জড়িয়ে ধরতে আনিশা বেশ বুঝলো তারা ভয়ে কাঁপছে। সাগর ঘর থেকে বের হয়ে সমস্ত বাড়ির বাতি জ্বালালো। খাবার পর ডাইনিং টেবিলের চেয়ারটা টেবিলের সাথে লাগিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। বের হয়ে দেখতে পেল চেয়ারটা টেবিল থেকে অনেক দূরে টানা। রান্নাঘরে গিয়ে দেখল একটা হাড়ি উল্টে পড়ে আছে, দুইটা প্লেট ভেঙে চুরমার হয়ে সাড়া মেঝে ছড়িয়ে আছে। খাবার পর সাগর রান্নাঘরটা পুরো গুছিয়ে গিয়েছিল। রান্নাঘরের এই অবস্থা দেখে সে হতবুদ্ধি হয়ে গেল।
আনিশা চেক করে দেখলো মেইন দরজায় ছিটকিনি দেয়া। তাছাড়াও এটি অটো লক। ভেতর থেকে না খুললে বাইরে থেকে চাবি ছাড়া খোলার কোন উপায় নেই। তারা দুজনেই হতবুদ্ধি হয়ে ডাইনিং টেবিলে বসে পড়ল। দুজন দুজনার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। দুজনার চোখেই জিজ্ঞাসা। উত্তর দেবে কে?
দুদিন পরে আমি আনিশাদের বাসায় গেলাম। আনিশাদের উপর তলায় আমার বাসার কাজ চলছে। আমরা আমাদের পুরনো বাড়ি ছেড়ে খুব শিগগিরই এবার এ বিল্ডিংয়ে উঠে আসবো। এই বিল্ডিং এ কাজ দেখতে আসলে আমি মাঝে মাঝেই ওদের দুজনকে দেখে যাই। আনিশার শরীরটা বেশ খারাপ দেখলাম। চোখ মুখ কেমন জানি শুকিয়ে গিয়েছে। আমি সাগরকে ধমক দিয়ে বললাম কিরে বৌ এর দেখাশোনা করছিস না? সাগর হেসে দিয়ে বলল দেখাশোনা করছি তো। আমি বললাম তাহলে এরকম অসুস্থ লাগছে কেন? তখন তারা দুজন মিলে আমাকে দু রাত আগের ঘটনা বলল।
ঘটনাটি শুনেই আমার শরীরে কেন জানি কাঁটা দিয়ে উঠলো। ওদের কিছু বুঝতে দিলাম না। শুধু একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইলাম বাইরের অন্ধকারের দিকে। হঠাত করেই আমার মনে হলো - তবে কি সে? সেই সে, যুগ যুগ ধরে যে আমার সাথে লেগে আছে ছায়ার মত, আমার স্বত্বায় ভয় হয়ে। আমরা এ বাড়িতে চলেই আসব দেখে কি আমার সাথে সাথে এখানে যাতায়াত শুরু করে দিয়েছে? এ বাসায় আমি আছি বলে আমাকে জানান দেওয়ার জন্যই কি কিছু অশরীরী কাণ্ড? চুপ করে থাকে বাইরের অন্ধকার। যতই আমি আলো জ্বেলে যাই এই অন্ধকার আমাকে ছাড়বে না, ছাড়বে না আমাকে সে ও। আমি শুধু ফিসফিস করে বলি – ওরা কোন দোষ করে নি; তোর সকল হিসেব শুধুমাত্র আমার সাথে। কেউ শুনলো কি?
#সত্য ঘটনার গল্পরূপ
নতুন বাড়িতে কে?
- মোঃ আহসানুল হক
১৫ই এপ্রিল, ২০২৩
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন