একটা ফুটফুটে কিশোর, মাত্র ১৭ বছর। এবার ও লেভেল দিয়েছে।
গত ১০ দিন ধর রোজ রাতে আমার ঘরে আসে, এসে চোখে বসে। বসে খুনসুটি করে। জিজ্ঞেস করে, বাপ্পা ঘুমাচ্ছ? আমার ঘুম ভেঙে যায়।
ধমক দিয়ে বলি - যা তো বাবা! দুষ্টুমি করিস না, ঘুমাতে দে।
তার হাসিহাসি মুখটা মুহূর্তে কান্নায় ছেয়ে যায়। অভিমান করে আমায় বলে - জানো না আমার এজমা? জানো না আমি মাটিতে শুতে পারি না? জানো না একটু উনিশ-বিশে আমার হাঁপানির টান ওঠে? তা হলে আমাকে মাটিতে শুইয়ে তুমি কেমন করে বিছানায় ঘুমাও বাপ্পা?
আমি লাফিয়ে বিছানা থেকে উঠে বসি। অন্ধকারে চেয়ে থাকি। একসময় অন্ধকারটাও ঝাপসা হয়ে যায় চোখের পানিতে। তারপর নির্ঘুম রাত।
না, আমি কোন গল্প লিখছি না।
আমি আমার কথাই লিখছি।
আমার এই বাবাটা আমার ১৭ বছরের ভাতিজা - তালহা। আমরা দুই ভাই পুরানো চিন্তা চেতনার মানুষ, তাই হয়তো এখনো জয়েন্ট ফ্যামিলিতে মিলেমিশে থাকি। তালহারা দুই ভাই ওদের বাবা'কে বাবা ডাকে আর আমাকে ডাকে বাপ্পা, তাদের চাচীকে ডাকে বড় মা। আমার সন্তানদের কাছে তাঁদের চাচী - ছোট মা। সুতরাং বুঝতেই পারছেন আমাদের ফ্যামিলি বন্ডিং।
তালহাকে গত ২৫ তারিখ বৃহস্পতিবার প্রাইভেট পড়ে আসার সময় এক আর্মি অফিসার ধরে নিয়ে যায়। তার অপরাধ ছিলো, পড়ে ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরার সময় গাড়ির সিট এলিয়ে পা ড্যাশ-বোর্ডে উঠিয়ে আরাম করতে করতে আসছিলো। অনেক উঁচু র্যাংকের আর্মি ভাইয়ের তা সহ্য হয় নি।
কি?
এতবড় কথা?
আমাকে পা দেখায়!!!
গাড়ি থামিয়ে বললো, পা দেখালি কেন? গাড়ি থেকে নাম্।
তালহা থতমত খেয়ে গাড়ি থেকে নামলো।
তারপর তার মোবাইল চেক করে কি কি যেন দেখলো, তারপর উঠিয়ে থানায় নিয়ে গেলো।
তালহা বলেছিলাম, আঙ্কেল আমি আপনাকে পা দেখাই নি, আমি শুয়ে ছিলাম মাত্র। আমি টিচারের বাসায় পড়তে এসেছিলাম এখন বাসায় ফিরছি। আমি মাত্র স্কুল শেষ করে এবার ও লেভেল পরীক্ষা দিয়েছেই। আমাকে ধরবেন না, প্লিজ ছেড়ে দেন। কিন্তু আর্মি অফিসার সাহেবের মোটা মাথায় কোন অনুনয়ই প্রভাব ফেললো না। তালহাকে অবাক করে দিয়ে তুলে নিয়ে গেলো।
খবর পেয়ে আমাদের পরিবারের ওপর যেন বজ্র পড়লো।
ডিটেল না বললাম, শুধু এটুকু বলতে পারি যে আমাদের পক্ষে যতটুকু সম্ভব আর অসম্ভব করার ছিলো আমরা তার কোন কিছু করতেই বাকি রাখি নি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাদের সন্তানকে আনতে সফল হলাম না।
কেন জানো?
ঐ আর্মি অফিসারের ইগো।
তাকে নাকি ঠ্যাং দেখানো হয়েছে।
কোন অনুনয় বিনুনয় করেও তার মন গলানো গেলো না।
আমাদের জানাশোনা কিছু আত্মীয়-স্বজন ওনার অনেক ওপরের লেভেলের অফিসার; ওনাদের দিয়ে ফোন করালাম, বললো তার মোবাইলে ভয়ংকর সব দেশদ্রোহী ভিডিও পাওয়া গিয়েছে। আমরা দেখতে চাইলাম কি ভিডিও। দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলো।
থানার লোকেরা থানায় ৩ দিন রাখলো আর্মি সাহেবের মন গলাবার জন্য, বাচ্চা ছেলে ভুল করে ফেলেছে নিজেদের গাড়িতে পা উঠিয়ে শুয়ে। তার মা বাবা অনেক অনুনয় করলো আর্মি অফিসার'কে, এই বলে যে স্যার ওর তো এখনো আঠারও হয় নি, ছেলেটার বাকি জীবনটা পড়েই আছে, ওর ভবিষ্যত নষ্ট করে দিবেন না; উনি পাথর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। যখন আর কোন অনুনয়েই কাজ হলো না ৩ দিন পর বাধ্য হয়ে থানা থেকে তাকে পাঠিয়ে দিলো জেলে।
আজ প্রায় পনর দিন ধরে সে জেলে আছে, কেমন আছে, কি অবস্থায় আছে কিচ্ছু জানি না। ওখানে খাট পেয়েছে না মাটিতে ঘুমাচ্ছে, জানি না। কবে ফিরে পাব তাকে, জানি না। আমাদের সবচেয়ে ছোট সন্তান, সবচেয়ে ইনোসেন্ট আর হাসিখুশি বাচ্চাটা আজ শুয়ে আছে জেলে, হয়তো খাটে কিংবা মেঝেতে।
আমি ঘুমাই কি করে? গত পনর রাত ধরে প্রায় সারারাত জেগে থাকি, তাহাজ্জুদে সেজদায় পড়ে থাকি।
মজার ব্যাপার কি জানো? তালহার কেসে কোথাও মোবাইল ভিডিও বা মোবাইল জব্দের কথা লেখা নাই। সে নাকি যেসকল না না জানা পাঁচ ছয় হাজার ছাত্র মিলে সরকারের বিভিন্ন স্থাপনা ভাংচুর করেছিলো (যার মূল্য পনর লক্ষ ত্রিশ হাজার টাকা মাত্র) তালহা তাদেরই একজন। মনে শান্তি এলো, যাক! অধিকার আন্দোলনের যোদ্ধাদের সাথে আমাদের ছেলেটার নাম তো যুক্ত হলো! যেমন তার এক দাদার নামের পাশে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা নামটা লেখা আছে।
আচ্ছা! আমার মনে একটা প্রশ্ন খেলছে!!! তালহার মোবাইলটা গেলো কোথায়? আর্মি অফিসার সাহেবের কাছে না থানার ওসির কাছে? কি করছে তারা ঐ বাচ্চা ছেলেটার মোবাইল দিয়ে? তাঁদের সন্তানদের উপহার দিয়েছে! কত প্রশ্নের উত্তর যে আমাদের জানা হয় না!
কার কাছে বিচার দেব? দুঃখে শোকে আল্লাহ্'কেই ডাকি, তাকেই বলি - হে আল্লাহ্! এ জালিমদের থেকে আমাদের সন্তানদের হেফাজত করুন। আমাদের সন্তানকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দিন।
সেজদায় প্রতি ওয়াক্তে দোয়া করি যেন ফিরে পাই, আমাদের সন্তানকে যেন ফিরে পাই।
হোক সাত দিন হোক পনর দিন কিংবা মাস।
ফিরে পাই যেন।
#একজন_পিতার_কথা
আমাদের তালহা
- মোঃ আহসানুল হক
০৪ অগাস্ট, ২০২৪
বিঃদ্রঃ আজ তালহার মত হাজারো ছেলে এভাবেই বিনা অপরাধে জেলে পড়ে আছে, ওরা নিজেও জানে না কি অপরাধে। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরেও কি আমরা কথা বলার, নিশ্চিন্তে চলাফেরা করার স্বাধীনতাটুকুও হারিয়ে ফেলেছি?
আজ ঘরে ঘরে এক একজন তালহার কাহিনী।
ঘুমাতে পারে না আমার ছেলে, আগে রুমে থাকলে সারাক্ষণ এসি চালিয়ে রাখতো, তালহা যাওয়ার পর তার ঘরে এসি চলে না। জিজ্ঞেস করায় বলে - আমার ভাই এসি ছাড়া একটা রাতও কাটাতে পারতো না তার হাঁপানির টান উঠে যেত, সে এখন মেঝেতে শুয়ে। আমি এসি চালাই কিভাবে?
ডিটেল না বললাম, শুধু এটুকু বলতে পারি যে থানায় আজকাল মানুষ কেনাবেচা হয়।
দুঃখের বিষয় কি জানো! এই কেনাবেচার হাটে ঔরসজাত সন্তানকেই কিনতে যেতে হয় বাবাকেই অথবা চাচা কিংবা ভাই-বোনদের। দেশরক্ষা বাহিনী যেখানে মানুষ কেনাবেচার হাট বসায় সেখানে তো অসহায় পিতামাতাকে জন্ম দেওয়া সন্তানটা তাঁদের কাছ থেকেই কিনে নিতেই হয়। কেন? - তাকে দেশরক্ষা বাহিনীর অত্যাচার থেকে বাঁচাতে। তাই না?
আমরাও আমাদের সন্তান কিনতে গেলাম। থানার সাথে তো দফারফা হলো, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাদের সন্তানকে কিনতে সফল হলাম না।
কেন জানো?
ঐ আর্মি অফিসারের ইগো।
তাকে নাকি ঠ্যাং দেখানো হয়েছে।
কোন অনুনয় বিনুনয় করেও তার মন গলানো গেলো না।