আমার একটা খারাপ অভ্যাস আছে, খুবই খারাপ অভ্যাস। আমি ঝগড়া না করে বেশিক্ষণ থাকতে পারি না। আমার মুখের ভেতরটা কেমন যেন চুলকায়, পোয়াতি মেয়েদের মত ক্রমাগত শরীর গুলায়।
বাসায় থাকতে আমি সারাক্ষণ ঝগড়া করি, বউয়ের সাথে। সেও কি ঝগড়া করে না? আরে করে বাবা! করে; এক হাতে তো আর তালি বাজে না! আমি যদি একশটা কথা শোনাই সে একটার তো জবাব দেয়! তাতেই আমি উৎসাহিত হয়ে পরবর্তী আরও দুইশটা বলার সুযোগ পাই। আমাদের কন্টিনিউয়াস ঝগড়া লেগেই থাকে।
আমি যেমন আমার বউয়ের সাথে ঝগড়া করি! ঠিক তেমনি আমার মেয়ে আমার সাথে ঝগড়া করে। আমার মেয়ের ক্ষেত্রে আমার ভূমিকা আমার বউয়ের মত। সে দুইশ বললে আমি একটা বলি তারপর আরও চারশো শোনার জন্য একটু খোঁচা মারি।
ব্যাস! আর যায় কোথায়!
আমার আরেকটা খুবই খারাপ অভ্যাস আছে। আমার বেশিক্ষণ ভালো না বাসলেও চলে না, কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগে। আর ভালোবাসার পাত্রীও ঘুরেফিরে এই দুইজনই। তবে এক্ষেত্রে আমার বউয়ের থেকে মেয়ে খানিকটা এগিয়ে। মেয়েকে ১০০, ২০০ বার ভালবাসলে সে আমাকে এক দুইবার প্রতিদান দেয়। ওইটুকু আমার জন্য যথেষ্ট। বউকে অবশ্য ১০০ বার ভালবাসলে সে এক হাজার বার প্রতিদান দেয়। তবুও যেন আমার মন ভরে না।
আজ দুইদিন ধরে বাসায় এদের দুজনার একজনও নাই। আমার মন খুবই খারাপ। মুখের ভেতরটা চুলকাচ্ছে ঝগড়া করার জন্য মন চুলকাচ্ছে ওদের ভালোবাসার জন্য। আমি ছাদে বসে রেলিং এ হেলান দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি, আর চিন্তা করছি কখন থেকে আমার এই অসুখের সূচনা!
একটু গভীরভাবে চিন্তা করে দেখলাম - এই অসুখের সূচনা আমার খুব বাল্যকালে। সূচনাটা অবশ্য প্রেম দিয়ে, অতঃপর প্রেমের অপ্রাপ্তিতে রাগ তার থেকে ঝগড়া। সময় বাড়ার সাথে সাথে দুটোতেই আমি বেশ পটু হয়ে উঠেছিলাম।
কবে থেকে প্রেমের সূচনা জানো? লেখাপড়ার ক্ষেত্রে তোমাদের আজকাল যেমন নার্সারি, প্লে গ্রুপ ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি! আমাদের সময় ছিল ক্লাস বেবি ওয়ান টু থ্রি। আমি মনে হয় ছোটবেলায় বয়সের তুলনায় একটু বেশিই পেকে গিয়েছিলাম, তাই বাবা-মা আমাকে বেবিতে ভর্তি না করিয়ে সরাসরি ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করায়। ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হয়ে দেখি আমার বড় ভাইও সেখানে আর তার বন্ধু-বান্ধবরা ও সেখানে। ক্লাসে আমি বয়সের তুলনায় সবচেয়ে ছোট ছিলাম, এমনকি সাইজে আর হাইটেও। যেদিকেই তাকাই আমার মাথার ওপর বিঘৎ-খানেক কিংবা আধা-একহাত মাথা দেখতে পাই। সাইজে ছোট বলে ক্লাসের বাকিরা কেউ আমাকে পাত্তাই দিতো না।
আমাদের ছিলো কো-এডুকেশন স্কুল। স্কুলে ভর্তি হয়ে প্রথম দিনে আমার চোখ গেল সালুজার দিকে। আমার থেকে আধ হাত লম্বা, শ্যামলা মায়াবী চেহারার একটি মেয়ে। তার ডাগর কালো চোখের দিকে তাকিয়ে যেন আমি কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলাম সেই ইঁচড়ে পাকা বয়সে। আচ্ছা তোমরাই বল পাঁচ বছর বয়সে কারো মনে কি প্রেম ভাব জাগতে পারে? কারো মনে পারে কিনা জানিনা আমার জেগেছিল। এখন ঐ বয়সে কেন প্রেম অনুভূতিটা এ তীক্ষ্ণ হয়ে মনে এসেছিলো তা বলতে পারব না। প্রথম দর্শনেই প্রেম - বয়সে আমার থেকে এক বছর বড়, লম্বায় আমার থেকে আধ হাত বড় লাস্যময়ী একটা মেয়ের সাথে। আমি তাকে কিছুই বলিনি, তবে স্কুলটা হঠাৎ করেই যেন আমার খুব প্রিয় হয়ে উঠেছিল। সকাল হলেই স্কুলে যাওয়ার জন্য ছটফট করতাম, আর স্কুলে গিয়ে সালুজা মেয়েদের যে বেঞ্চটায় বসতো তাই বসতো আমি ঠিক তার পাশেই ছেলেদের অংশে গিয়ে বসতাম। সপ্তাহ-খানেক এভাবেই চলেছিল।
তারপর আমার মাথায় আকাশ ভাঙল - যেদিন স্কুলে প্রিন্সের আগমন ঘটলো। প্রিন্স এ স্কুলেরই ছাত্র ক্লাস, বেবি থেকে ওরা বাকি ছাত্র-ছাত্রীরা একসাথেই পাস করে ওয়ানে উঠেছিলো, আমিই একমাত্র নতুন ছাত্র। আমি ভর্তি হওয়ার সময় প্রিন্স কোথায় জানি বেড়াতে গিয়েছিল। প্রিন্সের চেহারা প্রিন্সের মতই সুন্দর। আমার থেকে এক হাত লম্বা, ধবধবে ফর্সা নায়কের মত একটা ছেলে। সে প্রথম দিন ক্লাসে ঢুকেই ধাক্কা দিয়ে আমাকে আমার জায়গা থেকে সরিয়ে দিয়ে বললো - কিরে পুঁচকি এখানে বসেছিস কেন? আমি তার দিকে রাগত দৃষ্টিতে চাইতেই সে ফিক করে হেসে দিয়ে বলল - ওহে বাচ্চা এটা আমার জায়গা। সালুজার দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললো - আর ওই যে পরীর মত মেয়েটা দেখছিস না! ওটা আমার বউ।
ওমা তার কথা শুনেই সুন্দরীর মুখে প্রথমবারের মতো প্রশ্রয়ের হাসি আর আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। তারপর পুরোটা স্কুল সময় তাদের দুজনের খুনসুটি, আর আমার বুকে রাগের কাটাকুটি। আমি অনেক চিন্তা করে দেখলাম সেটাই বোধহয় আমার জীবনে প্রথম প্রেম আর সেটাই বোধ হয় আমার প্রথম রাগ করা। তো সেই রাগ থেকে যেই প্রিন্সের সাথে ঝগড়া করতে গিয়েছি সে মাছি তাড়াবার মত করে ধারাম করে আমার মাথায় গাট্টা মারলো। আমি ছিটকে পড়ে গিয়ে রাগত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। রাগ মিটালাম বাসায় এসে মায়ের সাথে অযথাই ঝগড়ায় মেতে। সেই থেকে শুরু।
আজ প্রিন্সই বা কোথায় সালুজাই বা কোথায়? নাহ! পরবর্তীতে তাদের প্রেম আর টিকে নি। সালুজার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল মেট্রিক পরীক্ষার পরপরই। প্রিন্স পরবর্তীতে আরও চারটা পাঁচটা লদগালদগি প্রেম করে শুনেছি শেষ পর্যন্ত থিতু হয়েছিল কার সাথে জানি। এদের কারোর সাথেই আজ আমার যোগাযোগ নেই। প্রিন্স তুই কি আছিস আমার ফেবু লিস্টে? সালুজা? ওরা থাকলে এই লেখা পড়ে হাসবে, হয়তো আমাকে গালাগালি করবে। বিশ্বাস কর আমি কিন্তু তোদের পুরো নাম বলি নি, নিক নামে কয়জন কাকে চেনে?
সবাই যার যার প্রেম নিয়ে ভালো থাকুক। কিন্তু আমার এখন ঝগড়া করতে ইচ্ছা করছে। আচ্ছা ঝগড়া করার ইচ্ছা কি ঝগড়াচ্ছা হয় না? নাকি ঝগড়া + ইচ্ছা = ঝগড়িচ্ছা? যাই হোক আমি না হয় ভুল নামই দিলাম ঝগড়াচ্ছা! আচ্ছা! এর ব্যাসবাক্য কি? এটা কোন সমাসই বা কি? আমি অবশ্য বাংলায় ভয়ংকর রকম কাঁচা। ক্লাস টেনে টেস্টে বাংলা প্রথম পত্রে ৩৪ আর দ্বিতীয় পত্রে ৩২ পেয়ে কোনমতে দুই পেপার মিলে পাশ করেছিলাম। তারপর আর বাংলার ঘর মাড়াই নাই। থাক বাবা লেখার মত বিদ্যেটা তো হয়েছে! না হয় ভুল ব্যকরণে অথবা ভুল বানানে।
ধ্যাত! যা ইচ্ছা তাই হোক, মুখের ভেতরটা ভয়ংকর চুলকাচ্ছে। আচ্ছা! ইচগার্ড দিয়ে মুখের ভেতর ডলা দিলে কি চুলকানি বন্ধ হবে? নাকি কচুর রস ডলব? ধ্যাত! কেউ তো এসে ঝগড়া করুক আমার সাথে! না হয় প্রেম! আকাশ লাল হতে হতে কালো হয়ে গেলো। কেউ এলো না। আচ্ছা! অন্ধকারের কি মন খারাপ হয়?
#হিবিজিবি_হাবিজাবি
ঝগড়াচ্ছা
- মোঃ আহসানুল হক
০৪ ডিসেম্বর, ২০২৪
#রম্য